সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব – ২১)

শহরতলির ইতিকথা

রাজীব  গররাজি হলেও,বিয়ের দিন ঠিক  হয়েছেএবং বিয়ের ব্যাপারে সে সংক্রিয় অংশ গ্রহন করলো।রমাদের বাড়ির  ছাদে হয়েছে  লোকজন  খাওয়ানোর  জন্য প্যাণ্ডেল, রমাদের ভিতরের  উঠোনে ওড়িয়া ঠাকুরের দলবল রান্নার সরঞ্জাম  নিয়ে ব্যস্ত  থাকলো তিনদিন। না,উৎসব,অনুষ্ঠানে কেউ বুঝতেই  পারবেনা যে এরাই পরস্পরের  মধ্যে এত ঈর্ষান্বিত।পাড়া সংস্কৃতি বলতে  তো এটাই  বোঝায়,তখন না থাকে ভেদ বুদ্ধি, না থাকে কোনো বিদ্বেষের লেশমাত্র,সবাই একটা অব্যক্ত  আত্মীয়তার সূত্রে বাঁধা। নিজেদের  বাড়ির ছাদ তো  আরবিসি,বেশি ভার নিতে  পারবে  না,তাই  ছোট প্যাণ্ডেল  করা হয়েছে।
নিচের খোলা বারান্দায় এখন তো ঘেরা ঘর হয়েছে,ঐখানেই নতুন বৌকে বৌভাতের দিন  বসানোর  ব্যবস্থা হয়েছে। আত্মীয়-স্বজন বলতে,প্রায় সবাই  হৈমবতীর  দিক থেকে; হাজরামশাই ‘র দিক থেকে কেবল এসেছে  কেবল কেঁটেলিবাজ ভাইটা:উদ্দেশ্য  ,দাদার  ছেলের  বিয়ে উপলক্ষ্যে উপস্থিত  হয়ে,কীভাবে গণ্ডগোল পাকানো যায়;ওটাও বরযাত্রী সেজে  চলেছে।
 বিয়ের  দিন,হাজরামশাই, বামুন সংগে নিয়ে ট্যাক্সি করে  বর-বেশে সজীবকে  নিয়ে,সন্ধ্যা সাতটায় রওনা হয়ে গেছে; মিনিট চল্লিশের পথ।  এ বিয়ের বরকর্তা,রাজীবের জামাই-দা; তাঁর উপর বরযাত্রীদের  নিয়ে ন’টার মধ্যে  বিয়ের আসরে পৌঁছানোর কথা।
 চার নম্বর রুটের বাস এ অঞ্চলে চলে;বাসের সঙ্গে  কথা হয়েছে শেষ ট্রিপ,  চুঁচুড়া-ত্রিবেণী সেরে,বাঁশবেড়িয়ার মহাকালীতলা থেকে, আটটা-সাড়ে আটটায়  সময় বরযাত্রীদের  নিয়ে বাস রওনা হবে। বরযাত্রীদের  বাস গেলে,তবেই  কেবলমাত্র   বিয়ের জন্য বরকে,বরাসন থেকে নিয়ে যাবার  অনুমতি মিলবে,এবং এ অনুমতি বরকর্তার অনুমোদন সাপেক্ষ;বিয়ের লগ্ন রাত বারোটা পর্যন্ত ।
    সজীব-রাজীবদের জামাই-দা,কনে- পক্ষের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত।শৈশবে, ওনাদের মা মারা যাবার  পর ঘরে বিমাতা এলে,কনের সর্ম্পকের দিদিমা,জামাই -দা’র  দাদা ও ওনাকে নিজের কাছে নিয়ে এসে,নিজের সন্তানদের সংগে এ অঞ্চলে মানুষ  করেছেন।কনের-দাদু,এঅঞ্চলের ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট  ছিলেন, বেশ প্রভাবশালী ;তিনিই কনের বাবাকে, বর্ধমানের  অজ-পাড়াগাঁ থেকে
নিয়ে এসে,এঅঞ্চলের হেলথ্-সেন্টারের
দায়িত্ব তুলে দেন ;এখন অবশ্য রিটায়ার্ড হয়ে,অঞ্চলেই চেম্বার  করে প্রাকটিস  করছেন।
      এল-এম-এফ ডাক্তাররাই,গ্রাম বাংলার  ভরসা;ডাক্তার  হিসেবে বেশ সুনামও আছে। গ্রাম বাংলার গরীব  মানুষ ডাক্তার বাবুকে,খুচরো আটআনা-এক টাকা পর্যন্তও দিয়ে থাকে,ডাক্তার বাবুরাও তা সানন্দে  গ্রহন করে থাকেন।বিকাল বেলায়  বাঁধা রিক্সা করে কলে-এ  গিয়ে থাকেন;  একদিন  রিক্সা করে গ্রামের পথে গিয়ে,রিক্সা উল্টে ডানপায়ে আঘাত  পান;সেই  থেকেই  ডান পা আর মুড়তে পারেন না। একজন অভিজ্ঞ  কম্পাউন্ডার  আছেন,তিনিও ঐ হেলথ-সেন্টার থেকে অবসর নিয়ে,তাঁদের  ডাক্তার বাবুর সঙ্গেই  আছেন।চেম্বার সংলগ্ন  অন্য একটা ঘরে অষুধ  (মিক্সচার) তৈরি করে,শিশিতে লেবেল লাগিয়ে রোগীকে   কীভাবে খেতে হবে, তার নির্দেশ দিয়ে থাকেন;অর্থ না থাকুক, অঞ্চলের  মানুষ  ভগবান  বলেই মেনে থাকে;তাঁর ছোট মেয়ের বিয়ে,সুতরাং,কনে-পক্ষের লোক সমাগম একটু বেশি  হওয়াই  স্বাভাবিক। গত দু’বছর আগে, ওনার  মেজমেয়ের বিয়ে হয়েছে;মেজ-মেয়ের বিয়ের  দিনের ঘটনাবলীর স্মৃতি এখনও লোকের  মুখে মুখে ফেরে।অঞ্চলটা,ইউনিয়ন বোর্ডের  অধীন হলেও,রাজীবদের মিউনিসিপ্যালিটির  গা ঘেঁষে অবস্থান, স্কুল,কলেজ,ব্যাংক, সবই আছে; বেশ বর্ধিষ্ঞু অঞ্চল, মাঝখান  দিয়ে বহে গেছে কুন্তী নদী,বড় বড় নৌকো ঘাটে থাকে ভেড়ানো—ব্যবসার কেন্দ্র -স্থল,একটা গঞ্জ।সামনেই  জিটিরোড ও তার  পাশেই  রয়েছে জেলার  সদর  থানা(পুলিশ)।
    রাজীবদের বাস এসে গেছে।কনের মামার  দল ও  ছোটকাকা বরযাত্রীদের  সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে বরাসনে পৌঁছে দিয়েছে। বরযাত্রীরা কেউই  বদ্-যাত্রী নয়, প্রায় সবাই  স্কুল-কলেজের ছাত্র;নিজেরাই   কনে-যাত্রীদের
সহযোগিতায় তৎপর হয়ে টিফিন ও চা খেল;জামাই দা’র অনুমতিতে বরকে বিয়ের আসরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সজীবের ডাঃ শ্বশুর মশাই, ডান পা-টা লম্বা ছড়িয়ে,বাঁ পা মুড়িয়ে বামুনের কথামত,সব অং বং চং ,শাস্ত্রীয় বচন আউরিয়ে চলেছেন;মাঝে,মাঝে সজীবও কিছু বলছে বলে মনে হচ্ছে।
বিয়ের  আসরে,শ্বশুর  মশাই ‘র  এই পা ছড়িয়ে থাকা নিয়ে,দু’বছর আগে ওনার  মেজ-মেয়ের বিয়েতে বর্ধমানের  বরযাত্রীদের  অসভ্যতার কথা ও খাওয়া-দাওয়ার পর তাদের কীভাবে আপ্যায়ন,  গ্রাম লোকেরা করেছিল,তা আজও লোকের  মুখে মুখে ফেরে।স্বাভাবিক ভাবেই, লোকে,রাজীবদের  ব্যবহারে মুগ্ধ  হয়ে.সব ঘটনা ব্যক্ত করলো; রাজীব ও ওর বন্ধুর দল,বলে,’ওরা ছিল বদ্-যাত্রী’,বরযাত্রী নয়,এখনো দেশে শরৎচাটুজ্জ্য মশাই ‘র
পল্লীসমাজের চিত্র  ফুটে উঠছে,শুনে বিস্মিত। রাজীবের  প্রায় সমবয়সী, কনের এক মামাকে  সবাই  ঘিরে ঐ মেজ-মেয়ের বিয়ের সময়কার ঘটনাবলী জানতে আগ্রহ  করলো।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *