কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) শম্পা রায় বোস

এবারের পুরী ভ্রমণ পর্ব ১০
(ভগবৎ গীতার কর্মযোগ শ্লোক ২৩ এবং ২৪)
বৃন্দাবনে এই পদটি সবাই গায়। একটা গানের খুবই বিখ্যাত কটা লাইন মোটামুটি সবার মুখেই শোনা যায়। প্রথম শোনার পর যখন এর অর্থটা খুব ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছিলাম,, মনের মধ্যে যেন গেঁথে গিয়েছিল।
লাইনে দাঁড়িয়ে জয় জগন্নাথ জয় জগন্নাথ শুনতে শুনতে আমার মনে পড়ে গেল এই গানটা। সত্যিই তো যাহা বৃন্দাবন তাহাই জগন্নাথ ধাম।
আজ সেই অসাধারণ গানটা দিয়ে শুরু করছি আমার জগন্নাথ দর্শন এর অভিজ্ঞতা।
বৃন্দাবনবাসী খুব ভালোবেসে একটা কথা বলেন ,,,,
মিলনেসে যাদা মজা পুকার নে মে হ্যায়।
বৃন্দাবন মিলনে কি ধরতি নেহি,, বৃন্দাবন তো ভগবান কো পুকার নে বালি ধরতি হ্যায়।।
ওঁরা ব্রজভূমিতে যে গানটি করেন,,,
“” কানাহাইয়া কানাহাইয়া পুকারা করেঙ্গে,,
লতাওমে ব্রজকি গুজারা করেঙ্গে।
রুঠেঙ্গে হামসে ওঅ বাঁকে বিহারী,, তো চরণপর উনহে হাম মানায়া করেঙ্গে।।
#####
লাইনে দাঁড়িয়ে জয় জগন্নাথ ধ্বনি শুনতে শুনতে মনে হল সত্যিই তো দেখা হওয়ার থেকেও ডাকার আনন্দটা যেন বেশি। এই যে সারাদিন ধরে প্রভুকে ডাকছি, দেখা তো হয় কয়েক মিনিটের,, সেও অবশ্য অসম্ভব আনন্দের, তৃপ্তির কিন্তু ডাকলে যেন বেশি ভালো লাগে। কেমন চোখ বন্ধ করে তাঁর সঙ্গে এই যে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা! আমার দুঃখ কষ্ট আনন্দ সুখ আমার উৎকণ্ঠা সব যে তাঁর সঙ্গে ভাগ করে নিই কত সাহস পাই কত শান্তি!
মনে হয় এই তো আমার অন্তত একজন আপনজন আছে যাঁর কাছে আমি আমার সবটা বলে হালকা হতে পারি। এবং নিশ্চিন্ত হতে পারি,, যে কথা তাঁকে বললাম তার একটাও বাইরে বেরুবে না।
হুটোপুটি মারামারি করে তাঁর সামনে গিয়ে পড়লে শুধু দুচোখ ভরে তাঁকে দেখে নাও আবার কবে এইভাবে দেখা হবে কে জানে! কিন্তু তাঁর সঙ্গে কথা চলতে পারে সর্বক্ষণ। আজীবন আমার মতো করে তাঁকে ডাকতেই পারি।
এই যে এত হাজার হাজার ভক্ত তাঁকে কাতর হয়ে ডাকছেন আহা কি মধুর সেই ডাক!
এই ডাকটা শোনার মধ্যেও যেন কত শান্তি কত স্বস্তি কত আনন্দ কত পরিপূর্ণতা ,,কত ভালোলাগা ছড়িয়ে থাকে। লাইনের খাঁচায় দাঁড়িয়ে আমিও সমানতালে জয় জগন্নাথ বলতে থাকি। পাঁচ সাত মিনিট দাঁড়ানোর পরই আবার শুরু হয় জয়অঅঅঅ জগন্নাথঅঅঅঅঅঅ।
যেন প্রভুকে বলা হচ্ছে প্রভু আমরা ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি,, ঠেলাঠেলি ঝগড়াঝাঁটি,,, পায়ের ব্যাথা,, গরমে, ভয়ে বাচ্চাদের কান্নাকাটি। একটা যেন হুলুস্থূল কাণ্ড।
প্রভু আমাদের লাইন ছাড়ো। আমরা যেন যেতে পারি তোমার কাছে। আমাদের আর তর সইছে না। পাঁচ দশ মিনিটের অপেক্ষা যেন মনে হয় কত যুগ কেটে গেল!
হে প্রভু লাইন ছাড়ো আমরা যাই তোমার কাছে। চারিদিকে কী আকুল আবেদন কী আকুল প্রার্থনা ঠাকুর দয়া কর আমাদের যেতে দাও,,,,,
এমন অবস্থা প্রতিবারই হয় দুবার চারবার জয় জগন্নাথ বলে চিৎকার করলেই প্রভু ঠিক শুনতে পান। সঙ্গে সঙ্গে লাইনও চলতে শুরু করে। সবথেকে অসহ্য লাগে যখন একেবারে খাঁচার শেষে গিয়ে আটকে যাই। কি যে ছটফট করতে থাকে মনটা! আর একটু ভগবান আর একটু,, এইটা পার করলেই মূল মন্দিরের চাতালে,, আর চার পা এগোলেই সিঁড়ি। আর সিঁড়িতে পা রাখা মানেই তরতরিয়ে এক পলকে মন্দিরের ভেতরে। এই সিঁড়িটা ওঠার সময় অত কসরত করে উঠতে হয় না। লোকেদের ঠেলায় বিনা পরিশ্রমেই ওঠা যায়। এবার আমি অবশ্য একটা সাইড নিয়ে পাণ্ডা মশাই এর হাতটা ধরে খুব সাবধানে সিঁড়ি ভেঙেছিলাম।
পাণ্ডা মশাই দেখা হতেই এক গাল হেসে বলেছিলেন শম্পা দি তুমি পারবে যেতে? আজ খুব ভীড় সেকেন্ড স্যাটারডে (৮/৩/২০২৫)।
আমি বলেছিলুম,, আপনি এসেছেন আপনি ঠিক আমায় পৌঁছে দেবেন প্রভুর কাছে। বললেন,, তা ঠিক তোমার এত মনের জোর এত ভক্তি তুমি ঠিক পারবে দর্শন করতে।
জয় জগন্নাথ চলুন চলুন বাসুদেব দা এগিয়ে যাই। দর্শন তো করবই এত যুদ্ধ করে, এত কষ্ট করে যখন এসেছি,, বলেই তাঁর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। যতবারই জগন্নাথ দর্শনে যাই তাঁর হাত আমি ধরবই।
আমি মনে করি তাঁর হাত ধরা মানেই আমার প্রভুর হাত ধরা। কারণ উনি জগন্নাথ দেবের পাণ্ডা। আমার মহাপ্রভুর সেবা করেন। মঙ্গলবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ভোগের দায়িত্বে থাকেন। এছাড়া জগবন্ধুর সাজুগুজু পোষাক পরিধানের দায়িত্বেও আছেন। তাঁর হাতে স্বয়ং ভগবানের স্পর্শ লেগে থাকে। তাঁকে ছুঁলেই আমার কেন জানি না গায়ে কাঁটা দেয়। আমার প্রভুর গায়ের গন্ধ পাই।
তাই আমার পাণ্ডা মশাই আমার খুবই প্রিয় একজন।
তাঁর কাছ থেকে মহাপ্রভুর নানা গল্প আমি বেশি বেশি শুনতে পাই। তিনি বলেনও খুব সুন্দর করে। বলতেও ভালোবাসেন। তাঁর বলার মধ্যে খুঁজে পাই প্রভুর প্রতি তাঁর ভালোবাসা আদর সম্মান। বিশেষ করে প্রভুকে এঁরা এত যত্ন করেন,, প্রভুকে এত বোঝেন প্রভুর সুবিধে অসুবিধে এতটা অনুভব করেন যেন মনে হয় ঘরের কোন আপনার কেউ।
মহাপ্রভুর ভালোলাগা খারাপ লাগা মন খারাপ সবকিছু কত সুন্দর করে যে বোঝেন এই সব পাণ্ডা মশাইরা বলে বোঝাতে পারব না। শুধু পাণ্ডা মশাই নন গোটা পুরী শহরের মানুষ অসম্ভব ভালোবাসেন জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা কে। তাদের কাছে দেবতা মানেই মহাপ্রভু।
আমি স্বর্গদ্বার বাজার, মন্দিরের সামনের দোকানপাটে যাই। কিনি না কিনি একটু ঘুরে বেড়াই। নেড়ে চেড়ে দেখি নতুন কিছু চোখে পড়লে।
চেনা দোকানীর সঙ্গে কথা বলি গল্প করি। শহরের হালচাল জিজ্ঞেস করি। জগন্নাথের কথা জিজ্ঞেস করি কারণ কার কাছ থেকে কি তথ্য পাওয়া যায় বলা তো যায় না। তাদের কথা শুনে ভাবি,, এরা যে মহাপ্রভুকে কী অসম্ভব ভালোবাসে অন্ধ বিশ্বাস করে ভাবা যায় না । প্রত্যেকে। এদের মধ্যে কী একতা বাপরে বাপ!
###
আমাদের মহাপ্রভুর কোন ঝামেলাই নেই বুঝলে শম্পা দি। লাইনে দাঁড়িয়ে শুনছি পাণ্ডা মশাই এর কথা।একটু শুধু খেতে ভালোবাসেন কিন্তু সেরকম খাওয়ারও কোন উৎপাত নেই এত সাধারণ ভোগ উনি পছন্দ করেন কি বলব। আমার কান খাড়া হয়ে গেল। ঐ ভীড়ের মধ্যেই জিজ্ঞেস করলুম খুব সকালে প্রভুর ভোগ কি হয়?
সেরকম বিশেষ কিছু নয়। সকালে প্রভু আগের দিনের জল ঢালা ভাত,,মানে পান্তা ভাত? প্রভু পান্তা ভাত খান ? হ্যাঁ শম্পা দি আগের দিনে রাতে ভোগ হওয়ার পর ভাত তো বাঁচেই। সবার ঘরেই বাঁচে। প্রভু পান্তা ভাত একটু ঘি মাখিয়ে কচু ভাজা দিয়ে খান। শুনে আমার এত ভালো লেগেছিল কী বলব।
কী সাধারণ আমাদের মহাপ্রভু। যেন মনে হয় আমাদের মতোই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো অত্যন্ত সাদামাটা জীবন তাঁর। আহা সকাল সকাল কাউকে কোন ডিস্টার্ব করেন না। একটু কচু ভাজা করতে কি আর পরিশ্রম। এমন মাটির কাছাকাছি ভগবান কোথায় আছে? যাঁকে দেখলে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় দুপুরে এত রোদে এসেছ আচ্ছা দাঁড়াও একটু পাখার বাতাস দিই। একটু জল বাতাসা দিই। দুটো পান্তা খাবে নাকি গন্ধরাজ লেবু দিয়ে পেটটা ঠান্ডা হবে। তোমায় খুব পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে কাজের চাপ বেড়েছে খুব? একটু যেন রোগা হয়ে গেছ! আহা ধুতিটাও তো পরেছ আধময়লা। নিজের দিকে তাকাও ঠাকুর নিজের যত্ন নাও। শরীর খারাপ হয়ে যাবে তো!
সারাদিন দর্শন আর দর্শন । দিনরাত বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছ। চোখের পাতাও তো নেই। পলক ফেলো না। সারা বিশ্বের দেখভাল নিজের কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছ চোখ খুলে। মাঝে মাঝে আরামের জন্য চোখে কর্পূর দিচ্ছ। আচ্ছা কর্পূর দিলে কী সত্যি সত্যি চোখের আরাম হয়? ঠাণ্ডা হয় চোখ? কত কষ্ট তোমার। চোখ ব্যথা করে না?
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের সকলের দুঃখ দুর্দশার কথা শোন,,,এটা চাই ওটা চাই ,,মানত করে গেলাম ঠাকুর কাজটা যেন হয়ে যায়। আবার এসে পুজো দেব। এত কাজ এত কাজ ,,সারা বিশ্বের মানুষের সবার ভালো রাখার কাজ তোমার ক্লান্ত লাগে না?
আমরা সবাই আমাদের কর্মফল ভোগ করছি সেখানেও এসে তোমার কাছে অভিযোগ জানাচ্ছি। আমার কেন এমন হল আমার কেন অমন হল,,,
জানি না ঠাকুর হিসেব মেলাতে পারি না। তোমার তো সাধারণ মানুষের থেকেও কষ্টের জীবন। তুমি তো রাজাধিরাজ গোটা বিশ্বকে চালনা করছ।
তোমার এত কর্ম করার কী প্রয়োজন?
সেখানেও তুমি কী সুন্দর করে বলেছ। বুঝিয়ে দিয়েছ কর্ম রাজাকেও করতে হয়। কারণ প্রজা রাজাকে অনুসরণ করে।
তুমি বলেছ ভগবৎ গীতার কর্মযোগ অধ্যায়ে,,
যদি হ্যহং ন বর্তেয়ং জাতু কর্মণ্যতন্দ্রিতঃ।
মম বর্ত্মনুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।। ২৩
হে পার্থ আমি যদি অনলসভাবে কর্তব্যকর্মে প্রবৃত্ত না হই ,, তবে আমার অনুবর্তী হয়ে সমস্ত মানুষই কর্মত্যাগ করবে।
উৎসীদেয়ুরিমে লোকা ন কুর্যাৎ কর্ম চেদহং।
সঙ্করস্য চ কর্তা স্যামুপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ।। ২৪
আমি যদি কর্তব্যকর্ম না করি,, তাহলে সমগ্র জগৎ উৎসন্ন হবে। আমি বর্ণসঙ্কর সৃষ্টির কারণ হব। এবং তার ফলে সমস্ত প্রজার শান্তি বিনষ্ট হবে।
এখানে বর্ণসঙ্কর অর্থ হল সেই ধরনের অবাঞ্ছিত জনগণ,,যারা সাধারণ সমাজের শান্তি বিঘ্নিত করে। উৎসন্ন অর্থাৎ ধ্বংস প্রাপ্ত হওয়া,, বিনষ্ট হওয়া।।
লাইন এগোতে লাগলো আমিও চললুম আমার জগুদাদার দর্শনে।
জয় জগন্নাথ ❤️