কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) নীলম সামন্ত – স্বাদকাহন

স্বাদকাহন, চিকেন চেট্টিনাড
বর্তমান বাঙালির রবিবার মানেই বেশিরভাগ রান্নাঘর থেকে ভুরভুর করে বাতাসে মিশে যায় মুরগী কষার সুবাস। শুধু বাঙালি বলব না, প্রবাস জীবনে দেখেছি ভারতবর্ষের নানান রাজ্যের লোকজনেদের এই একই রুটিন৷ তবে আমার রান্নাঘর সব সময়ই ব্যতিক্রমী৷ রবিবার মানে আমার সপ্ত ব্যঞ্জন, দু তিন রকমের মাছের পদ অন্তত এক খানা কাতলা মাছের মাথা চিবিয়ে দুপুর জয়৷ কিন্তু হয় কি, পাশের বাড়ি থেকে যখন হরেক রেসিপির মাংসের গন্ধ আসে, জিভে জল না এসে পারে না ! ফলে চিরাচরিত মুরগির মাংস নিয়ে আমাদের মতো রন্ধণশিল্পীর পরীক্ষার কোন সীমা পরিসীমা নেই৷
আমাদের ছোটবেলায় যদিও এইসব ছিল না। তখন মাংস রান্না হত বছরে বিশেষ বিশেষ উৎসবের দিনে, আর বাড়িতে কোন অতিথি এলে। মুরগি কেটে আনার চল পরের দিকে হয়েছে। জ্ঞান পড়ার পর দেখেছি গোটা মুরগি বাড়িতেই মারা হত, আমার ছোট কাকু তার বিশেষ ছুরি শাণিয়ে রাখতেন৷ বাড়ির ছোটরা মুরগি মারা দেখতাম না তবে যখন কাটা হত বড় গামলা হাতে ধরে পৌঁছে যেতাম। খামারের এক ধারে গোল হয়ে বসে দেখতাম কিভাবে মুরগি কাটা হয়। সেদিন আমাদের পড়াশুনো অলিখিত নিয়মে বন্ধ থাকত। মাংসের পিছু না ছাড়া কচিকাঁচাদের ভিড়ে আমিও খামার শেষে পুকুর ঘাট থেকে উনুন গোড়া কোথাও বাদ যেতাম না। তবে এতো পরিদর্শক হয়ে বিশেষ লাভ হয়নি কারণ প্রথম যেদিন মাংস রান্না করেছিলাম কিভাবে যেন পুড়ে গেছিল। যদিও বাড়ির আদুরী হিসেবে কেউ কিছু মনে না করে আনন্দেই খেয়ে নিয়েছিল।
পরে গৃহিণী চরিত্রে যখন হেঁশেলের দায়িত্ব পুরোপুরি কাঁধে বর্তালো তখন পোড়াপুড়ির জায়গা নেই৷ উপায়ও নেই৷ যে সমস্ত জায়গায় নিয়মিত মাছ পেতাম না সেখানে মাংস আর ডিমই সঙ্গী৷ বাঙালিরা যে আমিষ পদ ছাড়া ভাত, রুটি গলাধঃকরণ করতে পারে না তা আর আলাদা করে কি বলব! নিয়মিত মুরগির লাল ঝোল বা কষা রান্না করে যখন ক্লান্ত হয়ে গেলাম তখন শুরু করলাম নানান রেসিপির খোঁজ৷ উত্তর থেকে দক্ষিণ। ইউটিউব, গুগুল, ব্লগ ইত্যাদির বিপুল প্রচলন না থাকলেও যেটুকু ছিল তাতে করে অনেকটাই শিখেছিলাম ৷ উত্তরের ইতিহাসই আমরা মূলত পড়েছি৷ ফলে তাদের জীবনযাপন খাবার দাবারের ধরণ আমাদের কাছে বেশ পরিচিত। কিন্তু ভারতের দক্ষিণ ভাগ যে কোন ভাবেই পিছিয়ে নেই স্বাদে গন্ধেও তা এই মাংসের রেসিপি খুঁজতে গিয়ে জেনেছিলাম। দক্ষিণ ভারতীয় রান্না মানেই তেঁতুল, নারকেল এসবের ব্যবহার৷ কিন্তু সবই যে একই রকম খেতে তা একেবারেই নয়৷ আলাদা আলাদা স্বাদের কারণটা অবশ্য একই — বাণিজ্য বিস্তার কিংবা বৈদেশিক প্রভাব৷
ভোজনরসিক মানুষরা অবশ্যই জানেন, আমাদের পরিচিত অনেক খাবারই আছে যার নামকরণ করা হয়েছে কোন একটা জায়গার নামের সাথে জুড়ে ৷ এই যেমন, আগ্রা পেঠা, মুম্বাই বড়াপাও, মাইসোর পাক, বিকানেরি ভুজিয়া ইত্যাদি। চিকেন চেট্টিনাডও সেই রকমই এক রান্না। হ্যাঁ চেট্টিনাড আসলে কোন রন্ধনপ্রণালীর নাম নয়।এটি দক্ষিণ ভারতের বৃহত্তর তামিল সম্প্রদায়ের মধ্যে নাট্টুকোত্তাই চেট্টিয়ার্স বা নাগরথরদের উত্তরাধিকারের একটি উপাধি, যারা ইতিহাসের প্রাচীনতম বাণিজ্য দক্ষতার জন্য পরিচিত। বর্তমান তামিলনাড়ুর শিবগঙ্গা জেলায় প্রায় তিয়াত্তরটি গ্রাম জুড়ে এদেরই উত্তরাধিকারীদের বসবাস৷ প্রথমবার এই রন্ধনপ্রণালীর উদ্ভাবন হয়েছিল শিবগঙ্গা জেলার এই চেট্টিনাড সম্প্রদায়ের মধ্যেই ৷ দক্ষ ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে চেট্টিনাড মানুষেরা বিদেশের নানান জায়গায় থেকেছেন৷ এবং সমস্ত জায়গারই রান্নার ও খাবারের প্রভাব বয়ে এনেছেন দেশের মাটিতে। হুবহু রান্না না করে নিজেদের স্বাদ অনুযায়ী গড়ে নিয়েছেন নতুন রেসিপি আর সেটাই চেট্টিনাড হিসেবে আজও খাদ্য দুনিয়ায় খ্যাত।
ব্যবসার কাজে তারা প্রায়শই যেতেন শ্রীলঙ্কা, বার্মা, মালয়েশিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি নানান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে। এর ফলে তাদের নিরামিষ, আমিষ উভয় রান্নাতেই পাওয়া যায় পাওয়া যায় পেনাং-এর স্ট্রেইটস চাইনিজ রান্নার প্রভাব, লাওস ও ভিয়েতনামের ঔষধিগুণে ভরপুর উপাদান, আর উপনিবেশিক শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ ধর্মভিত্তিক খাদ্যসংস্কৃতির ছাপ। এমনকি হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিস্টান সংস্কৃতিরও গভীর প্রভাব দেখা যায়। আরেকটি বড় প্রভাব এসেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে—যখন অনেক ব্রিটিশ খাবার ভারতীয় উপাদান অনুযায়ী রূপান্তরিত হয় তখন গড়ে তোলে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বা “বাটলার কুইজিন”-এর নিজস্ব একটি ধারাকে। সে সময় ব্রিটিশ ও ধনী চেট্টিয়ার পরিবারের রাঁধুনিরা বা সহকারী কর্মচারীরা “বাটলার” নামে পরিচিত ছিলেন, এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বোধকরি খাবার বা রন্ধনপ্রণালীও বিনিময় হত।
চেট্টিনাড রান্নার বিশেষত্ব হলো, খাবার টেবিলে সবসময়ই ঝাঁঝালো পরিবেশ তৈরি করে। যদিও রন্ধনপ্রণালী অস্বাভাবিকভাবে সুক্ষ্ম ও সুগন্ধযুক্ত। কারণ শতাব্দী প্রাচীন মশলা বানিজ্যে এই চেট্টিয়া বা চেট্টিনাড সম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ। বলা যায় তাদের ব্যবসায় ঐতিহ্যপূর্ণ ফলাফলই হল রন্ধনপ্রণালী। লেখক গাই ট্রেবে বাঙ্গালা টেবিল: ফ্লেভার অ্যান্ড রেসিপিস ফ্রম চেট্টিনাড” নামক বইতে উল্লেখ করেছেন,”কোচিন এবং পেনাং, বান্দা দ্বীপপুঞ্জ, হরমুজ প্রণালীর আরব বন্দরের মতো জায়গা থেকে ঝাঁঝালো বীজ, ফল এবং বাকলের বিশ্বব্যাপী আমদানি ও রপ্তানি। দক্ষিণ ভারতীয় রান্নার প্রধান উপাদান নারকেল, চাল এবং ডাল জাতীয় খাবারের সাথে তারা তেলিচেরি মরিচ, সিলন এলাচ, ইন্দোনেশিয়ান জায়ফল, মাদাগাস্কার লবঙ্গ এবং লাওস এবং ভিয়েতনাম থেকে আসা নীল আদা বা গালাঙ্গাল যোগ করে। পেনাং-এর মতো জায়গায়, যা এখন মালয়েশিয়ায় অবস্থিত, চেত্তিয়াররা স্ট্রেইটস চাইনিজ রান্নার মিষ্টি-টক স্বাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল, [ sic ] সাইগনে, তারা তাদের রন্ধনপ্রণালীকে এমনভাবে রূপান্তরিত করেছিল যাতে ভিয়েতনামী খাবারে সুগন্ধি যোগায় এমন ভেষজ পদার্থ শোষণ করা যায়।”
চিকেন চেট্টিনাড হল চেট্টিনাড়ের সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় একটি পদ: মিলাগু মসলা কোঝি, বাংলায় চিকেন চেট্টিনাড় পেপার মশলা। এই পদটিকে “চেট্টিনাড় রন্ধনশৈলীর পতাকাবাহী”ও বলা হয়। স্বাদ ও গন্ধের মাত্রা প্রমাণ করে কথাগুলো কোনভাবেই ভুয়ো নয়। ঝাঁজদার মশলার আসল আকর্ষণ হলো — কালো গোলমরিচ ও লাল শুকনো লঙ্কা। এখানে গোলমরিচ ‘নম্বিং হিট’ তৈরি করে। মশলা এতটাই গাঢ় ও তীব্র যে রান্নার শেষে ঝলমলে গাঢ় রঙের একটি ঘন গ্রেভি তৈরি হয় — তবে খেতে এক কথায় অসাধারণ! রান্নার আরও কিছু বিশেষ উপকরণ যা রান্নাটিকে আলাদা মাত্রা দেয় তা হল,
নারকেল—ভাজা করে বেটে নেওয়া। তেঁতুল— রান্নায় টক-মিষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখে। এছাড়াও ব্যবহৃত অন্যান্য মশলাগুলো বেশিরভাগই শুকনো অবস্থায় সেদ্ধ বা ভেজানোর আগে শুকনো কড়ায় তেল ছাড়া ভেজে নিয়ে বেটে নেওয়া হয়। আর মাটির পাত্রে রান্না হওয়ার জন্য পদটির গায়ে যে মেঠো গন্ধ জড়িয়ে থাকে তা নিয়ে আলাদা করে আর কিই বা বলব।
তামিলনাড়ু উপকূলীয় অঞ্চল বলেই এখানকার রান্নায় নারকেলের প্রভাব বেশি দেখা যায় কারণ উপকূলবর্তী অঞ্চলে নারকেলের ফলন বেশি। আর জলবায়ু হিসেবে চেট্টিনাডদের জন্য নারকেল বেশ উপকারীও৷ শুধু নারকেল নয়, তেঁতুলও তাই। হজম ক্ষমতাই শুধু বৃদ্ধি করে এমন নয় শরীর ঠান্ডা রাখতেও সাহায্য করে। তাহলে একথা স্পষ্ট যে সংস্কৃতির পাশাপাশি ভৌগোলিক অবস্থান একটা রান্নাকে উপযুক্ত করে তোলে এবং মৌলিক পরিচিতিও দেয়৷
আঞ্চলিকতা ও আন্তর্জাতিকতা একে অপরের হাত ধরে যত রকমের খাবার তৈরি করেছে তার মধ্যে চিকেন চেট্টিনাড যে অন্যতম তা আর আলাদা করে বলার জায়গা থাকে না। আমার মতে এই রান্না কেবল মাত্র চেট্টিনাড সম্প্রদায়ের খাদ্যসংস্কৃতির পরিচয় নয়, মশলা বানিজ্যের ইতিহাসে নিজের জন্য পাকাপোক্ত জায়গা করে নেওয়া খাবারগুলির মধ্যে অন্যতম।