অথ শ্রী উপন্যাস কথা-তে সুতনু হালদার – ধারাবাহিক (অন্ধকারের উৎস হতে)

(নয়)

অনন্যারা থানায় আসার পরেই, অনিমিখকে থানায় আসার জন্য ফোন করে ডেকে পাঠানো হয়। অনন্যা তখন ফোনে অনিমিখের সঙ্গে কথাও বলে। পুলিশ অফিসারটি অনিমিখকে থানায় এসে অনন্যাকে নিয়ে যেতে বলেন। অনিমিখ যথাসম্ভব তাড়াতাড়িই থানায় যাবার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল। যাবার আগে ব্যাপারটা জানানোর জন্য রাজর্ষিকে ধরল, রাজর্ষি জানালো, বিষয়টা সেও এইমাত্র শুনেছে। সে নিজেই অনিমিখকে ফোন করত, কিন্তু তারমধ্যেই অনিমিখের ফোন তার কাছে আসে। অনিমিখ দ্বিতীয় ফোনে সমাপ্তিকেও ব্যাপারটা জানিয়ে রাখল।
থানার ভেতর কিছু না বললেও, অনিমিখ সারা রাস্তাতে বারবার অনন্যার কাছে তার অপহরণের ব্যাপারে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞাসা করছিল। একসময় অনন্যা প্রায় ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘এক কথা কতবার বলব অনি? ছেলেটা আমার পরিচিত, কিন্তু একটা কুড়ি-বাইশ বছরের ছেলে, এতটা ডেসপারেট হয়ে এসব করবে, কখনও ভাবতেও পারিনি। তাছাড়া আমাকে অপহরণ করার মতো কোনো কারণও ছিল না।’
-‘কিন্তু…, মানে, একটা কথা জানতে চাইছি, ছেলেটা ওখানে এতদিন তোমাকে একা পেয়ে কোনও মিস বিগেভ টিহেব করেনি তো?’
-‘ মিস বিহেভ বলতে?’
-‘আরে! মিস বিহেভ বলতে আবার কী! মিস বিহেভ মানে মিস বিহেভ…’
-‘মানে ছেলেটা আমাকে রেফ বা মলেস্ট এসব কিছু করেছে কিনা জানতে চাইছ? তাই তো?’
-আরে! বুঝছ না কেন? এসব ছেলেরা বাপের খায় আর বনের মোষ তাড়ায়। এদের এমন চাবগানো দরকার… আমি তো ভাবছি, অ্যাডভোকেট রায়কে এই কেসে আমার হয়ে লড়তে বলব। তাই জানতে চাইছিলাম। উনিও তো কিছু জানতে চাইতে পারেন।’
-‘ না। তেমন কিছু করেনি।’ অনন্যা একটু কঠিন স্বরেই অনিমিখকে কথাটা বলল।
অনিমিখ হেসে উঠে বলল, ‘তাহলে তো বলতে হয়, ছেলেটা তোমার সঙ্গে গল্প করার জন্য এতটা রিস্ক নিয়েছিল। স্ট্রেঞ্জ!’
-‘কীসের স্ট্রেঞ্জ? ছেলেটার নাকি আমাকে বিয়ে করার সাধ হয়েছিল, তাই এই হটকারিতা।’
-‘এদের ফাঁসি দেওয়া উচিত। যতসব অ্যাবনরমাল এলিমেন্ট।’
অনন্যা অস্ফুটে একবার শুধু ‘হুম’ বলে গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে থাকল। অনিমিখও আর কোনও প্রশ্ন করেনি। একমনে স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে হাল্কা করে ‘তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা। ওই-যে সুদূর নীহারিকা যারা করে আছে ভিড় আকাশের নীড়, ওই যারা দিনরাত্রি’ গানটা চালিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোমার প্রিয় গান, শোনো।’ দু’পাশের পথ চিড়ে গাড়ি এগিয়ে চলল।
অনন্যা আর অনিমিখের থানা থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর আড়াইটে হয়ে গেল। রান্নাবাড়ি কিছুই করা নেই। বাড়ি ঢুকে অনন্যা গ্যাসের একটা ওভেনে ভাত আর আলু সেদ্ধ চাপিয়ে দিল, ওপরটিতে দুটো ডিম সেদ্ধ বসিয়ে স্নানে ঢুকে গেল। বাথরুম থেকে ফিরে এসে অনিমিখকে বলল, ‘স্নান করে এসো, রান্না প্রায় কমপ্লিট।’
অনিমিখ নিজের মনেই গজগজ করতে করতে বলল, ‘ব্যাটার ছেলেকে আমি দেখে নেব।’
অনন্যা একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কাকে দেখে নেবার কথা বলছ?’
‘কে আবার! ওই ছোকড়াটা। বাস্টার্ডটার কী যেন নাম?’
‘সৌমাল্য।’
-‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওই সৌমাল্য। আমি আজ সন্ধ্যেবেলায় অ্যাডভোকেট রায়কে মিট করছি। এমন ঝোলানো ঝোলাব না, বাছাধন জন্মের মতো টের পাবে।’
অনন্যা কিছু বলল না। গাড়ির মধ্যে থেকে শুরু হয়ে সে এই কথা অনিমিখের মুখে অনেকবার শুনলো। খাবার টেবিলেও অনিমিখ একই কথা বলল। অনন্যা বুঝতে পারছে এই ঘটনার যথাযোগ্য শাস্তি সৌমাল্যকে না দেওয়া অবধি, অনিমিখ ভেতরে ভেতর ছটফট করছে। পারলে এখনই সে নিজেই যেন রায় ঘোষণা করে আধঘন্টার মধ্যে সৌমাল্যকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দিতে প্রস্তুত।
খাওয়া দাওয়ার পর খুব ক্লান্তিবোধ হতে অনন্যা কিছুক্ষণ শুয়ে পড়ল। অনিমিখ পাশের ঘরে মৌজ করে সিগারেট খেতে খেতে টিভি দেখতে লাগল। কিন্তু কয়েক মিনিটের একটু আবল্যের পরেই অনন্যা ঝেড়ে মেরে খাটে উঠে বসল। আজ বিকেলে তার একবার বেরোনোর খুব দরকার। কিন্তু অনিমিখকে কী বলে ম্যানেজ করে বেরোনো যাবে, সেটা কিছুতেই মাথায় আসছে না!
সন্ধের বেশ কিছুটা আগে, অনিমিখের একটা ফোন এলো, তারপরেই অনিমিখ ‘একটু আসছি’ বলে বেড়িয়ে গেল। যাবার ঠিক আগে, দরজা লাগাতে এসে, অনন্যা জিজ্ঞাসা করল, ‘কখন ফিরবে?’ জবাবে অনিমিখ জানালো, ‘ঘন্টাখানিক লাগতে পারে।’
অনিমিখ বেরিয়ে যাবার পরে অনন্যা পরনের নাইটিটা ছেড়ে একটা সালোয়ার চাপিয়ে নিল, খুব হালকা প্রসাধনে বাড়ির বাইরে আসার জন্য প্রস্তুত হ’ল। অনেকদিন দিন পর, আজ আবার সে স্বাধীন। কিন্তু হাতে সময় খুব কম। মাত্র একঘন্টা। এরমধ্যে একটা জরুরি কাজটা সেরে বাড়ি ফিরে আসতে হবে। অনিমিখের ফেরার আগেই অনন্যা তার বাইরের কাজটি সেরে ফেলে বাড়ি ফিরে আসবে, এমন মনস্থির করে একটু চটপট বাড়ির দরজায় তালা লাগিয়ে রাস্তায় নেমে এলো। পাশের বাড়ির তৃষ্ণা বৌদির সঙ্গে সামনাসামনি দ্যাখা, সামান্য হাসি বিনিময় করেই অনন্যা কাটিয়ে বেরিয়ে গ্যালো। তৃষ্ণা বউদি বললেন, ‘আরে! অনেকদিন পরে দ্যাখা! কেমন আছো?’ হাঁটতে হাঁটতেই অনন্যা জবার দিল, ‘ভালো আছি বৌদি। আপনারা ভালো তো?’ বলার পর উত্তরের জন্য আর অপেক্ষা করল না। তবে তার মনে হ’ল ওই ভদ্রমহিলা হয়ত তার অপহরণের বিষয়ে কিছু জানেন না। জানলে এত সহজে সে মুক্তি পেত না। এই জায়গাটার একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হ’ল, এখানকার প্রতিবেশীরাও কেউ কাউকে তেমন পাত্তা দিতে পছন্দ করে না। সামনাসামনি দ্যাখাসাক্ষাৎ হ’লে কেউ কেউ একটু হাসি বিনিময় করে, কেউ কেউ সেই সৌজন্যটুকুরও ধার ধারে না। তারা নিজেরা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। প্রতিবেশীদের হাঁড়ির খবর তো দূর অস্ত, প্রতিবেশীদের সম্পর্কে কোনও আগ্রহই যেন কারোর নেই। অথচ তারা একই পাড়ায়, এমন কী পাশাপাশি বাড়িতে বছরের পর বছর কাটিয়ে যাচ্ছে! অবশ্য আজকাল এই প্রবণতা আমাদের রাজ্যে বেশ ভালোভাবেই শুরু হয়েছে। অনেক জায়গাতেই এমন ব্যবহার দ্যাখা যাচ্ছে। বিশেষত নতুন প্ল্যানড সিটিগুলো এই রকম মানুষজনকেই নিজের কোলে আশ্রয় দিয়েছে। এইসব জায়গার মানুষজন কেউই স্থানীয় নয়, অন্য জায়গা থেকে মূলত কর্মসূত্রে কিংবা স্বচ্ছল আর্থিক অবস্থার সুবাদে নিশ্চিন্ত ভোগ বিলাসিতা, সন্তানের ভালো পঠনপাঠনের সুযোগ সুবিধা পাবার প্রত্যাশায় এইসব জায়গাতে চলে আসেন। এরা প্রত্যেকেই আত্মমুখী চরিত্রের মানুষ। শুধু নিজের টুকু বুঝে নিতেই এরা ওস্তাদ। এদের পরবর্তী প্রজন্ম আরো আত্মকেন্দ্রিক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা চাকরি বা লেখাপড়ার সূত্রে রাজ্য বা দেশের বাইরে চলে যায়। ফলত এইসব অঞ্চলগুলোতে বয়স্ক মানুষের ভীড় উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।
অনন্যা পুরো মফস্বলের মেয়ে, সেখানকার পরিবেশ ছিল ভিন্ন। প্রথম প্রথম এই জায়গাটাকে মন থেকে তার মানিয়ে নিতে খুব অসুবিধা হত। কিন্তু সময় আস্তে আস্তে মানুষকে মনে না নিলেও মেনে নিতে শিখিয়ে দেয়। অনন্যাও মেনে নিল। এখান থেকে ত্রিশ মাইল দূরে একটা স্কুলে চাকরি পেল, নিজের একটা জগৎ ধীরে ধীরে গড়ে উঠল, প্রথম দিকের সেই অস্বস্তি ফিকে হতে হতে অনেকটাই মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটার থেকে মুছে গেল। কিন্তু মস্তিষ্ক থেকে মুছলেও অনেক অনুভূতি মনের অন্দর থেকে মোছে না। কখনও কখনও তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। যখন এমন অবস্থা হয়, তখন অনন্যার নিজেকে খুব অসহায় লাগে। বিশেষত যে মানুষটা তার পরম বন্ধু হতে পারত, সেই অনিমিখও ক্রমশই তার চেনার থেকে অচেনা মানুষ হয়ে যেতে লাগল। শুধুমাত্র সংসারকে টিকিয়ে রাখার জন্য অনন্যা, সবসময় অনিমিখের সঙ্গে কম্প্রোমাইজের পথে হাঁটে।
রাস্তাটা কিছুটা গিয়ে সোজা বড় রাস্তায় ধাক্কা দিয়েছে। বড় রাস্তা মানে জাতীয় সড়ক। এই চত্ত্বরে জাতীয় সড়ককে বড়রাস্তা বলে। জাতীয় সড়ক দিয়ে কিছু দূর এগোলেই সামনে একটা ওষুধের দোকান। অনন্যা এই দোকানটাতে ঢুকল না, বাড়ির খুব কাছের দোকান, যদিও এই জায়গাতে কেউ কারোর সাতেপাঁচে থাকে না। চেনা পরিচিতিও বিশেষ নেই বললেই চলে, তবুও অনন্যা মূলত বাড়ির কাছের দোকান বলে, সেই দোকানটাকে এড়িয়ে গিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। বেশ কিছুটা দূরের একটা ওষুধের দোকানে গিয়ে একটা আন ওয়ান্টেড সেভেনটি টু কিনল। সামনের একটা ষ্টেশনারী দোকান থেকে আরও কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরল। ঠিক তখনই তার স্কুলের একটি ছাত্রীকে দেখে তাকে ডাক দিল, ‘অ্যাই শ্রাবণী…;
মেয়েটিও তাকে দেখতে পেয়েছে। ম্যামের ডাক শুনে ম্যামের কাছে এলো। ওদের দেখে বোঝা যায়, ওদের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত বেশ মজবুত। শিক্ষিকাটিকে ছাত্রীটি বেশ পছন্দ করে, আর ছাত্রীটিও শিক্ষিকার খুব স্নেহের। ওরা দু’জনে গল্প করতে করতে বাড়ির পথে হাঁটা দিল। বেশ কিছুটা রাস্তা ওরা একসঙ্গে এসে, দু’জন দু’দিকের রাস্তা ধরল।
বাড়ির রাস্তা ধরে অনন্যা আরো দ্রুত পা চালালো। এর মধ্যে আবার অনিমিখ ফিরে এলো কিনা, কে জানে! ফিরলে আবার কোথায় গিয়েছিল, কেন গিয়েছিল, অনন্যা এইসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে। এটাকে সে কাটানোর জন্য একটু বেশি মাত্রায় সচেষ্ট। কিন্তু আজ না বেরলে তাকে খুব অসুবিধায় পড়তে হতে পারত। এমনিতেই এখন তার রিস্ক জোন, গতরাতে সৌমাল্যর কথায় ঝট করে মাথাটা এতটাই গরম হয়ে গিয়েছিল যে, কোনও রকম প্রোটেকশন নেবার কথা মাথায় আসেনি, তাছাড়া প্রোটেকশন নেবার কোনও উপায়ও তখন তার ছিল না। এটাও ঠিক। ওই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া, বিগত দেড়মাস কিছুই তার মাথাতে ছিল না। তাই আজ আন ওয়ান্টেড সেভেনটি টু কেনা ছাড়া অনন্যার বিকল্প কোনও রাস্তা নেই। মুশকিল হ’ল এইসব কথা অনিমিখকে বলা কঠিন। কারণ অনিমিখের মধ্যে একটা দ্বিচারিতা আছে। শুধু অনিমিখ কেন? এই ব্যাপারে বেশিরভাগ পুরুষই অনিমিখ হয়ে ওঠে। মুখের কথা আর মনের কথা মেলে না। ছ’বছরের সাংসারিক জীবনে অনিমিখকে ঘাটতে ঘাটতে আর বিভিন্ন বান্ধবীদের সাংসারিক অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে করতে, পুরুষ চরিত্রের এইসব অন্ধকারগুলো আজ অনন্যা খুব ভালো করে বুঝতে পারে।
ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *