হৈচৈ ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে রাজকুমার ঘোষ

বিট্টুর সঙ্গী

কমল কিছু বলতে পারেনি। সে বিট্টুর দায়িত্ব রত্নার উপর দিয়ে নিশ্চিন্তে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল।
এদিকে রত্নার কাছে বিট্টুর অবস্থা রীতিমত শোচনীয়…
বিট্টুর এমন অবস্থা! কিভাবে সে মুক্তি পাবে?… পড়ুন পরের পর্বে…
—————
বিয়ের পর রত্না কমলের অর্থাৎ নিজের সংসারে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। একে একে কমলের বাড়ি থেকে পুরনো কর্মচারীদের তাড়িয়েছে। বিট্টুর মামাবাড়ির দাদু-দিদার এ বাড়িতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। তারা বিট্টুর সাথে দেখা করতে আসলেই অপমান করত। তবুও দাদু-দিদা সেই অপমানের তোয়াক্কা না করেই বিট্টুর সাথে গোপনে দেখা করতেন। বিট্টুর স্কুলেও তারা যেতেন। রত্না নজর রাখার জন্য নিজস্ব উদ্যোগে লোক নিয়োগ করেছিল। নাতির সাথে কোনওরকম দেখা না করতে পারে, সে সরাসরি হুমকি দিয়েছিল,
“জেঠু-জেঠিমা তোমরা বিট্টুর সাথে দেখা করছ ঠিক আছে। কিন্তু বিট্টুর কোনও ক্ষতি হলে তার দায় তোমাদেরই নিতে হবে। ভেবে দেখো আমি কিন্তু অন্যরকম ব্যবস্থা নেবো”
বিট্টুর মামাদাদু ও দিদা ভয়ে আর আর নাতির সাথে দেখা করত না। রত্নার কাছে বিট্টুকে হেনস্থা করার সু্যোগ চলে এসেছে। বিট্টু, রত্নাকে একদমই পছন্দ করত না। সে বাড়িতে একাকী থাকে আর হরিদাদুর বলা গল্পগুলি তার মাথায় ঢুকে আছে। সেই গল্পগুলোতে বিভোর হয়ে থাকে। তবে হরিদাদুর কথাগুলো মনে করে,
“যখনই নিজেকে একলা মনে করবে, নিজের মায়ের কথা মনে করবে। আর ’যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’- এই গানটা মনে মনে গাইবে। আর শোনো, এই দুনিয়ায় সবাই একা। ঘরের ভেতর বা বাইরে, যেখানেই হোক, এই জগতে ভালো খারাপ অনেক মানুষই আছে। দেখবে একলা থাকার অভ্যাসের সাথে সঠিক পথ ঠিক খুঁজে পাবে, দাদুভাই। মনে সাহস নিয়ে এগিয়ে যাবে। কেউ একজন ঠিক তোমার পাশে চলে আসবে।”

এইভাবে কেটে যায় বেশ কিছুদিন। রত্না মনে মনে ভাবে, বিট্টু এই বাড়িতে থাকলে তার ইচ্ছা কখনোই পূর্ণ হবে না। নিজের সন্তান হোক, এমন ইচ্ছা ছিল। কমলকে নিজের ইচ্ছার কথা জানালে,
“তোমার সন্তান আছে তো, বিট্টু। শুধু আমি নই, তুমিও বিট্টুর জন্যই আমার সাথে বিয়ে করেছ। এই বাড়িতে তোমার সুখ-স্বাছন্দ্য সবই রয়েছে। আমি কাজের মানুষ। কোম্পানীর কাজে ভীষণ চাপে থাকি। তুমিই বিট্টুর মায়ের অভাব পূরণ করেছ। আমার আর কিছু চাইনা। বিট্টুকে মানুষের মত মানুষ করো। একদিন সেও আমার এই বিশাল কোম্পানীর দেখাশোনা করবে, এটাই চাইব”
রত্না, শুকনো হাসি হেসে বিট্টুর প্রতি আরও ক্ষিপ্ত হয়েছিল। সে নিজের কুটিল মনে স্বগোক্তি করল, “কিছুতেই নয়। বিট্টুকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেব। এই সম্পত্তিতে শুধু আমার অধিকার থাকবে। দরকার হলে আমার সন্তান এই সম্পত্তির অধিকার পাবে”
রত্না ঠিক করল, বিট্টুকে নানাভাবে জব্দ করবে। তবে, বিট্টু তার নতুন মা’র সাথে ভালোভাবে কথাই বলে না। নিজের মত করেই থাকে। একদিন রত্না বিট্টুর ঘরে এসে বলে,
“বিট্টু কি করছিস বাবা? আমাকে মা বলে কি ডাকতে ইচ্ছা করে না। দেখি, স্কুলে কি ছাই পড়াশোনা করছিস?”
রত্নাকে দেখেই বিট্টু চিৎকার করে ওঠে,
“তুমি একদম আমার ঘরে ঢুকবে না। তুমি ভীষণ দুষ্টু। আমি বাবাকে বলে দেব, তুমি আমার দাদু-দিদাকে এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছ”
“আমি যা বলব, যেভাবে বলব, যা যা করতে বলব, সেভাবেই শুনবি। তা না হলে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবো… এ বাড়ির সবকিছু আমার। তোর বাবা আমার কথা শুনে চলে, তুই আমার সম্পর্কে বাবাকে বললেও তোর বাবা কিছুই বিশ্বাস করবে না”
“একজন দুষ্টু মেয়ের সাথে আমি কথা বলতে চাই না। তুমি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাও”
“আচ্ছা। ঠিক আছে। আজ সারাদিন তোর খাওয়া বন্ধ। কে খেতে দেয়, দেখব?”
রত্না বিট্টুর প্রতি দুর্ব্যবহার করে। ওকে সারাদিন খেতে দেয় না। বিট্টুর খুব ক্ষিদে পায়। সে ফ্রিজ থেকে খাবার বের করতে গেলে রত্না ওকে আটকায়,
“তোর এত আস্পর্দ্ধা। শেষে চুরি করছিস? আজ আসুক তোর বাবা। অপেক্ষা কর। আজ তোর বাবার হাত দিয়ে তোকে মার খাওয়াব”
সেদিন রাতে কমল ফিরতেই রত্না বিট্টুকে কাছে টেনে আদর করে, মিথ্যে অভিমান করে বলে,
“আমার বিট্টুসোনা, আমার সোনা ছেলে। খুব ভালো পড়াশোনা করে। কিন্তু আমার কথা শোনে না। আমাকে মা বলে ডাকে না”
“বিট্টু! এ কি শুনছি। মা তোকে কত ভালোবাসে” – কমল বলল।
“আমি ওকে মা বলে কখনোই ডাকব না। এই মেয়েটা খুব দুষ্টু। তুমি জানো বাবা, এই মেয়েটা আমাকে ভালো করে খেতে দেয় না, আজ আমাকে খেতে দেয়নি। সবসময় ভয় দেখায় আমাকে। বাবা, তুমি একে তাড়িয়ে দাও”
বিট্টুর কথা শুনে কমলের মাথা গরম হয়ে যায়, “কি এত বড় বড় কথা, বেয়াদপ ছেলে!”
কমল হাতের সামনে থাকা একটি লাঠি দিয়ে খুব মেরেছিল বিট্টুকে। রত্না বিট্টুকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
“আমারই দোষ। আমি বোধ হয় ওর মা হতে পারিনি। আমিই চলে যাব বাড়ি থেকে। বিট্টুসোনা এতে ভালো থাকবে” – রত্না কাঁদতে লাগল।
কমল রেগে গিয়ে কড়া গলায় বলে, “তুমি কেন যাবে? গেলে ওকেই বোর্ডিং-এ রেখে দিয়ে আসব। খুব অসভ্য হয়ে গেছে দেখছি। তুমি কেঁদোনা প্লিজ। ওর এই ব্যবহারের জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি”
কমল, রত্নাকে ঘরে নিয়ে চলে যায়। ঘরে যাবার সময় রত্না বাঁকা চাহনিতে মৃদু হাসিতে বিট্টুকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিল, বজ্জাত ছেলে, দেখ তবে কেমন লাগে?

বিট্টু নিজের ঘরে চলে যায়। তার ঘুম আসেনা। সে তার মায়ের কথা ভেবে কাঁদতে থাকে। আজ রত্নার জন্য বাবা ওকে খুব মেরেছে। অভিমান করে বলে, “আমার বাজে বাবা। এই দুষ্টু মেয়েটা তোমাকেও ভালো থাকতে দেবে না”
বিট্টুর হরিদাদুর কথাগুলো মনে পড়ে। হরিদাদু যখন ওর সাথে ছিল তখন কতকিছু জেনেছিল। হরিদাদু আজ থেকে বছর চল্লিশ আগে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার পাশ করে জাহাজে চাকরি পেয়েছিলেন। চাকরি সূত্রে পৃথিবীর পাঁচ মহাদেশের নানা বন্দরে ও শহরে ঘুরতে ঘুরতে নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। সেই কাহিনি তিনি বিট্টুকে শুনিয়েছেন। তিনি প্রথমেই বর্ম্মাদেশে বর্তমান নাম মায়ানমারে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে সিঙ্গাপুর, চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া। অভিজ্ঞতা অর্জন করার পর তিনি আর একটা জাহাজ কোম্পানীতে চাকরিতে ঢোকার পর আমেরিকা, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, আরবের বিভিন্ন দেশে গিয়েছিলেন। এরপরও তিনি আর একটা বড় জাহাজ কোম্পানীতে চাকরি পেয়েছিলেন, তারপর ইউরোপের অনেক দেশ এবং মেক্সিকো, ব্রাজিল তারপর আফ্রিকা। সর্বশেষ ভ্রমণ করেছেন আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে। সেখানে তিনি শেষ বয়সে একটি কোম্পানীতে চাকরিতে জয়েন করে অবসর নিয়েছেন। তার বিশাল অভিজ্ঞতা তিনি বিট্টুর সাথে ভাগ করে নিয়েছিলেন। হরিদাদুর সাথে থেকে নানান কাহিনি মন দিয়ে শুনে বিট্টু মাথার মধ্যে রেখে দিয়েছে। তারও খুব ইচ্ছা হরিদাদুর মত সেও একদিন সারা বিশ্ব পরিভ্রমণ করবে।
কিন্তু এই বাড়িতে থাকলে তার এই ইচ্ছা কখনই পূর্ণ হবে না। সে ঠিক করল,
“আমার বাবা এখন আমাকে ভালোবাসে না। মা যখন এই বাড়িতে নেই, তখন আমিও এই বাড়িতে থাকব না। ঐ দুষ্টু মেয়েটা থাকলে আমার কিছুতেই জাহাজে চাকরি হবে না। আমিও হরিদাদুর মত ঘুরতে পারব না”
ভাবা মাত্রই বিট্টু বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। হরিদাদুর মোবাইল নাম্বার ও ঠিকানাটা সাথে নিয়ে নিল। রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমে গেল ওদের পাড়া থেকে একটু দূরে একটি শিশু উদ্যানের মাঠে। সেখানে একটি আচ্ছাদন করা লম্বা চেয়ারে বসে পড়ল। সেখানে বসে হরিদাদুর চাকরি পেয়ে প্রথমবার বার্মাতে যাওয়ার কাহিনিটি মনে করল। তারপর কখন যে চোখ লেগে গেল, বিট্টু জানেনা। বেশ কিছুটা রাত হওয়ার পর হঠাৎ ওর ঘুমটা মশার কামড়ে ভেঙে গেল। দেখল, হলুদ গেঞ্জী ও সাদা প্যান্ট পড়ে, মাথায় টুপি পড়া শীর্ণকায় একটা লোক ওর সামনে এসে বসে আছে। ওর দিকে ঠায় তাকিয়ে আছে। বিট্টুও অবাক হয়ে লোকটাকে দেখতে থাকল…
———————
কে এই লোকটা? … এরপর কি হবে? পড়ুন পরের পর্বে…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *