হৈচৈ ছোটদের গল্পে সুদীপ্ত পারিয়াল

শিবগ্রামে রণ কুনাল
আমাদের রেলস্টেশন শহীদ মাতঙ্গিনী থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে রামনগর বলে একটা স্টেশন আছে, সেখান থেকেও টোটোতে চেপে প্রায় ৮ কিলোমিটার গেলে শিবগ্রাম। একটা ছোট্ট গ্রাম্য অঞ্চল। সেখানে ৫০ বছরের পুরনো একটা মন্দির তথা আশ্রম আছে। সেই আশ্রমের বার্ষিক প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে আমাদের নাট্যদল বনফুলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সুধীর স্যারের সেই মর্মান্তিক হত্যার পর আমরা ভেবেছিলাম আমাদের নাটক করার সখ ঘুচলো। কিন্তু রণদা থাকতে তা হবে না। স্যারের স্মরণেই আমরা আবার নাট্যচর্চা শুরু করেছি। আমাদের বৈরাগীতলার মন্দির প্রতিষ্ঠা দিবসে সাধু মহারাজ দীননাথ স্বামী উপস্থিত ছিলেন, আমাদের কাজ দেখে উনি এতটাই খুশি হয়েছেন, ওনাদের বার্ষিক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ আমাদের জানিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, আমাদের যাওয়া-আসা, থাকা, খাওয়া-দাওয়া সমস্ত খরচ ওনারাই বহন করবেন। চারদিন ব্যাপি হবে এই অনুষ্ঠান। আগামী ১৮ তারিখ সকালে আমাদের যাত্রার সূচনা। এবারে আমাদের দলটা বেশ বড়। আমি, রণদা, সুজনদাদা ছাড়াও নাট্যদলের আরও পাঁচজন, ভোলাদাদা, গোপালদাদা, নিকুদাদা, সুনির্মলদাদা ও রাখালদাদা। সবাইকে নিয়ে যাবার আমন্ত্রণ ছিল, কিন্তু পড়াশোনা বা কাজকর্ম ফেলে সকলের যাওয়া সম্ভব নয়।
রণদা ঠিক করল, ওখানে আমরা আমাদের স্বর্গীয় মাস্টারমশাই সুধীর দাসের লেখা ‘চৈতন্য পালা’ নাটকটা করব। ওই নাটকে আমাকে আটটা গান গাইতে হয়। রণদা চৈতন্য সাজে। বাকিরা নানা ভূমিকায়। এই নাটকটা আমাদের নাট্যদলটিকে এক অন্য আঙ্গিকে নিয়ে গেছে।
গুরুজি বলল, অত দূরে যাবি একা একা?
রণদা বলে, একা কোথায়? আমরা সবাই তো আছি।
মা বলল, তা হলেও, ওই অজ পাড়া গাঁ! তুই যা দস্যি! দেখিস বাপু!
ঠাম্মি কিন্তু কোনও দুশ্চিন্তার কথা না বলে বেশ উত্তেজনার সাথে বলল, দাদুভাই চৈতন্যদেবের ওই গানটা যখন কুনাল গাইবে, তখন ৫০০ লোক চোখের জলে ভাসিয়ে দেবে! গা না ছোটভাই!
আমি গাইলাম,
বিরাজ গো প্রভু এই হৃদি জুড়ে
সদা যেন তব দরশন পাই
প্রকাশিছে আজি আমি ভবঘুরে
কোথাও যে তব দেখা নাই!
কি করে যে হেরি কায়া-তনু-মন
অধম কিছু যে ভেবে নাহি পাই
তোমার তরে প্রভু এ প্রাণ ত্যাজিনু
এ দেহে লহো তুমি ঠাঁই।
আমি এই সুরে একটা রবীন্দ্র সংগীত শুনেছি, “খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে… ”
ঠাম্মি বলল, এটাই তো জগতের নিয়ম রে ছোটভাই! সংসারী মানুষরা সারা জীবন মুক্তি খুঁজে মরে। আর বিবাগীরা ভাবে যদি একখানা বন্ধু সে পেত! কিন্তু কেউই নিজের অবস্থান বদলাতে শেখেনি। সংসারীরা আটকে থাকে তার নিজে হাতে গড়া শোনার খাঁচাতে। আর বিবাগীরা থাকে মুক্ত পৃথিবীতে।
ঠাম্মির সব কথা বুঝতে না পারলেও এটা বুঝলাম, সাধু-সন্ন্যাসীদের জীবন বেশ ইন্টারেস্টিং ও অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ হয়। আমাদের মতন একঘেয়ে জীবন তাদের নয়।
রণদা বলে, ওই অ্যাডভেঞ্চারের মজা যদি তুই জীবনে একবার বুঝে যাস, ঘরে তোর আর মন টিকবে না।
আমার অবশ্য এখনই বিবাগী হওয়ার কোন বাসনা নেই। বাবার চেয়েও ভালো গুরুজির স্নেহ, নিজের দেবকি মায়ের মতনই ভালো আমার মা যশোদা। আমার ঠাম্মি সত্যবতী দেবীর মতন ভালো মানুষ পৃথিবীতে আর দুটি নেই। আর যার জীবনে রণদার মতন দাদা আছে তার বিবাগী হওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না।
সুজনদাদা এই নাটকে বিশ্বরূপ সাজে। তোমাদের মতন আমিও জানতাম না, বিশ্বরূপ গৌরাঙ্গের অর্থাৎ চৈতন্যদেবের দাদা ছিলেন। বাল্যকালেই তিনি সংসার ত্যাগ করে বিবাগী হয়ে যান। যদিও ইতিহাসে তার ফিরে আসার কথা বলা আছে কিনা আমার জানা নেই, কিন্তু সুধীর স্যারের নাটকে যুবক অবস্থায় দুই ভাইয়ের আবার মিলন হবে। বংশীবাদক বিশ্বরূপ তখন মোহমায়াহীন সংসারের এক উদার পাখি। সুজনদাদার বাঁশি বাজানোর প্রতিভা দেখেই বোধহয় সুধীর স্যার এই চরিত্রটি কল্পনা করেছিলেন। আমি ভাবলাম, সত্যিই তো বিশ্বরূপ যদি আবার ফিরে আসত, কতই না ভালো হতো। ছোট পার্ট, তবুও সুজনদাদা অভিনয়টা বেশ ভালই করে।
দেখতে দেখতে আমাদের যাওয়ার দিন চলে এল। ভোর চারটেতে উঠে আমরা সবাই সদল বলে চললাম স্টেশনে। সেখানে প্রথম ট্রেন চেপে আমরা সাড়ে সাতটার মধ্যে রামনগর পৌঁছে গেলাম। আমাদের সহযাত্রী এক ভদ্রলোক বললেন, এক্সপ্রেস ট্রেনে গেলে এরপরের স্টপেজটাই দীঘা। সেবার আমাদের সেই ‘সোনার হরিণ’ অ্যাডভেঞ্চার-এর সৌজন্যে আমরা দার্জিলিং ঘুরে এসেছি। শুভদাদার ভাই পিন্টু আমার সাথী ছিল। তবে সমুদ্র দেখা হয়নি এখনও। রণদা খুব ছোটবেলায় নাকি একবার গিয়েছিল দীঘায়। ও বলল, যদি ওদিকের সময় বাঁচে তবে এবার আমরা দীঘাটা ঘুরে আসব।
স্টেশনে নামতে বুঝলাম এই স্টেশন একদম পাড়া গাঁ মার্কা নয়। শহুরে গন্ধ অল্প হলেও লেগে আছে। অবশ্য সে গন্ধ কেটে গেল টোটোতে চাপার পনের মিনিটের মধ্যেই। আশ্রম থেকে মনোজ নামে রণদার বয়সী একটা ছেলে এসেছে। ধুতি পাঞ্জাবি পরা, কপালে রসকলি আঁকা, সুঠাম চেহারা, ন্যাড়া মাথায় অল্প অল্প চুল সদ্য গজিয়েছে, নরম ঘাসের মতন অল্প দাড়ি গোঁফ, ফর্সা রঙে অপূর্ব এক সৌম্য জ্যোতি। দেখলে আর চোখ ফেরানো যায় না ।
আমি রণদা, সুজনদাদা আর মনোজবাবু একটা টোটোতে, আরেকটাতে বাকি পাঁচজন। ভোলাদাদা একটু অন্য প্রকৃতির মানুষ। জন্ম থেকেই ও মানসিকভাবে বিশেষ সক্ষম। তবে আমরা কেউই ওকে সেটা বুঝতে দিই না। একটু কম কথা বলে, সব সময় আনমনে কি যেন ভাবে, বেশি দৌঁড়াতে পারে না। রণদাকে ও প্রবলভাবে বিশ্বাস করে। আর আমাদের এই নাট্যচর্চার সুবাদে, সুধীর স্যারের উদ্যোগে ওর সেই মানসিক সমস্যা অনেকটাই কেটে গেছে। ও জেদ ধরেছিল রণদার সাথে টোটোয় উঠবে। শেষে ওকে বুঝিয়ে বলায় ও অন্য টোটোতে গিয়ে উঠল।
প্রথম মিনিট পনেরো ভালো লাগলেও, যতই টোটো এগোল আমার কেন জানি না মনে হল এক্ষুনি তো এই জায়গাটা দিয়ে গেলাম, আবার কেন? রাস্তার মানুষগুলোকে ছবির মতন মনে হচ্ছে, তারা যেন ক্যানভাসের মতন একটা একটা করে পিছন দিকে সরে যাচ্ছে, যেমন সিনেমা দেখার সময় একটার পর একটা দৃশ্যপট ভেসে ওঠে, আমার চোখে দেখা এখনকার দৃশ্যগুলো যেন সে রকমই লাগছে। চোখের পাতা ক্রমশ ভারি হয়ে আসছে।
রণদা বলল একে ট্রেনের ধকল তার উপর একটানা অনেকক্ষন বাইরের দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ আর কাজ করতে চায় না, তখন মস্তিষ্ক হ্যালুসিনেট হয়ে পড়ে। তাই এমনটা হয়।
ঘোর লাগা ব্যাপারটা ক্রমশই যেন বাড়তে লাগল। তাই আমি চোখ বুজে চুপচাপ বসে রইলাম। পরের রণদার মুখে শুনেছি, রাস্তার দুপাশে এবং সামনের কুয়াশায় পথ প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। তবু টোটোওয়ালা যেন অদ্ভুত এক মুন্সিয়ানায় টোটো চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের পেছনে ভোলাদাদাদের টোটোটা ছিল। মনোজ বাবু বললেন, এই রাস্তায় নাকি সাধুজিরা প্রাতভ্রমনে বেরোন।
রণদা বলল, তুমি এখানে কতদিন আছো?
-বেশিদিন নয় বাবুজি, এই গত ডিসেম্বরে এসেছি।
রণদা চট করে কোন নতুন পরিচিতকে তুমি সম্বোধন করে না। কিন্তু মনোজবাবুর ব্যবহারটা এতটাই নম্র, যে প্রাণ গলে যায়। রণদা বলল, আশ্রমে কি স্বেচ্ছাতেই আসা?
– হ্যাঁ।
-বাড়িতে কেউ নেই বুঝি?
-না গো, মা মারা গেছে এক বছর হল। বাবা সেই ছোটবেলাতেই মারা গেছে। ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। তিন মাসের ভাড়া দিতে পারিনি। অ্যাডভান্স টাকা থেকে বাড়িওয়ালা সেটা কেটে নিয়েছে। ধার দেনায় যখন নিঃস্ব ঠিক তখনই ভগবানের মতন দুর্গাবাবু আমার জীবনে এলেন।
আমি একটু সুস্থ বোধ করায় ওদের কথা বলার মাঝখানে চোখ খুলে ছিলাম। প্রাণ ভরে মনোজবাবুকে দেখছিলাম। সত্যি বলতে ওনাকে আমার বেশ ভালো লেগেছে। এমন সৌম্য দর্শন সাধুজি আমি কোনদিন দেখিনি। আর কথা বলার ভঙ্গিমাটাও এত সুন্দর যে কেউ তাকে দেখে মোহিত হয়ে যাবে।
আমি বললাম, দুর্গাবাবু কে?
-দুর্গাগতি মুখোপাধ্যায়। আমার বাড়ি হাওড়া রামরাজাতলায়। সেখানে একটি বহু পুরনো আশ্রম আছে। ছোট থেকেই আমার একটু বিবাগী মন, যেখানে সাধু-সন্তদের দেখতাম, আমার বয়সী অনেক ছেলেদেরও দেখতাম, সেখানে গিয়ে বসে পড়তাম, চোখ বুজে হরিনাম করছি, কখনও বা ওনাদের সাথে কীর্তন গাইতে গাইতে কেঁদে ভাসাচ্ছি, মা বড় দুশ্চিন্তা করত আমার এই স্বভাবের জন্য। মাকে বলতাম, চিন্তা করছ কেন? আমার তো হরি আছে। ওকে নিয়েই আমি বাকি জীবন বেশ ভালো থাকব। তো আশ্রমেরই এক উৎসবে দুর্গাবাবু গতবছর পুজোর সময় যান। ধার দেনায় তখন আমার অসহায় অবস্থা। দিনরাত হরিকে ডাকছি, প্রভু পথ দেখাও!
প্রভু কি আর ভক্তের অনুরোধ ফেলতে পারেন! আমাকে দেখেই দুর্গাবাবু বললেন, চলো আমার সাথে।
রণদা বলল, মা বাবা নাই থাকুক। তোমার ভালো লাগে এত কম বয়সে এখানে এসে সব কিছু মোহ মায়া ছেড়ে পড়ে থাকতে।
-কি যে ভালো লাগে তোমায় বোঝাতে পারব না রণবীর! এত শান্তি বোধহয় আমি কোনদিন পাইনি। হরি যেন সারা জীবনই আমায় এমন ভাবেই রাখেন। আর এখানকার আশ্রমিক বাচ্চাদের আমি খুবই ভালোবাসি। ওদের সাথেই আমার দিব্যি কেটে যায়। একা লাগলে মায়ের মূর্তির সামনে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকি, ধ্যান করি, কান্না করি, মাকে আমার কষ্টের কথা বলি।
আমার যেন কেমন মন খারাপ হয়ে গেল। যদিও আমার এই আবেগকে রণদা বড্ড অপছন্দ করে। কিন্তু ওকে আমি বোঝাতে পারি না, আবেগ যে কারোর নিয়ন্ত্রিত নয়। দুঃখের কথা শুনলে তাই তো চোখে জল আসে। আমি কেঁদে ফেলেছি দেখেই বোধহয় রণদা আমায় জড়িয়ে ধরে চোখের জল মুছিয়ে দিল। মনোজবাবু বললেন, তোমার ভাইটি বেশ মিষ্টি রণবীর! হরি ওকে ভালো রাখুক।
আমরা এখানে আসার আগে মা ও গুরুজি বারবার করে বলে দিয়েছিল, সাধু সন্ন্যাসীদের বশীকরণ ক্ষমতা থাকে, চাইলেই ওরা অল্পবয়সী ছেলেদের মন ভুলিয়ে তাদের বশ করতে পারে। তাই আমি আমার আবেগকে আপাতত নিয়ন্ত্রণ করলাম। কিন্তু আমার বিশ্বাস রণদা যখন আমাদের সাথে আছে, কোন ক্ষতি আমাদের স্পর্শ করতে পারবে না।
রামনগর স্টেশন থেকে টোটো ধরেছিলাম পৌনে আটটা নাগাদ। আর শিবগ্রামে শিব-দুর্গা আশ্রমে পৌঁছলাম প্রায় নটা নাগাদ। যদিও নাম শিব-দুর্গা আশ্রম, কিন্তু এখানে কোন দুর্গা মূর্তি নেই। মনোজবাবু বললেন, এখানে দুর্গাপুজো হয় ঠিকই। তবে সারা বছর মা দুর্গা দক্ষিণা কালী রূপে বৈষ্ণব মতে পূজিতা হন। আশ্রমে ঢুকতেই সাধু মহারাজ দীননাথ স্বামী আমাদের আশীর্বাদ করলেন। ওনার পকেটে সব সময় আবার চকলেট থাকে। আমাদের সকলকে একটা করে চকলেট দিয়ে বললেন, তোমরা আরও মানুষের ভালো করো। মা তোমাদের ভালো করবেন।
আশ্রমের উন্মুক্ত প্রাঙ্গন জুড়ে মস্ত বড় প্যান্ডেল করা হয়েছে। সেখানে প্রচুর ভক্ত সমাগম। তারই মাঝে একটি ছোট্ট যাত্রার মঞ্চ। সেখানে এখন আমন্ত্রিত সাধু মহারাজদের উপনিষদ আবৃত্তি চলছে। উপনিষদ আবৃত্তি শুনতে আমার বেশ লাগে। এমন সুরেলা ছন্দ মনকে যেন দুলিয়ে দিয়ে যায়। অবশ্য এত কঠিন সংস্কৃত আমি ঠিক বুঝতে পারি না। কিন্তু শ্লোকের মর্মার্থ এক বাঙালি সাধু বুঝিয়ে দিচ্ছেন। আমরা যাওয়ার পর কিছুক্ষণ সেখানে বসে বসে তা শুনছিলাম। আশ্রমের বাইরে একটা খালি জায়গায় আমাদের জুতো রাখবার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। আমরা জুতো রেখে মূল আশ্রমে প্রবেশ করলাম। ঢুকেই শিবের মন্দির। প্রায় ৪ ফুট লম্বা শিবলিঙ্গ। অদূরে নন্দী মহারাজের বিগ্রহ। সেখানে একটা ছোট্ট রান্নাঘরে আমাদের চা খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। এটি সাধুদের রান্নাঘর। যিনি চা দিচ্ছিলেন তিনি আসলে দুর্গাগতি মুখোপাধ্যায়। বয়স ষাটের কাছে । গৌর বর্ণ চেহারা। ইনিও বেশ সুপুরুষ। আমাদের বললেন, বীরপুরের বাবুজিরা, তোমরা চা সেবন করে উপরে মাকে দর্শন করে বিশ্রামকক্ষে যাও।
এই শিব-দুর্গা আশ্রমকে ঠিক মন্দির বলা যায় না। গৃহস্তের বাড়ির মতনই এর কারিগরি নকশা। নিচের তলায় সার বেঁধে অনেকগুলি ঘর, ঘরগুলির একদম শেষ প্রান্তে দুটি বড় বাথরুম। বড় হলঘরটিতে আশ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা দোতলায় উঠে এলাম। শিব মন্দিরের ঠিক উপরেই দক্ষিণা কালীর মন্দির। এমন সুন্দর কালী মূর্তি আমি এর আগে কখনোই দেখিনি। একবার গুরুজী আর রণদার সাথে কলকাতার সার্দান এভিনিউ-এর কাছে লেক কালী বাড়ি নামে একটি মন্দিরে গিয়েছিলাম। সেখানেও মাতৃমূর্তির সামনে গিয়ে কেমন যেন বোকা বোকা হয়ে গিয়েছিলাম। কিছুই চাইতে পারছিলাম না ঠাকুরের কাছ থেকে। এখানেও ঠিক তেমনটাই হল। রণদা বলে, ঠাকুর যদি সত্যিই কিছু থেকে থাকে, তবে তিনি জানেন তোর কোনটা প্রয়োজন কোনটা প্রয়োজন নয়। এই আলাদা করে কিছু চাইবার প্রয়োজন হয় না। দোতলাতেও নিচের মতনই বড় হল ঘর। সেই হল ঘরেরই এক প্রান্তে বসে আছেন এক অতি প্রাচীন বৃদ্ধা, সাদা কাপড়ে সর্বাঙ্গ ঢাকা। মাথায় ঘোমটা টানা। হাত জোড় করে উদাত্ত কণ্ঠে একটি গান গেয়ে যাচ্ছেন। পরে রণদা বলেছিল ওটা লালন ফকিরের গান-
জাত গেল জাত গেল বলে
এ কি আজব কারখানা!
এই দুটো লাইনই আমার মনে আছে। কারণ ওই লাইন দুটোর মর্মার্থ আমার মনে একেবারে গেঁথে গিয়েছিল। কত জটিল কথা, অথচ কত সহজ ভাবে বলা হচ্ছে।
বিশ্রামকক্ষে জামা কাপড় বদলে ঘুমানোর চেষ্টা করছি, চোখ বুজে আছি, ভোলাদাদা এই নাটকে বিষ্ণুপ্রিয়া সাজে। নারী বেশে ওকে চমৎকার মানায়। ওর গান ও নিজেই গায়। ও এখন ওর সংলাপ আওড়াচ্ছে। বাকিরা কেউ ফোন নিয়ে শুয়ে আছে, কেউ বা নিচে সাধুজিদের আবৃত্তি শুনতে গেছে। সুজনদাদা বাঁশি বাজানোটা প্র্যাকটিস করে নিচ্ছে। মনোজবাবু বলে গেছেন আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমাদের জল খাওয়ার দেওয়া হবে। রণদা বেশ খোশ মেজাজে আছে। ভোলাদাদার সাথে ওর অংশগুলো ও একটু প্র্যাকটিস করে নিচ্ছে। আমার খুব ঘুম পাচ্ছিল, নিকুদাদা আমায় বলল, চল না কুনাল একটু ঘুরে আসি!
রণদা বলল, ব্রেকফাস্ট করে আমরা বেরোব।
অগত্যা আমার আর ঘুমানো হল না। এপাশ-ওপাশ করে শেষে নিচে এসে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম। ভালোই লাগছিল, এমন গহীন গ্রাম আমরা এর আগে কখনও দেখিনি। এমন পাড়া গাঁ-এর কথা গল্পেই পড়েছি। এই প্রথমবার চোখের সামনে দেখে মনে হচ্ছে, এখানে মানুষ খুব বেশিক্ষণ প্রকৃতির শোভা উপভোগ করতে পারে না। বেশিক্ষণ এখানে বসে থাকলে মানুষ বোর হয়ে যাবে। এখানে মাটির রাস্তা। পাকা রাস্তাও আছে, তবে খুবই কম। বাড়িগুলি গায়ে গায়ে লাগানো নয়। অনেক দূরে দূরে একটা করে ছোট ছোট ছবির মতন বাড়ি। মনোজবাবুও আমাদের সাথে এসেছে। ওকে এখন আমিও তুমি সম্বোধন করছি। আপনি বলায় উনি ভীষণ আপত্তি জানিয়েছেন।
ও বলল, একটা মজার জিনিস দেখবে তোমরা?
বলেই একটা ছোট্ট জমির ওই পাড়ে গিয়ে বলল, আমি এখন উড়িষ্যায় আছি। এদিকটা উড়িষ্যার অংশ। আর তোমরা দাঁড়িয়ে আছো পশ্চিমবঙ্গের অংশে।
এটা সত্যিই বেশ রোমাঞ্চকর। তবে সবকিছু এত নির্জন ও থমথমে যে একা আসাটা যেন বিপদকে দোসর করার মতন।
মনোজবাবুকে রণদা একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করল।
-আচ্ছা ওই বৈষ্ণবী কি আশ্রামেই থাকেন?
-না, উনি উড়িষ্যার একটা ছোট্ট গ্রামে থাকেন। রোজ সকালে আশ্রমে আসেন। আবার সন্ধ্যের পর চলে যান। ঝড় জল বৃষ্টি কোনদিনই এমন হয় না যে উনি আসেন না। কিন্তু কেন বল তো?
-না তোমাদের সকলের রসকলি আছে। ওনার নেই। তার বদলে ওনার প্রায় কুঁচকে যাওয়া চামড়ায় জগন্নাথ দেবের উল্কি দেখলাম।
-কই চোখে পড়েনি তো? সাধুদের দরবারে কেউই নিরাশ হয়ে ফিরে যান না। উনি একদিন মাধুকরী করতে এসে মহারাজের চোখে পড়েন। মহারাজ ওকে বলেন, মা তুমি আমার আশ্রমে থেকে যাও। উনি আশ্রমে আসলেন ঠিকই। কিন্তু থাকেন না। যত রাতই হোক উনি ফিরে যান।
-শুধুমাত্র ভোগ প্রসাদ খেয়েই চলে যান? মানে ওনার ব্যাপারে তোমরা জানো না কিছু!
-সত্যিই জানি না রণবীর। ওই মাকে মহারাজ বড় ভালোবাসেন।
-ওনার কণ্ঠে লালনের গান শুনলাম। তার মানে উনি মন্দিরের দীক্ষিত নন। অবশ্য দীক্ষিত হলে যে লালনের গান গাওয়া যাবে না তেমন নয়, কিন্তু আধ্যাত্মিক পরিবেশে বসে ঠাকুরের গান না গেয়ে লালন ফকিরের গান গাওয়াটা…
-রণবীর, দীক্ষা না নিলে যে আশ্রমে থাকা যাবে না আসা যাবে না এমনটা তো কোথাও নিয়ম নেই।
-বেশ।
আমি বুঝলাম না রণদা হঠাৎ ওই মহিলাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কেন? ও কি কোন রহস্য না থাকলেও রহস্য টেনে টেনে বার করবে! মনোজবাবুরও বোধহয় একই কৌতুহল হচ্ছিল, সেটা বুঝতে পেরেই বোধহয় রণদা বলল, তোমার চিন্তার কোন কারণ নেই। আমি এমনি জিজ্ঞাসা করছি।
ভোলাদাদা একটু এগিয়ে গিয়েছিল, নিকুদাদা আর সুজনদাদাকে সামনে দেখতে পাচ্ছি, বাকিরা আমাদের পিছনে আছে সেটা বুঝতে পারলাম। এখন নরম ঘাসের উপর আমরা খালি পায়ে হাঁটছি। ভালোই লাগছে কিন্তু। হঠাৎ নিকুদাদার চিৎকারে আমরা ছুটে গেলাম ওদিকে, একটু দূরে দেখি খড়ি খেতের ঠিক পাশে মুখ থুবড়ে উপর হয়ে পড়ে আছে ভোলাদাদা। মাথায় রক্ত। রণদা এরকম পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখতে ওস্তাদ। ও ভোলাদাদার নাকের কাছে হাত দিয়ে বলল, ভয় নেই!
তারপর ভোলাদাদাকে চাগিয়ে তুলে রাস্তার একপাশে নিয়ে এল। এরই মাঝে মনোজবাবু কোথা থেকে যেন এক বোতল জল নিয়ে এসেছে। লক্ষ্য করলাম একটু দূরে কয়েকজন চাষী শ্রেণীর মানুষ কাজ করছিলেন, হয়তো ওদের কাছ থেকেই জল আনা হয়েছে। ওকে একটু সুস্থ করার পর ও বলল, খড়ি খেতের মধ্যে থেকে একটি যুবক তাকে ডাকল, তারপর হাতে একটা কাগজ দিয়ে কি সব ভাষায় যেন ভয় দেখাল। ভোলাদাদা ‘বাংলায় বলো’ বলতেই, কে যেন পিছন থেকে ওকে মাথায় আঘাত করে।
রণদা ব্যস্ত হয়ে বলল, কি কাগজ?
-কাগজটা কই? ভোলাদাদা ব্যস্ত হয়ে বলল।
অবশেষে ওর বুক পকেট থেকেই একটা কাগজ পাওয়া গেল। সেখানে ওড়িয়া হরফে লেখা। মনোজবাবু ওড়িয়া শিখে নিয়েছে। রণদা ওড়িয়া বুঝতে পারলেও এখনও সবকটা ওড়িয়া হরফ শিখে উঠতে পারেনি। মনোজবাবুই বললেন ওতে লেখা আছে, “ফিরে যাও নইলে বিপদ”!
বোঝো কান্ড! রণদার মনস্কামনা তাহলে পূর্ণ হল। কিন্তু কি বিপদ! কার বিপদ! কেন বিপদ! সেটা তো আগে জানা দরকার?
আমরা কথা না বাড়িয়ে সোজা আশ্রমে ফিরে এলাম। ভোলাদাদার মাথায় মহারাজ নিজের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। উনি বললেন, এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। এ গ্রামে অতিথিদের সবাই শ্রদ্ধা করে। তবে এ নিয়ে তোমরা ভেবো না বাবুজিরা। এ কোন দুষ্টু ছেলের কাজ বাবুজি! আমি খুবই লজ্জিত! ওদের হয়ে আমি তোমাদের কাছে মাফ চাইছি।
এরপর কিন্তু আমাদের সাথে তেমন কিছুই ঘটল না। কিন্তু এই ঘটনার ফলে ভোলাদাদা বেশ আতঙ্কে ভুগছে সেটা বুঝতে পারছি। এখনও মাঝে মাঝেই ও চমকে চমকে উঠছে। তবে মনের জোর আছে ওর। এই অবস্থাতেও বিষ্ণুপ্রিয়ার সংলাপ বেশ ভালোই আওড়াচ্ছে। শুধু একটি দৃশ্যের কান্নার সময় গলা তুলতে গেলে ব্যথায় বোধহয় ওর চোখ দিয়ে সত্যিই জল বেরিয়ে আসছে।
আদতে ঘটনাটা আমরা যতই সাবলীলভাবে নিই না কেন এর কারণ তো এখনও অবধি টের পাচ্ছি না। রণদা দুপুরের খাওয়ার পর বলল, তোরা একটু বিশ্রাম নে, আমি একটু আসছি।
আমি জানি ও যাবেই। তবু একবার বললাম, না গেলেই নয়!
– না যেতেই হবে রে! ভোলাকে একটু সাবধানে রাখিস।
রণদা আসার আগেই যে মূল ঘটনাটা ঘটে যাবে, সেটা জানলে ও বোধহয় যেতই না। আমরা বিকেলের দিকে নিচে এসেছিলাম চা খেতে। ভোলাদাদা বলল আসবে না। মনোজবাবু বললেন, ওর চা-টা আমরা আসবার সময় ঘরে নিয়ে আসতে পারি।
যথারীতি চা খেয়ে আমরা উপরে এসে চোখে একদম সর্ষেফুল দেখলাম। কালী মূর্তির সামনে সকালের সেই বৈষ্ণবী চোখ উল্টে পড়ে আছেন। গলায় ছুরি চালিয়েছে কেউ। আমি আর্তনাদ করে উঠলাম। সুনির্মলদাদা ঘরে গিয়ে দেখে আরও হতভম্ব হয়ে গেল। ভোলাদাদা উধাও। নেই।
নেই মানে! কোথায় যাবে!
পুলিশ এসে গেল তবু ভোলাদাদার দেখা নেই। রণদা বেশ ফুরফুরে মেজাজেই এসেছিল কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই এসব ঘটনা শুনে ওর মুখ আবার থমথমে হয়ে গেল। শিবগ্রাম অঞ্চলটি রামনগর থানার আন্ডারেই পরে। রামনগর থানার অফিসার নিরঞ্জন নায়ক বেশ সহজভাবেই সাধু মহারাজকে বললেন, দেখুন কেস অত্যন্ত সহজ। ওই ছেলেটি হয়তো মন্দিরের মূর্তির গয়না চুরি করতে চায়, তাতে বুড়ি ওকে বাধা দেয়। ফলে ছোকরা বুড়িকে ছুরি মেরে পালিয়ে যায়। আসলে বুড়িকে মারার উদ্দেশ্যটা বোধহয় ছোকরার ছিল না। বুড়ি মরে যেতে ভয় পেয়ে ছোকরা পালিয়েছে।
শুধু রণদা কেন আমরা সকলেই এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন অফিসারের কথায় রেগে গেলাম। গোপালদাদা, রাখালদাদারা তো তেরে মেরে গেল ওনাকে মারতে। কিন্তু রণদা অত্যন্ত ঠান্ডা মেজাজে বলল, আপনি মানহানির মামলার ঝক্কি কখনও পোহাননি তাই না?
-মানে? কে তুমি!
মনোজবাবু রণদার আসল পরিচয় দিতেই ভদ্রলোক অত্যন্ত বিদ্রুপের সাথে বললেন, হুঁ! রায়বাবুদের মতন কিছু লেখকরাই আমাদের সর্বনাশ করে গেছেন! বুঝলেন? এইটুকুন সব ছেলেছোকরা এরা খুনের রহস্য সামলাবে? সরকার তবে আমাদের রেখেছে কেন? তুলে দিতেই তো পারে।
-মানুষকে অবজ্ঞা করাটাও আইনবিরুদ্ধ সেটা বুঝি আপনাকে ট্রেনিং-পিরিয়ডে শেখানো হয়নি?
– বেশ তুমিই তবে কেস সামলাও। মহারাজ আমরা তবে আসি!
রণদা বলল, আপনার যা ভালো মনে হয় করুন, তবে আপনি চলে গেলে আপনার চাকরির মায়া ত্যাগ করেই যাবেন।
নিরঞ্জন নায়ক বোধহয় রণদার ইতিহাসগুলো ঠিক মতন জানেন না। ওনার সাথে একজন কনস্টেবল ছিলেন, তিনি ওনাকে রণদার কাণ্ডকারখানা সম্পর্কে বলছিলেন। ততক্ষণে রনদা মেদিনীপুর জেলা থানার ওর এক চেনা অফিসার মোহন সামন্তকে ফোন করল। আমার মনে পড়ল, ‘সোনার হরিণ’ রহস্যে উনি আমাদের অকৃপণ সহযোগিতা করেছিলেন। মিনিট খানেকের মধ্যেই নিরঞ্জনবাবুর কাছে মোহনবাবুর ফোন আসায় ভদ্রলোক রণদার ক্ষমতা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পেয়ে বিনয়ে একেবারে গদগদ হয়ে গেলেন।
-রণবাবু তুমি তোমার মতন তদন্ত করতে পারো। আমি আমার এক কনস্টেবলকে রেখে যাচ্ছি। তুমি প্রয়োজনে আমার সাথেও যোগাযোগ রাখতে পারো। আরেকটা কথা তোমার বন্ধুটি যখন এ কাজ করতেই পারে না বলে তোমার বিশ্বাস। তখন ও কেন লুকিয়ে পড়বে বা চলে যাবে বল তো?
-আপনি ভুল করছেন নিরঞ্জনবাবু, আমি একবারও বলিনি ভোলাকে আমার সন্দেহ হচ্ছে না। কিন্তু একটাই প্রশ্ন, ওর এই আচমকা অদৃশ্য হওয়া। আমার বিশ্বাস, এই আশ্রমের নকশা যাদের জানা তাদের মধ্যেই কেউ এই কাজ করেছে। কিন্তু বৈষ্ণবীকে যে বা যারা এভাবে নির্বিচারে হত্যা করেছে তারাই আমার বন্ধুকে সরিয়েছে কিনা এখনই বলা মুশকিল!
পুলিশ এতক্ষণে শুধু আশ্রমটাই নয় তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে আশেপাশের গ্রামগুলোও। এমনকি উড়িষ্যার কিছু গ্রামেও লোক পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। উড়িষ্যা পুলিশের সাথেও যোগাযোগ করা হচ্ছে। আমরাও এক ফাঁকে গিয়ে যে স্থানে সকালে আমাদের সাথে দুর্ঘটনা ঘটেছিল সেই অবধি দেখে এসেছি। খড়ি খেতের মধ্যে ঢুকে ওর নাম ধরে বারবার ডেকেছি, সেই সঙ্গে মাইকেও ওর নাম ধরে বারবার ডাক-খোঁজ করা হচ্ছে আশ্রম থেকে। কিন্তু বিকেল পেরিয়ে গেলেও ভোলাদাদার কোন খোঁজ পাওয়া গেল না দেখে রণদা নিজে বেরোল। এরই মধ্যে ও আশ্রমিক ও অতিথিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে নিয়েছে। অবশ্য কি জিজ্ঞাসাবাদ করেছে আমি জানি না এখনও।
আমার শুধু ভোলাদাদার কথা ভেবে দুঃখ হচ্ছে। সন্ধ্যে হয়ে গেলেও ও যখন এল না, আমি কেঁদেই ফেললাম। আশ্রমিক বাচ্চারা আমায় প্রবোধ দিয়ে বলছে, শিবের থানে অসিনু যখন, অত চিন্তে কেনে করো গো! শিব রে ডাকো! ভালো করি মন দিয়ো ডাকিবা! শিবা তো স্বয়ং ভোলা আছে গো। ওই রক্ষা করিব!
সাধু মহারাজ দেখলাম বেশ শক্ত আছেন। অবশ্য শক্ত না থাকলে এমন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায় না। বলা বাহুল্য অনুষ্ঠান পন্ড হয়ে গেছে। যতক্ষণ না কেস মিটছে, অতিথিরাও কেউ ফিরতে পারবে না। তাই আশ্রমে আগত সমস্ত অতিথিদের তিনি নিজে হাতে বিকেলের চা জল খাবার দিচ্ছেন। আর তারই মাঝে মাঝে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন। সুজনদাদা রণদার সাথে গেছে, বাকি দাদারা কোথায় যে কে আছে কিছুই বুঝতে পারছি না।
রণদা যখন এল তখন সাড়ে দশটা বেজে গেছে। মুখ চোখ শুকনো, ভোলাদাদা নেই সাথে। ওর মনের অবস্থা বুঝে সত্যিই কষ্ট হল। একবার মনে হল, সত্যিই আমরা বোধহয় গুরুজি ও মায়ের কথা অমান্য করে এখানে এসে ঠিক করিনি। রণদার অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে।
হঠাৎ আশ্রমের সেবাইত দুর্গাগতি মুখোপাধ্যায়ের চিৎকারে আমরা দোতলা এলাম। উনি কিছুক্ষণ আগেই আমাদের সামনে বসে ছিলেন। একটু আগেই উঠে এসেছেন। মূর্তির ঠিক পেছন থেকে অচৈতন্য ভোলাদাদাকে দুর্গাবাবু আর মনোজবাবু একসাথে বার করে আনছেন। ভোলাদাদার কোমরে একটা গেরুয়া বসনের পোটলা। সেটা খুলতে সেখান থেকে বেরোল একটা রক্তমাখা ছুরি, ও একটা বড় সোনার হার।
সাধু মহারাজ দীননাথ স্বামী বললেন, আমাদের মা কালী অতি জাগ্রত। কারুর ক্ষতি তিনি সহ্য করতে পারেন না। তাই তো এ ছেলে শাস্তি দিয়েছেন।
ব্যাপারটা হল এই, দুর্গাবাবু প্রতিদিন সাড়ে আটটার সময় মা কালীকে শয়ন দেন। আজ যেহেতু পুলিশী ঝামেলা ছিল শয়ন দিতে একটু দেরি হয়ে গেছে, যতই সাধু হোক, ভয় তো সকলের মনেই থাকে। মনোজবাবুকে সঙ্গে করে দোতলায় যান শয়ন দিতে, সেখানে ওনারা আবিষ্কার করেন ভোলাদাদাকে। ও চিৎ হয়ে পড়ে আছে মূর্তির ঠিক পেছনে।
মনোজবাবু বললেন, এটা কিন্তু কল্পনাও করিনি রণবীর। তোমার বন্ধুই চোর! তার মানে এটাও ঠিক যে ওই খুন করেছে।
আমার মনে এটুকুই আনন্দ হচ্ছিল, যে ভোলাদাদাকে আবার পাওয়া গেছে। কিন্তু এখন ওকে যে সবাই দোষারোপ করছে। রক্তমাখা ছুরি থাকলেই কি প্রমাণ হয়ে যায় ও খুনি?
ভোলা দাদা কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। ও যেন এখনও কিছু বুঝতেই পারছে না। আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না যে ও এই কাজটা করতে পারে। কিন্তু সমস্ত প্রমাণ ওর বিরুদ্ধে, অভিযোগ ওর দিকে তীক্ষ্ণ! এখন কি কেউ বিশ্বাস করবে ওর সারল্য? তাছাড়া ওই সোনার হার যখন ওর কাছ থেকেই পাওয়া গেল, তখন রণদাও কি কিছু করতে পারবে! পুলিশে খবর দেওয়া হয়ে গেছে। নিরঞ্জন নায়ক এত রাতে আর আসতে পারবেন না। ভোলাদাদাকে কাল সকালে গ্রেফতার করা হবে। আপাতত ওকে নিরঞ্জনবাবুর কনস্টেবল আশ্রমের নিচের তলার একটি ঘরে আটক করে রেখেছেন। আমার মাথায় এখনও কিছুই ঢুকছে না। জানি না রণদা কি ভাবছে? এখন ও একদম চুপচাপ। যেন পরাজিত সৈনিকের মতন মাথা নিচু করে আছে সর্বক্ষণ। তবে কি ভোলা দাদাকে ও-ও খুনি এবং চোর বলে বিশ্বাস করে নিয়েছে! আমাদের যে সমাদর সকালে এখানে করা হয়েছিল, তার দশগুণ অপমান করা হল। সাধু মহারাজ দীননাথ স্বামী পর্যন্ত লজ্জায় লাল হয়ে বললেন, মানুষ চিনতে আমারও ভুল হয় সেটা আজ বুঝতে পারলাম।
এসব দেখেও রণদাও চুপ করে আছে। আসলে সত্যিই ওর কিছু করার নেই। এমন পরিণতি ও কল্পনাও করেনি।
রাতে শুয়ে সুনির্মলদাদা বলল, আমি বারণ করেছিলাম রণকে, সবাইকে দলে ঢোকাস না। ওরকম থাকে হাঁদা ক্যাবলা সেজে, এদিকে এই কান্ড!
রাখালদাদা বলল, কয়লা কে যতই ধো, সে কি আর সাদা হয় রে?
সুজনদাদা বলে, তোমরা চুপ কর দেকিনি!
মাঝ রাতে আমার একবার ছোট বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ায় আমি রণদাকে বললাম সাথে যেতে। রাতের বেলায আশ্রম যেরকম নিস্তব্ধ হয়ে গেছে, তাতে করে এক দু পিস ভূত থাকলেও খুব একটা আশ্চর্য হব না। ফেরার সময় ও একবার ভোলাদাদাকে দেখে এল। ঘরে চুপচাপ শুয়ে শুয়ে ও কাঁদছে। এদিকে বাইরে কনস্টেবল ঘুমিয়ে কাদা। কি একটা মনে করে ঘরের পিছন দিকে চলে গেল রণদা এক লাফে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এসে দেখে কনস্টেবল উঠে পড়েছে।
-কি রণবীরবাবু? এখনও কি আপনি রহস্য খুঁজে বেড়াচ্ছেন?
ভদ্রলোককে তোয়াক্কা না করেই ফিরে এল। রাতে আমাদের আর কারোরই তেমন ঘুম এল না। ভোর সাড়ে ছটা নাগাদ রামনগর থানার ইন্সপেক্টর নিরঞ্জন নায়ক সদল বলে এলেন। এসেই রণদার দিকে তির্যক ইঙ্গিত করে বললেন, কি হে শখের গোয়েন্দা! নাক কাটা গেল বুঝি? মুখ অমন ঝুলিয়ে রেখেছো, মাটির সঙ্গে মিশে যাবে তো?
মহারাজ বললেন, স্যার এবার আমরা অনুষ্ঠান শুরু করতে পারি তো? বুঝতেই পারছেন একটা গোটা দিন নষ্ট হল!
-দাঁড়ান মহারাজ… রণদার কণ্ঠ এবারে ভয়ানক গম্ভীর।
মহারাজ বললেন, কি হল? আরও কিছু হেনস্থা করতে বাকি আছে তোমাদের? খুনের মামলা না হলে তোমাদের ছেড়ে দিতাম। কিন্তু চিন্তা করো না, তোমাদের চুক্তিবদ্ধ সমস্ত টাকা আমি দিয়ে দেব। মনোজ, তুমি ওদের ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করো।
নিরঞ্জন নায়ক বললেন, মানহানির মামলা আমি করব না বাবা! ছেলে মানুষ বলে এই বেলা পার পেয়ে গেলে!
-কিন্তু আমি যদি পার না করতে দিই?
-মানে!
-কাল বৈষ্ণবী হত্যার পর আপনি আশ্রমে এসে মা কালীর গর্ভগৃহে ঢোকেননি তাই না?
-না সেখানে সাধু-সন্তরা ঢুকে দেখে এসেছে।
-কোন সাধু-সন্তু ঢুকে ছিল মনে আছে?
-তা মনে নেই।
-আমার মনে আছে। মনোজ ঢুকেছিল।
-তা হবে।
-মনোজ, সেই সময় তুমি ভোলাকে সেখানে দেখোনি তাই না?
-না।
-তোমার এই ‘না’টাও আমি বিশ্বাস করতাম না, যদি আমি নিজে না সেই মুহূর্তে ওখানে গিয়ে দেখে আসতাম।
মহারাজ বললেন, এত বড় স্পর্ধা! তুমি দীক্ষা না নিয়ে গর্ভগৃহে ঢুকেছিলে?
-মায়ের কাছে যেতে গেলে দীক্ষা নিতে হয় এমনটা আমি বিশ্বাস করি না মহারাজ। মনোজই আমায় বলেছিল, যে আপনার আশ্রমে সকলের সমান সমাদর।
-তাই বলে গর্ভগৃহে!
-সেই জন্য যদি আপনি আমায় দন্ড দিতে চান আমি তা মাথা পেতে নেব।
-আমি তা বলিনি। সবকিছুর একটা নিয়ম তো আছে!
-মাফ করবেন মহারাজ, আপনার সেই ভন্ড নিয়ম আমি মানতে পারব না। আচ্ছা একবারও আপনাদের মনে এই সন্দেহটা হল না, ওই জায়গায় যখন আমার বন্ধু ভোলা ছিল না, তখন হঠাৎ এল কি করে?
নিরঞ্জনবাবু বললেন, হয়তো ছোকরা সুযোগ বুঝে, বিপদ দেখে, আবার সে গয়না ফেরত দিতে এসেছিল, উত্তেজনা বসে অজ্ঞান হয়ে সেখানে পড়ে গেছে।
আবার সেই কান্ডজ্ঞানহীন কথা শুনে আমার রাগ ধরে গেলেও কিছু বললাম না। রণদা বলল, মহারাজ, আপনিও কি তাই বিশ্বাস করেন?
-দেখো অতশত বুঝি না আমি! দোষী যখন ধরা পড়ে গেছে, সেসব বিচার আদালত করবে।
-আর যদি বিচারে ও নির্দোষ প্রমাণিত হয় তখন কি হবে?
-তুমি কি বলতে চাইছো বলো তো।
-শুধু বলব না। দেখাবও। মূল চালাকি কোথায় জানেন? এই আশ্রমের চার চৌহদ্দির মধ্যে কোন সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। আততায়ী সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছেন। বলছি যখন গোড়া থেকে শুরু করি। আশ্রমে আসার খানিকক্ষণ এর মধ্যেই আমার বন্ধু ভোলাকে কেউ মারতে চেষ্টা করে। ঘটনাটা ঘটে আশ্রমের খুব কাছাকাছিই একটি নির্জন জায়গায়। আপনাকে এই ঘটনাটা জানানো হয়েছে কিনা আমি জানি না নিরঞ্জনবাবু, আপনাকে ভাবতে হবে যদি ভোলাই এই কান্ডটা করে থাকে, তবে কে আক্রমণ করতে চেষ্টা করল? সাজানো ঘটনা হলে ওর পকেটের ওড়িয়া হরফে লেখা কাগজ অব্দি মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু ওর মাথার পেছনের চাপ রক্ত! সেখানে ওকে কিভাবে মারা হলো? মূল ঘটনাটা আমার বন্ধুকে কেউ আক্রমণ করেছিল এটা সত্যিই এবং এই রহস্যের সমাধান আমি করেও ফেলেছিলাম। কিন্তু আততায়ীর ধূর্ততার কাছে আমি আরও একবার পরাস্ত হলাম। তার দ্বিতীয় চালের জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না ।
যে বৈষ্ণবী মারা গেছে, মনোজ বলেছিল সে থাকে উড়িষ্যার একটা ছোট্ট গ্রামে। আমার কেন জানি না মনে হল ওর কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। ‘রামনামি’ বলে এক সম্প্রদায় আছে আপনারা জানেন আশা করি। যারা বর্ণভেদের একদম প্রান্তিক স্থানে অবস্থান করে। রামনামি সম্প্রদায় এক বিশেষ সম্প্রদায়। এরা থাকে ছত্রিশগড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। তবে বাংলাতেও যে এদের কিছু সম্প্রদায় চলে এসেছে সেটা আমার জানা ছিল না। কাল এখান থেকে দু কিমি দূরে রামনামপুর বলে একটা গ্রামে গিয়ে, ওই বৈষ্ণবীর ঠিকানা আমি উদ্ধার করি। ওখানে না গেলে বিশ্বাস করা শক্ত মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রামকে ওনারা কতটা ভালোবাসেন। অথচ একসময় এমন ছিল এদেরকে সমাজের উঁচু স্তরের মানুষরা রামের উপাসনা তো দূরের কথা, ছায়া পর্যন্ত মারাত না। তাই ওরা সারা শরীরে রামের নামের উল্কি এঁকে নেয়। রাম এদের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিরায় উপশিরায়। গ্রামবাংলায় লালন ফকিরের সম্প্রদায় ছিল আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে। সেই জাতপাতহীনতার প্রকাশও যেন কোন এক জায়গায় এসে মিলে যায় এই রামনামিদের সাথে। তাই বলাবাহুল্য ওই বৈষ্ণবী আসলে ছিল এক রামনামি। এবং সেই অসভ্য সমাজের কিছু ছায়া আজও সভ্যতায় মোরা এ সমাজের কিছু মানুষের গায়ে লেগে আছে। সাধু মহারাজের উদারতা আশ্রমের সবাই মানতে পারেননি সেটা আমি কাল ওনাদের সাথে কথা বলে বুঝতে পেরেছি। রামনামি ওই বৃদ্ধার হাতে একটি বৃহৎ রামনামের উল্কি ছিল। কিন্তু মনোজকে আমি ইচ্ছে করেই বলি সেটা জগন্নাথের উল্কি। আমি জানতে চাইছিলাম ও সত্যি কথাটা বলে কিনা। স্বভাবতই বলেনি। রামনামি বৃদ্ধাটি মারা যাবার পর তার গোটা অঙ্গেই আপনারা উল্কি লক্ষ্য করেছেন। বুঝতে পেরেছেন কি না জানি না। এখন কথা হল কে তবে আমার বন্ধুকে আক্রমণ করল বা ভয় দেখাল? আর ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যটাই বা কি? এর উত্তর করতে আমার অনেক সময় লেগে গেছে। ভোলার ঠাকুরদা মহিম পাল রামনামি গোষ্ঠীর লোক, এটা আমি বাবার কাছে শুনেছি। ওনার সারা গায়ে রাম নামের উল্কিও ছিল। তবে তিন পুরুষ আগে ওরা বীরপুর গ্রামে চলে যায়। এবং সেখানেই থাকতে শুরু করে, পাল পদবী গ্রহণ করে মূর্তি বানাতে শুরু করে। তবে রামনাম কি অত সহজে ছাড়া যায়, তাই ওদের বংশানুক্রমে প্রত্যেকের গায়ে অন্তত একটা করেও রামের উল্কি ছিল। ভোলার বুকেও রাম নামের উল্কি ছোট থেকেই আছে। সেটা আশ্রমিকদের একজনের চোখে পড়ে। সে আমাদের সাথে বন্ধুত্বের অভিনয় করে একটা ফাঁদ পাতে। স্থানীয় এক যুবককে ডেকে ওড়িয়া ভাষায় হুমকি দিয়ে ভোলাকে আহত করায়। সে আর কেউ নয়, মনোজ।
-কি বলছো এসব? মনোজবাবু খুব রেগে গেল… বন্ধুর যন্ত্রণায় পাগল হয়ে গেলে নাকি?
রণদা এক ছুটে কাল যে ঘরে ভোলাদাদাকে রাখা হয়েছিল তার পিছন দিকে চলে গেল, কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি মূর্তিকে নিয়ে আবার হাজির হল।
ভোলাদাদা বলে, হ্যাঁ রণ, এই সেই লোক।
রনদা বলে, কাল দুপুরে খাবার পর এই গ্রামেই এই ছেলেটিকে খুঁজে পাই। ভোলার মুখে এর বর্ণনা শুনে ওকে খুঁজে পাওয়া খুব একটা কঠিন ছিল না আমার কাছে। পরে ভোলা নিখোঁজ হওয়ার পর আমার কায়দায় ওকে আবার আটক করতে হয়। আপনি না আসা পর্যন্ত ওকে আমার জিম্মাতেই রাখা হয়েছিল। এছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না নিরঞ্জনবাবু।
-আমার কোন দোষ নাহি আছে! মনোজবাবু বলিল টঙ্কা দিবে! বলল যুবকটি।
নিরঞ্জনবাবুর চোখের ইশারায় দুজন কনস্টেবল মনোজবাবুর দুপাশে চলে গেছেন। সাধু মহারাজ দীননাথ স্বামীর মাথা নিচু।
-এখানেই শেষ নয়, ভোলাকে ওরকম বোকা বুঝে ওকে টোপ ব্যবহার করা হয়েছিল। এর প্রতীক্ষাই বোধহয় করছিল মনোজ। রামনামি ওই বৃদ্ধাকে নৃশংস ভাবে খুন করে! বৃদ্ধার চিৎকারে ভোলা বাইরে আসলে তাকেও আহত করা হয়, ওর হাতের ছুরি ধরিয়ে লুকিয়ে রাখা হয় ওই কোনার ঘরের একটা ট্রাঙ্কে। সিসিটিভি না থাকায়, আমার রেখে যাওয়া এই গোপন ক্যামেরায় এ সমস্ত ঘটনার রেকর্ড হয়ে গেছে। রণদা পকেট থেকে একটা পেন বার করে নিরঞ্জনবাবুকে দিল।
-আসলে কি জানেন! গন্ডগোল সব সময় আমার পিছনে পিছনে ধাওয়া করে, তাই এই সমস্ত জিনিস আমাকে সাথে নিয়ে চলতে হয়। পরে যখন আমি ভোলাকে খোঁজার নাটক করতে থাকি, তখন ভোলাকে ওই মূর্তির পিছনে রেখে নিজের কীর্তিটাকে অলৌকিক প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে মনোজ। তারপরে বোকামি করে নিরঞ্জনবাবুর কথা অনুযায়ী কালী মূর্তির গা থেকে একটা বহুমূল্য হার খুলে গেরুয়া কাপড়ে রক্তমাখা ছুরির সাথে রেখে দিয়ে সেটা ভোলার কোমরে বেধে দেওয়া হয়। ভোলার ব্যাপারটা আমায় খুব আহত করলেও উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করছিলাম। এছাড়া সত্যি বলতে আমার লোকবল ছিল না। কারণ নিরঞ্জনবাবু, আপনার কনস্টেবল যখন ঘুমে অচেতন, তখন আমি ভোলার সাথে কথা বলি, উনি টেরও পাননি। আমার গোপন ক্যামেরাতেও কিন্তু ভোলার বলা ঘটনা হুবহু মিলে গেছে। নইলে আমি ভোলার কথা ইচ্ছে থাকলেও বিশ্বাস করতে পারতাম না।
মহারাজের ল্যাপটপে ক্যামেরার চিপ লাগিয়ে রণদার বলা সব ঘটনা মিলে যাওয়ায় নিরঞ্জনবাবু ভোলাদাদাকে সসম্মানে ছেড়ে দিলেন। বললেন, আমায় ক্ষমা করো রনবীর! ভোলাবাবু, জানি আপনার উপর যা অত্যাচার হয়েছে তার কোনও ক্ষমা নেই। আইন সেই পথেই এগোবে।
মহারাজ বললেন, কিন্তু আমি এটা বুঝে পাচ্ছি না, মনোজ এত সব একা করল কোন সাহসে?
-একা তো করেনি মহারাজ…
রণদার কথা শেষও হয়নি, এমন একটা ঘটনা ঘটল যেটা ভাবলেও এখনও গা শিউরে উঠছে। যেই সেবাইত কাল ভোলাদাদাকে আবিষ্কার করেছিল, কোথা থেকে একটা লাঠি দিয়ে সে রণদাকে মারতে যাওয়ার আগেই, ভোলাদাদা বারান্দার এক কোণে রাখা একটা কাসার গ্লাস তুলে নিয়ে ছুড়ে মারল সেই সেবাইতের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সেই সেবাইত।
-ভেরি গুড ভোলা! সাবাস!
রণদা যে যুবককে হাজির করেছিল সে বলল, এই সেই বাবু আছে, যে কাল ও বাবুজিকে মারল! আমি মানা করিনু! তবুও শুনিল না।
রণদা বলল, এই হল আপনার দ্বিতীয় কাল সাপ মহারাজ, যে মনোজকে এই আশ্রমে এনেছিল, আপনার অতি বিশ্বস্ত আশ্রমিক দুর্গাগতি মুখোপাধ্যায়।
স্বর্গীয় সুধীর দাসের লেখা বনফুল নাট্যদলের নাটক ‘চৈতন্য পালা’ সকলের খুব ভালো লেগেছে। বিষ্ণুপ্রিয়া বেশে ভোলাদাদাকে চেনাই যাচ্ছিল না। ও যখন গান ধরল…
তোমারও বিরহে প্রভু
জাগি দিবা নিশি
দিলে না গো চরণেতে ঠাঁই!
কোথা পাবো বলো এমনও মধু শশী!
নিজেকে খুঁজে নাহি পাই।
তোমাতেই শুরু আমি
তোমাতে সমাপন
এত শান্তি আমি কভু দেখি নাই
জনম জনম ওগো
তোমারও শ্রীচরণে
দিও ওগো আমাকেই ঠাঁই॥
পাঁচশটা লোক সত্যি চোখের জল ধরে রাখতে পারল না।