নভেলা গল্প হলেও সত্যি-তে রাজদীপ ভট্টাচার্য – ধারাবাহিক (রু)

দশম পর্ব
শনিবার পাঁচটার মধ্যে পলাশ মহুলিতে পৌঁছে গেল। ঠিকঠাক সময়ে বাস পেয়ে গেলে আসতে আর কতক্ষণ লাগে! নেমে ওইটুকু পথ মোটর ভ্যানে। তবু প্রাকশীতের এই সময় পাঁচটাতেই আলো কমে আসে। রেমি ওকে দেখে উচ্ছ্বসিত। তখন মনেই হচ্ছিল না যে একটা শোকের আবহ বাড়িটাকে ঘিরে রয়েছে।
উপরের ঘরে গিয়ে খানিক ফ্রেস হয়ে নিতে না নিতে রেমি আর ইন্দ্রাণী দুজনেই হাজির। এই মাসদুয়েকেই ইন্দ্রাণীর লুকে একটা অদ্ভুত চেঞ্জ এসেছে। সেই ধারালো তীক্ষ্ণ মুখাবয়ব এখন যেন লাবণ্যে ভরপুর। দেখে খুব ভালো লাগলো পলাশের। ও জিজ্ঞেস করল — আগামীকাল স্মরণসভার সব ব্যবস্থা রেডি?
রেমি বলল — তা একরকম হয়েছে। সকাল এগারোটা নাগাদ শুরু করে দেব। একটায় লাঞ্চ। তারপর যেটুকু চলে। তিনটে – সাড়ে তিনটের মধ্যে শেষ করে ফেলতে হবে যাতে কারুর ফিরতে অসুবিধা না হয়।
ইন্দ্রাণী বলল — রতন দা তোমার পরোটা আনছে। তারপর চা দেব দুজনকেই। তোমরা কথা বল। আমার এখন বসলে হবে না। ঘুরে আসছি।
ইন্দ্রাণী যেতেই রেমি হাসিমুখে বলল — একটা গুডনিউজ আছে।
— তাই! বাহ… কী শুনি…
— আজই কনফার্ম হয়েছি। শি ইজ ক্যারিং।
— মানে? কার কথা বলছ?
— কার কথা আবার বলব! ইন্দ্রাণী… মাই ফাদার ইজ কামিং ব্যাক… আজ সকালে আমি নিজে টেস্ট করে পজিটিভ রেজাল্ট পেয়েছি। হা হা… কালকের ব্যস্ততাটা কাটলেই ডাক্তার দেখাব।
— মেনি কনগ্রাচুলেশনস্ ব্রাদার। খুব ভালো খবর। ভীষণ আনন্দ পেলাম। তাই ওকে যেন আজ আরও মিষ্টি দেখাচ্ছে।
আরও অনেক কথা, ভাবনা স্রোতের মতো বলে যাচ্ছিলো রেমি। কিন্তু একটা বালির দানার মতো সন্দেহ পলাশের মনে কিরকির করে উঠছিল। রেমির কথায় কৃত্রিম ‘হুঁ-হ্যাঁ’ করছিল বটে কিন্তু মন পড়েছিল অন্যত্র। ইন্দ্রাণীর সাথে একবার সামনাসামনি কথা বলতে হবে। সেই রাতের পরে প্রায় মাসদুয়েক কেটে গেছে। ইন্দ্রাণী কিছু আড়াল করছে না তো!
দ্রুত চা খেয়েই উঠে পড়ল রেমি। বলল — কাল নিচের স্টুডিওতে সবার বসার ব্যবস্থা হয়েছে। দেওয়ালে বাবার আঁকা কিছু ছবি রাখছি। তুমি ধীরে সুস্থে পারলে এসো নিচে। আমি এখন গেলাম। রতন দা কতদূর গুছিয়েছে দেখি গিয়ে।
ঘন দুধের কড়া চা। আরাম করে একটু একটু করে শেষ করল পলাশ। তারপর বেরুতে যাবে এমন সময় ইন্দ্রাণী এলো। মুখে হাসি। ঘরে ঢুকেই বলল — রেমির কাছে কিছু শুনলে?
— হুম, শুনলাম। কিন্তু তোমার সঙ্গে কথা আছে। দ্যাখো, সবটা আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সেদিনের সেই ঘটনার সাথে ব্যাপারটা জড়িয়ে যাচ্ছে না তো?
— জড়ানোর তুমি আমি কে? যা হয় তা ভালোর জন্যই হয়। গীতা পড়োনি?
— ইয়ার্কি মেরো না। এটা একটা সিরিয়াস ব্যাপার। বিষয়টাকে তরল করে দিও না। পরিষ্কার বলো সেই রাতের জের কি তুমি শরীরে বহন করে চলেছ?
— মনে তো হয় তাইই…
— রেমি! সে কিছু বলেনি?
— কী বলবে? ও খানিকটা আন্দাজ করেছে নিশ্চয়ই। তবে ও খুব খুশি।
— এটা শুধু খুশি থাকার বিষয় নয় ইন্দ্রাণী। একটা জীবনের প্রশ্ন। এর গুরুত্ব অপরিসীম। আজ সে খুশি কিন্তু আগামীতে সেইই প্রশ্ন তুলবে… তোমার কাছে জবাবদিহি চাইবে…তখন?
— শোনো, মাসখানেক আগেই যখন প্রথম পিরিয়ড বন্ধ হল তারপরে আমি নিজেই ঘরে টেস্ট করেছিলাম। পজিটিভ রেজাল্ট পেয়ে আমি নিজেও একটু ঘাবড়ে গেছিলাম প্রথমটায়।
— তখন আমাকে বললে না কেন?
— বলে কী হতো? উলটে তুমি টেনশন করে মরতে।
— তাবলে এত বড় একটা ডিসিশন আমাকে জানাবে না?
— দ্যাখো তোমার নিজের জীবন পড়ে আছে। এর সাথে তোমার না জড়ানোই ভালো। যেই আসুক, আমি তার মা এবং রেমি তার বাবা হয়ে ওঠার জন্য একরকম মুখিয়ে রয়েছে।
— তুমি বললেই কী সব দড়ি ছিঁড়ে ফেলা যায়? আফটার অল আমি তো একজন মানুষ।
— অবশ্যই। মনে কর তোমার একটা চিহ্ন আমাদের কাছে গচ্ছিত রইল। কোনোদিন কিছু দাবি করতে এসো না শুধু। একটা বিনি সুতোর বন্ধন মনে মনে যত্ন করে লুকিয়ে রেখো।
★★★
রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবছিল পলাশ। জীবন কত দ্রুত বদলে যায়। শূন্যের ভিতরে কীভাবে প্রাণ সঞ্চার ঘটে। এই পৃথিবী এই সৌরমণ্ডল এই মহাবিশ্বের বুকে একজন ব্যক্তি মানুষের চিন্তা ভাবনা উৎকণ্ঠা ভালবাসা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে থাকে! একটা প্রাণ আসছে। আজ পলাশ যদি ইন্দ্রাণীকে জোর করে অ্যাবর্ট করতে সেই অধিকার কি ওর আদৌ আছে? একটা জীবন মানে এই বিশ্বকে প্রত্যক্ষ করার একটা সুযোগ। এই বাতাসে শ্বাস নেওয়া, এই জলে তৃষ্ণা নিবারণ করা, এই মাটি – পাথরের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা। তাকে রোধ করার পলাশ কে?
অনেক অনেক বড় কোনো ইচ্ছে এই জগতের প্রতিপালক। তাকেই কল্পনার সুবিধায় আমরা সুপার পাওয়ার, ভগবান, আল্লা, গড এমন হাজার নামে ডাকি। মানুষ আর কতটুকু জানে! গোটা মহাজগতের অতি সামান্য অংশ সে দেখতে পায়। আর তার গতিবিধি সীমিত আরও নগন্য রেখায়। তাই সে ইচ্ছেকে খণ্ডন করার ক্ষেত্রেও মানুষের ভূমিকা যৎসামান্য। একটা প্রাণের সঞ্চার মানে একটা উৎসব। ঘটনাচক্রে পলাশ তার ভিতরে জড়িয়ে গেছে। তাই জগতের নিয়মেই সে চলুক। যা হবার তা হবেই, সে পলাশ আশা করুক আর না করুক।
হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ ঢোকে যান্ত্রিক ইঙ্গিতে। রুনা মেসেজ করেছে। আজ দুপুরের পরে আর কথা হয়নি ওর সাথে। সাধারণত রাতে একবার ফোন করে, আজ আর করে ওঠা হয়নি। রুনা লিখেছে, পৌষমেলায় আমরা চার-পাঁচজন শান্তিনিকেতন যাবো। তোমাকে সব ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
— সে করে দেওয়া যাবে। কিন্তু আগে থেকে ডিটেইলস জানিও। কবে আসছ আর ঠিক কজন আসছ।
— আমি তোমাকে কাল বলে দেব। আমার খুড়তুতো দাদা – বৌদি আর এক বোন কনফার্ম।
— ক্যামেলিয়া আসবে নাকি? কী সর্বনাশ!
— না না। মিলি দি’র বাচ্ছা খুবই ছোটো। ও যাবে না।
— তাও ভালো। ও এলে মাথা খারাপ করে ছাড়বে।
— তোমাকে কিন্তু থাকতে হবে আমাদের সঙ্গে। আমরা কেউই আগে যাইনি। কিচ্ছু চিনি না, জানিও না।
— আমার থাকাটা শাস্ত্রসম্মত হবে তো? কিংবা স্বাস্থ্যসম্মত?
— খালি বাজে কথা। প্রতিদিন রাতে রামকৃষ্ণ কথামৃত পড় মন দিয়ে।
— এরমধ্যে আবার রামকৃষ্ণ কেন! আসছ প্রি-হানিমুনে। সবাই মিলে বেশ জ্যোৎস্না রাতে শাল বনে বেড়াতে যাব
— আর গিয়ে বেশ পৌষের শীতল সমীরণে জমে বরফ হয়ে যাব
— উফফ, রসভঙ্গের মাস্টারনি।
— বহু কষ্টে বাড়িতে রাজি করিয়ে শান্তিনিকেতন যাওয়ার প্ল্যান করছি, আর তুমি এখনই জ্যোৎস্না রাতে শাল বনে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা ভাঁজছ। এবার সবটাই রসগোল্লা হয়ে গেলে বুঝবে। এখন বাই।
— বেশ, টা টা।