অথ শ্রী উপন্যাস কথায় আরণ্যক বসু (পর্ব – ৮)

শালজঙ্গলে বারোমাস ছয়ঋতু

উন্মনা তোর উন্মনা মন
বাসের জানালায়,
শালজঙ্গল , দূর দিগন্ত
ডাকছে–কাছে আয়…

যতটা ভোরে সম্ভব উন্মনা তার মায়ের বাড়ির আঁচল ছেড়ে , ঘুমন্ত মেয়ের কপালে আলতো চুমু খেয়ে , মাকে বারবার উনকুটি সব বুঝিয়ে দিতে দিতে , বেড়ার গেটে হাত রাখলো। শেষবার ব্যাগে হাত চালিয়ে দেখে নিলো, স্মার্টফোন , হেডফোন ,খাতা, পেন, ছোট্ট টিফিন বক্স, আর জলের বোতল ঠিকঠাক আছে কিনা । যতদূর চোখ যায় , মা হাত নাড়তে থাকলো আর উন্মনা প্রাণপণে মন শক্ত করে , পিছনের দিকে না তাকিয়ে , বাস রাস্তার দিকে পা বাড়িয়ে দিলো । ও জানে , পিছনে তাকালেই তোয়ার ঘুমন্ত মুখটা নড়ে উঠে বলবে– মা তুমি শিগগির ফিরে এসো। সব দ্বিধা কাটিয়ে গতকাল রাত বারোটার কাছাকাছি ব্যাগপত্র গুছিয়েছে উন্মনা। অনুষ্ঠান পরিচালনার সব ভার ওর উপর দিয়ে দিয়েছে মেঘলাদি প্রলয় আর শুভব্রত , বিশেষ করে প্রলয়। কাল রাত এগারোটা পর্যন্ত প্রলয় ওদের রাতের খাওয়ার বর্ণনা দিচ্ছিল। আর আজকে কি খাওয়া হবে সেটাও বলে যাচ্ছিল । ও আর শুভব্রত , দুজনে মিলেই ওকে রিসিভ করবে ঝাড়গ্রাম বাসস্ট্যান্ডে। সকাল দশটার ব্রেকফাস্ট টেবিলে সবাই নাকি ওকে চাইছে । সে খাওয়ার বর্ণনাও উন্মনা শুনে ফেলেছে কাল রাতেই , যেহেতু প্রলয়ের উদ্দেশ্যই ছিল দিদিভাইকে নিয়ে আসা। গরম কড়াইশুঁটির কচুরি , ধনেপাতা দেওয়া ছোট আলুর দম , সঙ্গে কড়া ভাজা ঘোর প‍্যাঁচালো জিলিপি , আর জয়নগরের স্পেশাল মোয়া । আগে চা পরে কফি। ঠিক এগারোটার সময় অনুষ্ঠান শুরু হবে । কাজেই , এই বাসে যাওয়ার সময়টাই উন্মনার পড়াশোনার প্রহর । প্রায় দৌড়ে এসে ঝাড়গ্রাম ঝাড়গ্রাম বলে চেঁচানো বাসটাকে ছুঁয়ে ফেলে, ভেতরে গিয়ে দেখে যেন তারই জন্য কন্ডাক্টার সযত্নে একটা জানলার দিকের সিট রেখে দিয়েছে । শীতের তরুণ সূর্য সবে তখন আড় ভাঙছে। কুয়াশায় প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না । ওর মন খারাপ হয়ে গেল । বাসের জানলায় যদি আবছা জঙ্গল আর ওই দূরের নীল পাহাড়ের রেখা নাই দেখা গেল , তাহলে সেটা কেমন বাসজার্ণি ? মনে হবে যেন কলকাতার পথে ধর্মতলা থেকে গড়িয়া পর্যন্ত চলেছে। কিন্তু না , টিকিট কাটার কিছুটা পরেই হঠাৎ বাঁদিকের জানলাটা কুয়াশার অবগুন্ঠন খুলে দিলো। সঙ্গে সঙ্গেই উন্মনার অবাক চোখের সামনে টাইগার হিল থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার মত বাঁদিকে ভেসে উঠলো চেনা শাল জঙ্গল আর একটা আস্ত পাহাড়ের কুয়াশা, নাকি মেঘ ঢাকা অবয়ব ! দেখতে দেখতে বাসটা একটা হালকা জনপদে থামলো । রবিবারের বাজার তখনও জমেনি। দু একটা চায়ের দোকান থেকে কাঠের আগুনের ধোঁয়ার গন্ধ আসতেই , ওর মনটা চায়ের জন্য আকুল হয়ে উঠলো। সে কথা বুঝতে পেরেই যেন প্রৌঢ় দোকানদার দোকানের এক সহকর্মীকে বলল — যা দিদিভাইকে এক ভাঁড় চা দিয়ে আয়। পয়সা মিটিয়ে দিতেই গরম চায়ের ভাঁড়টা যেন ওকে সুপ্রভাত জানালো । বাস ছাড়ার আগেই , ছোট্ট টিফিন বক্সে মায়ের হাতের তৈরি ডিম পাউরুটি , আর এক টুকরা নরম কালাকাঁদ ওকে খানিকটা চাঙ্গা করলো ; বিশেষ করে চা। বাস আবার এগোতেই একটা আবছা জঙ্গলের মধ‍্যে ঢুকে পড়লো।সঙ্গে সঙ্গে বনের আদিম শ‍্যামলিমা ওর কানে কানে বললো– ভাগ‍্যিস এই পথে এলে ! তোমার জন‍্যেই তো অপেক্ষা করছিলাম গো ! অরণ্যের নিবিড়ে বনস্পতির গায়ে শীতের পরজীবী লতারা তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। ঘুম থেকে ওঠেনি বুড়ো সজারু কিংবা ছোট্ট পাটকেলে রঙ খরগোশের দল। আর , শেয়ালগুলো বোধহয় সবাই নাইট ডিউটির পর ঘুমোতে গিয়েছে। জঙ্গল পেরিয়ে আবার ধুধু তেপান্তরের মধ্যে দিয়ে বাস চলেছে ।পাহাড়টা এখনও দেখা যাচ্ছে। আচ্ছা ঝাড়গ্রাম আর কত দূর ? কন্ডাক্টর হেসে বললো– ওখানে গিয়েই বাস থেমে যাবে দিদি। ঘন্টাখানেক নিশ্চিন্ত । আপনি ঘুমিয়ে নিতে পারেন। বাংলা না হিন্দি গান ? কি শুনবেন ? চালিয়ে দেবো ? উন্মনা মাথা নাড়িয়ে বললো– না । তার কারণ একটা ছিল। এমন নয় যে , উন্মনা গান ভালোবাসে না । মেয়েবেলা থেকে মায়ের বাড়িতে ওর পড়ার টেবিলে থাকতো ছোট্ট ট্রানজিস্টার। সেখানে প্রাত্যহিকি থেকে বাংলা খবর, অনুরোধের আসর , শুক্রবারের বাংলা নাটক , বিবিধ ভারতীর গানের বন্যা তরঙ্গের মতো বইতো। সে গানের জোয়ার তার পড়ার টেবিল থেকে মায়ের রান্নাঘর পর্যন্ত প্রাণের কল্লোল তুলতো। হৃদয় আকুল করা রবীন্দ্রনাথের গান — তুমি ডাক দিয়েছো কোন সকালে, কেউ তা জানে না…
আরো অনেক রাতে, উন্মনা যখন পড়ার শেষে মাকে খাবার দিতে সাহায্য করতে যেত , তখনও রেডিওতে বাজতো — আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে , চাও কি ?
হায় বুঝি তার খবর পেলে না…
সেই উন্মনা এখন বাসের মধ্যে গান চালাতে বারণ করছে । কারণটা আর কিছুই নয় , এই খানিকটা পথ ওকে ওর খাতার পাতায় মনোনিবেশ করতে হবে। পাতায় পাতায় লেখা রবীন্দ্রনাথের বাণী, নজরুলের কবিতার লাইন, ইংরিজি গীতাঞ্জলির উদ্ধৃতি, আরো অনেক একালের কবির কখনো না ভুলতে পারা কবিতার লাইন। আর আছে প্রাণের দুই কবি — সুকান্ত আর জীবনানন্দ। আজকের অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত কথা বলা যাবে না ,আবার কিছু না বলাটাও বেমানান। মেঘলাদি অনেক আশা নিয়ে ওকে ভারটা তুলে দিয়েছে। মাঝখানে আবার কবিতাও বলতে হবে। আচ্ছা , কর্মশালা ব‍্যাপারটা কেমন হবে ? খুব কি গম্ভীর গম্ভীর কিছু ঘটনা ? চোখের সামনে খাতার একটার পর একটা পাতা উল্টে যাচ্ছে আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় ; অথচ পরীক্ষার আগে যেমন খাতা দেখলেও কিছু মাথায় ঢোকে না , ঠিক তেমনই অবস্থা হচ্ছে এই মুহূর্তে আমাদের উন্মনার। মনটা খালি চলে যাচ্ছে ঝাড়গ্রামের দিগন্তে। ঝাড়গ্রাম নামটাই কি অদ্ভুত আকর্ষণীয় , তাই না ? ঝাড় মানে তো জঙ্গল , আর গ্রাম । সেই ঝাড়গ্রাম নিয়ে ওর মনে প্রথম রূপকথা তৈরি করেছিল ওর বাবা । থিয়েটারে অভিনয় করা ছিল উন্মনার বাবার একটা প্যাশন। বার দুয়েক অতীতের ঝাড়গ্রামে ওর বাবা এসেছিল। ভোরবেলা স্টেশনের কাছে আদিবাসী মেয়েদের ঢেঁকি ছাঁটা চাল আর গাঢ় খয়েরি রঙয়ের টোপাকুল বিক্রি করবার গল্প শুনেছে বাবার কাছে । তখন নাকি স্টেশনের দুপারে বেশ আবছা-ঘন জঙ্গল ছিল । লোধাশুলির দিকটা ছিল খুব নির্জন । আজকের আধুনিক ঝাড়গ্রাম কতটা পাল্টে গেছে , বাবার তা দেখে যাওয়া হলো না । বেশ কয়েকবার ওদের নিয়ে আসার কথা ছিল ঝাড়গ্রামে ছুটি কাটাতে । কলকাতার অনেক বাবুদের শখের বাড়ি তখন ভাড়া দিত টুরিস্টদের জন্য। মধুপুর , দেওঘর যেমন দেওয়া হয় , সেরকম আর কি। বাবার কাছে ঝাড়গ্রামের গল্প শুনে নিজের মনে রূপকথা বুনেছে উন্মনা । তারপর মেদিনীপুর কলেজে পড়ার সময় শিক্ষামূলক ভ্রমণে স‍্যারেদের সঙ্গে ওরা একদল ছেলেমেয়ে এসেছিল ঝাড়গ্রামের দিগন্তে। তখনও ফ্লাইওভার হয়নি , রেলগেটে ঝাঁক বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকতো গাড়ি , আর চোখের সামনে দিয়ে দুরন্ত গতির এক্সপ্রেস বম্বে রোডের মতোই উধাও হয়ে যেত দূরের দিকে। দ্বিতীয় দিন সকাল দুপুর পুরোটাই কেটেছিল রাজবাড়ি,ডিয়ার পার্ক , লোকালয় ছাড়িয়ে প্রায় গহন বনের মধ্যে। চিল্কিগড়ে এসে গা ছমছমে পরিবেশে কনকদূর্গার মন্দির । মন্দিরের একটু নিচে দিয়েই বয়ে চলেছে উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত ডুলুং নদী । নদী ,জঙ্গল , উধাও আকাশ , অরণ্যের রহস্যময়তা– সবমিলিয়ে চিল্কিগড় একটা চিরকালীন ছবি হয়ে থেকে গেছে ওর মনের ক্যামেরায়। ওদের তোলা ছবিগুলো অ্যালবামের পাতায় এতদিনে বোধহয় বিবর্ণ হতে শুরু করেছে , শুধু বর্ণহীন হয়নি উদার হৃদয় স‍্যারেদের মুখ ,পড়াশোনা ও দামালপনা একসাথে করতে জানা , একগুচ্ছ চিরদিনের বন্ধুদের স্মৃতি । চিল্কিগড়ের আবছা জঙ্গলে বসে সমরেশের গলায় আশ্চর্য নাটকীয়ভাবে বেজে উঠেছিল–পান্না রঙের মান্না-সংগীত–
লাল নীল সবুজের মেলা বসেছে ,লাল নীল- সবুজের মেলা রে ,আয় আয় আয়রে ছুটে খেলবি যদি আয়, নতুন সে এক খেলা রে…
গানটা শেষ হতে না হতেই নীলাঞ্জনার বেদনাবিধুর গলায় ফুটে উঠেছিল ওই চিরদিনের ছবিরই আরেকটি মুগ্ধ সংগীত–
ফুল পাখি বন্ধু আমার ছিল, আর চাঁদ তারা বন্ধু আমার ছিল, তারা সব কোথায় গেল, কোথায় গেল ,হারিয়ে কোথায় গেল ,তারা সব কোথায় গেল…
কারোর চোখ তখন শুকনো ছিল না, কারণ , তার অনেক আগে থেকেই জঙ্গলনিধন শুরু হয়েছে নির্বিচারে। কিছু মানুষের লোভ যেমন অরণ‍্য ধ্বংস করছিল , ঠিক তেমনই জঙ্গলের স্তব্ধতাকেও কুঠারের আঘাতে ভেঙে খান খান করে দিচ্ছিল। বনদেব , বনদেবী কত হাজার হাজার বছর ধরে মহা-ভারতের বুকে অরণ‍্যানি বুনে গেছে । আর্য , অনার্য আমাদের দেশের প্রাচীনতম আদিবাসীরা সবাই মিলে বুক দিয়ে সে অরণ্যকে রক্ষা করেছিল । মনে পড়লো আরণ্যক উপন্যাসের কথা– জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দুলকি চালে ঘোড়া ছুটিয়ে আসার সময় লেখক কখনো তো বাঘ বা ভালুকের মুখোমুখি হননি । বন্দুকের গুলির আঘাতে ছিন্নভিন্ন করেননি কোনো বনমোরগকে , কোনো উড়ন্ত পাখিকে । পরবর্তীকালে কারা এত পশু নিধনের উল্লাসে মাতলো ? মানুষের হিংস্রতা এমন জায়গায় পৌঁছলো কেন , যে বনের পশুরা মানুষকে ভয় পেতে শুরু করল ? তারা অরণ্যের গভীর থেকে আরো গভীরে পৌঁছে গেল ! মানুষের পায়ের ছাপ তো গোটা পৃথিবীর মানচিত্রটাকেই চষে ফেলেছে। ইঞ্চি থেকে মিলিমিটার পর্যন্ত !আজ আর পালাবার জায়গা কোথায় ? তাই এই চিল্কিগড়ের জঙ্গলেও হয়তো ভালুক পরিবার হোটেলের উচ্ছিষ্ট খাবার জন্য আর মানুষের কাছাকাছি আসে না, যেন একটা গভীর ও তীব্র অভিমানে । তারা এবং গাছপালা ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এখন অবশ্য নিবিড় বনসৃজন প্রকল্পে মানুষের শুভচেতনা অনেক বৃক্ষরোপণ করেছে এবং করছে । কিন্তু সেগুলোকে দেখলে বড্ড সাজানো মনে হয় , মনকে টেনে নিয়ে যায় না। মনে হয় না ,বাস থেকে নেমে এক দৌড়ে অরণ্যের মধ্যে হারিয়ে যাই ! সেবার খুব বিষণ্ণ মনে ঝাড়গ্রাম থেকে মেদিনীপুরে ফিরেছিল উন্মনাদের সেই সজীব ও প্রাণচঞ্চল তারুণ্য । সবাই মনে মনে এই প্রতিজ্ঞা করেছিল যে , অরণ্যকে বাঁচাতেই হবে। বনদেবী আর বনদেবতাকে অরণ্যেই লতাপাতার রাজপ্রাসাদ গড়ে দিতে হবে । যেখানে ঘন শ্রাবণে , গাছের পাতা চুঁইয়ে অজস্র জলধারা , রুক্ষ মাটিকে শ্যামল সুন্দর করে দেবে । মানুষের উগ্র চাহনিকে নম্র করে দেবে । হাতের নিষ্ঠুর কুঠার থেমে যাবে । কোনো শিকারীর বন্দুক আর গর্জন করবে না…
ভাবতে ভাবতে কখন উন্মনার চোখে ঘোর নেমে এসেছে, ও নিজেই জানে না । হঠাৎ বাসের সাউন্ড সিস্টেমে বেজে উঠলো– দাদার কীর্তির গান , না না আসলে রবীন্দ্র সংগীত– চরণ ধরিতে দিও গো আমারে..
নিও না নিও না সরায়ে.. বাসটা একটু আলতো ঝাঁকুনি দিয়ে , গান শেষের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই যেখানে থামলো , উন্মনা চেয়ে দেখলো– জানলার ফ্রেমের ঠিক নিচেই সরলতা ও দুষ্টুমি ভরা দুটো মুখ ওর দিকে তাকিয়ে । হাত নাড়ছে দুই তরুণ কবি — শুভব্রত আর প্রলয় । শুভব্রত খুব নাটকীয়ভাবে বলে উঠলো– স্বাগতম , শুভ স্বাগতম। তোমার সঙ্গে কি লাগেজ আছে ? আজ কিন্তু ফেরা হচ্ছে না। কাল আমরা বেলপাহাড়ি হয়ে আমলাশোল , ঘাঘরা আর বাঁশপাহাড়ি যাবো । ব‍্যাগটা দাও । সাবধানে নামো দিদিভাই…

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।