ক্যাফে গল্পে কথাকলি

দ্বিরাগমন
দ্বিরাগমনে এসেছে মৌঝুরি। আয়নায় নিজেকে অপরিচিত লাগছে তার এ কয়দিনেই। কাঁচা হলুদের গন্ধ যেনো এখনো যায় নি গায়ের থেকে। বিকেলে কল তলায় লুকিয়ে দেখা হলো লিটুর সাথে। মৌএর বিয়েরদিন কোথায় লুকিয়ে ছিলো কে জানে! এখন বিয়ের পর মায়ের কড়া নির্দেশ আগের মতো টঁই টঁই করে এবাড়ি ওবাড়ি একদম নয়। এখানে বাপের বাড়ি এসেও স্বস্তির নিঃশ্বাস নেওয়ার জো নেই। বিরাটী ফিরে যাওয়ার আগের দিন আবার দেখা দুজনের। মৌঝুরির চোখে অভিমানী জল। হাতে একটা ছোট্ট কাঠের বাক্স তার গায়ে অনেক যত্নে চুমকি আর রঙিন কাগজ দিয়ে কারুকার্য করা। ভিতরে দুটো ছোট্ট মাটির পুতুল বর-কনে। মেলায় কিনেছিলো অনেক শখ করে। আজ নিজের হাতে বাক্স আর পুতুলদুটো সাজিয়েছে। আবার কবে দেখা হবে কি জানি তাই নিয়ে এসেছে লিটুকে দেবে বলে। শাড়ির আঁচলের ভিতরে লুকিয়ে রাখা জিনিসটা এগিয়ে দিলো লিটুর দিকে। লিটুর চোখে তখন আনন্দাশ্রু। দুজনের কোনো কথা হলো না। মৌ নিঃশব্দে পিছন ফিরে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। মা তখন উঠোনে জল ছিটে দিয়ে সন্ধ্যে প্রদীপ দিচ্ছে তুলসীতলায়। পাশের বাড়িতে যূথিকাদি তানপুরায় করুণ সুর তুলে খামাজ রাগে “আয়ো কাঁহাসে ঘনশ্যাম” গান ধরেছে। মৌ পশ্চিমদিকের বারান্দার সামনের উঠোন পেরিয়ে পেয়ারা আর আমগাছের তলায় বেদীটাতে গিয়ে অল্প কিছুক্ষণ বসলো। দূরে তখন রাঙা দিগন্তে সূর্যটা গোল থালার মতো খুব ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। আরো একটা দিনের শেষ হয়ে আসছে। রাঙা আকাশটার দিকে তাকিয়ে মৌ এর মনটা কেমন হু-হু করে উঠলো। মাথার ওপর গাছে গাছে ঘরে ফেরা পাখপাখালির কিচির মিচির। এক সপ্তাহ আগেও এই সময়ে মৌ সারাটা বিকেল লিটুর সাথে খেলা করে এক পা ধুলো নিয়ে কলপাড়ে এসে পা ধুয়ে তারপর পড়তে বসার আয়োজন করতো। ভাবতেই কেমন অদ্ভুত লাগছে। আরেকটু পরে সন্ধ্যের আঁধার গাঢ় হয়ে এলে মৌ ধীর পায়ে ঘরে চলে এলো। ওর ছোটো ভাইটা তখন ঘরের ভিতর দুলে দুলে বাংলা কবিতা মুখস্থ করছিলো। মৌ হাতপা ধুয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ওর মায়ের সাথে সন্ধ্যের চা জলখাবারের ব্যবস্থা করতে শুরু করলো। বাইরে ঘরে ওর বাবা আর বর সোহাগ তখন দূরদর্শনে খেলা দেখতে ব্যস্ত। কিছুদিন আগেও চিত্রটা অন্যরকম ছিলো। আঠেরো বছরের কিশোরী মৌ এখন পাটভাঙা জুবুথুবু শাড়ীতে জড়ানো এক নতুন বৌ…যার ওপর সংসারের অনেক অযথা দায় দায়িত্ব।
পরেরদিন রিক্সায় উঠবার আগে উঠোনে একবার থমকে দাঁড়ালো মৌ। মন যেনো কাকে খুঁজে চলেছে। পিছনে একলা পরে কাঁদছে ওর ছেলেবেলার উঠোন, অনেকগুলো অশান্ত দুপুর, ধুলোকাদা মাখা বিকেল,সাজানো খেলনাবাটি আর পুতুল বর-কনে। শেষ বেলার আলোয় ফলসা গাছের বাহারি পাতায় তখন রঙের খেলা। নীল আকাশের বুকে ইলেক্ট্রিকের তারে ছেঁড়া ঝুলন্ত ঘুড়ি। ফলসা পাতার ফাঁকে থোকা থোকা কালো মিশমিশে ফল ঝুলে রয়েছে। ঠিক তার কিছুক্ষণ পরেই মৌ এর রিক্সাটা অনেক দূরে মোড়ের মাথার বাঁকে মিলিয়ে যাওয়ার আগে দূর থেকে শেষবারের মতো দেখে নিলো লিটু। বুক ভরা আশা নিয়ে পকেট ভর্তি ফলসা আর মায়ের দেওয়া আমসত্ত্ব মৌকে দেবে বলে দৌড়ে এসেছিলো। শেষরক্ষা আর হলো না।একটুর জন্য দেওয়া হলো না। দেওয়া হলো না আরও একটা জিনিস। একটা খুব সুন্দর কলম। স্কুলের টিফিনের পয়সা থেকে কিছু জমিয়ে কিনেছিলো লিটু। মৌ খুব সুন্দর কবিতা লিখতে পারে। শুধু লিটু জানে সে কথা আর কেউ জানে না। এমনকি ওর বাড়িতে কেউ জানে না এ কথা। কতোদিন বিকেলে লোকোনদের পুকুরঘাটে বসে মৌ ওর নিজের লেখা কবিতা পড়ে শুনিয়েছে লিটুকে। এই তো সেদিনের কথা। আজ সব যেনো কেমন মিথ্যে হয়ে গেলো। অকালে ঝরে গেলো দুটি কিশোর মন, বুকে নিয়ে কিশোরবেলার অবুঝ ভালোবাসা।