ভ্রমণগদ্যে অঞ্জলি দে নন্দী

শ্রী লঙ্কা ভ্রমণ
ভারত থেকে কাছেই। প্রতিবেশী দেশ শ্রী লঙ্কা ভ্রমণ করে যে আনন্দ পেয়েছি তা তো আর লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ও যে অবর্ণনীয়। তবুও যেটুকু পাড়ি দিলুম।
প্রথম দিন : দিল্লী বিমান বন্দর থেকে আমাদের কর্তা ও গিন্নির যাত্রা শুরু হল। তারিখ – ২৭.০১.২০২৪ – রাত্রি ১০.১০- এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ধরলাম … ২৮ তারিখে ০১.৫০ এ কলম্বো বিমানবন্দরে পৌঁছালাম। অন লাইনে ঠিক করা, আমাদের ড্রাইভার তার গাড়ি নিয়ে বাইরে অপেক্ষায় ছিল। তার হাতে ধরা একটি লাঠির সঙ্গে আটকানো একটি শক্ত কাগজে, (খানিকটা পতাকার মত), তাতে আমাদের দু জনের নাম লেখা ছিল। সেটা দেখে – এসে ওর কারে চড়লাম।
সকাল ৮ টা পর্যন্ত নেগম্বোর একটি হোটেলে সংক্ষিপ্ত থাকার ব্যাবস্থা ছিল ।
দ্বিতীয় দিন: ক্যান্ডির (Kandy) উদেশ্যে রওনা দিলাম এবং আমাদের পথে আমরা হাতির এতিমখানা (Elephant Orphanage) পরিদর্শন করলাম ।
আমরা দুজনে ওখান থেকেই দুটো ফলের ঝুড়ি কিনে, নিজের হাতে হাতির মুখে ফল দিলাম ।
হাত জোড় করে হাতিদের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, “আমাদের আশীর্বাদ কর, যেন আমরা সারা বিশ্ব ভ্রমণ করতে পারি!” ওরা অপলক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল আর এর একটু পরে শুঁড় তুলে আমাদের মাথা স্পর্শ করল। একই সঙ্গে তারা তাদের বিরাট কানগুলোও দোলাতে লাগলো।
এই সময় ওখানে উপস্থিত হাতির চালকদের হাতে আমাদের মোবাইল ফোন দুটি দিয়ে বললাম, “আমাদের ফটো ও ভিডিও করে দিন !” ওরা করে দিল।
কলম্বো থেকে ক্যান্ডি পর্যন্ত দূরত্ব ১১৬ কিমি – ক্যান্ডি পৌঁছে, আমরা নীলা কিভাবে মাটির নিচে থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং পরে তা থেকে কিভাবে রত্নরূপে প্রস্তুত করা হয়, সে সব দেখলাম। নীলা বসানো একটি রূপর আংটি কিনলাম, Pure Gem And Jewellery, Kandy থেকে……..এরপর স্পাইস গার্ডেন, বুদ্ধ মন্দির, লেক এবং চারপাশের পাহাড়ের রাজকীয় দৃশ্য দেখলাম। তারপরে পাহাড়ের চূড়ায় সিলোনি প্যানোরামা রিসর্টে চেক ইন করলাম ।
ওখানকার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে সন্ধ্যায় ক্যান্ডিআন নৃত্য দর্শন করলাম ।
তৃতীয় দিন : ক্যান্ডি থেকে ডাম্বুলা পর্যন্ত দূরত্ব – ৯০ কি.মি | ওখানে দেখলাম, ডাম্বুলা – সোনার মন্দির, সিগিরিয়া লায়ন রক (রামায়ণ অনুসারে, এই প্রস্থরের ওপরে রাবণ রাজার রাজপ্রাসাদ ছিল), গোরুর গাড়ী চড়ে গ্রাম সাফারি করলাম, ওখানেই জলের ওপর বোটিং করলাম। তারপরে ওই গ্রামের একটি মাটির ঘরে, গ্রামের মহিলাদের দ্বারা, কাঠের আগুনে রান্না করা – স্থানীয় খাবার লাঞ্চ করলুম। ঘরটির আশেপাশের লজ্জাবতী গাছকে ছুঁয়ে বেশ আনন্দের সঙ্গে সেই আগের বালিকা বেলায় ফিরে গেলুম। তখন আমি বঙ্গের, হুগলীর, চৈতন্যবাটী গ্রামে থাকতুম। মেঠো পথে হাঁটতে হাঁটতে এভাবেই প্রকৃতির সঙ্গে এক হয়ে যেতুম। এখন কিন্তু আমি প্রৌঢ়া। আর সেই গ্রাম ছেড়েছি ১৯৮৬ তে। যা হোক, এরপরে ক্যান্ডির হোটেলে ফেরত আসলাম।
চতুর্থ দিন: নুওয়ারা এলিস – ৯৫ কিলোমিটারের জন্য যাত্রা শুরু হয়েছে। এটি আমাদের উটির মতোই একটি হিল স্টেশন। এখানে রয়েছে প্রচুর চা বাগান। আমরা ড্যামরো চা বাগানে থামলাম এবং চা তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটি দেখে গেলাম। আমাদের পথে একটি স্ট্রবেরি খামার রয়েছে তবে আমাদের ভারতের, মহারাষ্ট্রের পঞ্চগনি এবং মহাবালেশ্বরে আরও ভাল স্ট্রবেরি ক্ষেত রয়েছে। আমাদের চারপাশের দৃশ্য দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছিলাম। পথে আমরা হনুমান মন্দির দর্শন করেছি। নুওয়ারায় সীতা আম্মানের মন্দিরও রয়েছে। বিশ্বাস করা হয় যে রাবণ এই স্থানে সীতাকে বন্দী করে রেখেছিলেন। যেখানে যিনি তাঁর চোখের জল ফেলেছিলেন। এখানে বসে বসে বসে অপেক্ষা করেছিলেন – মুক্তির, উদ্ধারের জন্য। ……. ওখানে একটি নদী বইছে । অবশেষে আমরা নুওয়ারায় আমাদের হোটেলে পৌঁছলাম। সেখানে রাত্রি যাপন করলাম।
পঞ্চম দিন: নুওয়ারা থেকে বেনটোটা পর্যন্ত দূরত্ব ২১০ কিমি, আমাদের যাত্রা শুরু হল। শুধুমাত্র পাহাড়ি এলাকায় প্রায় ১৫০ কিমি সর্পিল রাস্তার কারণে এটি বেশ ক্লান্তিকর ভ্রমণ ছিল। অবশেষে পৌঁছে গেলুম বেনটোটা কচ্ছপের হ্যাচারিতে। এটিতে বিভিন্ন বয়সের এবং ওজনের কিছু বিরল কচ্ছপের সংগ্রহ রয়েছে। এটিতে দুটি সাদা কচ্ছপ রয়েছে যা মিলিয়নে এক হিসাবে বিবেচিত হয় এবং তাদের একটি মাত্র এক কেজি এবং অন্যটি কুড়ি কেজি। এটি আশি কেজি পর্যন্ত ওজনের অন্যান্য কচ্ছপ রয়েছে। বেনটোটা একটি সমুদ্রতীরবর্তী এবং এটি Galle পর্যন্ত প্রসারিত…… সমুদ্রতীরের এই সমগ্র এলাকাটি ৫০ কি.মি প্রসারিত….. শুধুমাত্র সমুদ্র সৈকতের মত দেখায়…..এরপরে আমরা আমাদের রিসোর্টে ফিরে এসে আরাম করলাম। এটি নদীর ধারে একটি সুন্দর রিসোর্ট। বারান্দা থেকে আরাম কেদারায় বসে নৌকো বাওয়া দেখছিলাম।
ষষ্ঠ দিন : ০১.০২.২০২৪ – খুব ভোরে যাত্রা শুরু হয়েছিল, মেদু গঙ্গা নদী সাফারির জন্য। প্রায় এক ঘন্টার মত আমরা ম্যানগ্রোভের মধ্য দিয়ে নদীর ওপর একটি স্পিডবোটে চলেছি। নদীর ধারে প্রায় ৬৬টি ছোট দ্বীপ রয়েছে। বেশিরভাগ খালি দ্বীপ। মাত্র ৬টি দ্বীপে কিছু লোক বাস করে। দারুচিনি তাদের আয়ের প্রধান উৎস। তারা দারুচিনি কীভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয় তাও প্রদর্শন করেছে। আমরা এখান থেকে দারুচিনি কাঠের ছাল, গুঁড়ো ( পাউডার ) এবং এই গাছের থেকে পাওয়া তেলের কিছু নমুনাও কিনে নিয়েছিলাম। এই তেল শারীরিক ব্যাধি সারায়। ওরা কপালে, পায়ে, হাতে মালিশ করে দিল। পরে আমরা মিরিসা সমুদ্র সৈকতে গেলাম যাকে কোরাল বিচও বলা হয়। মানুষ এখানে স্নরকেলিং করতে যায়। এখান থেকে আমরা গ্যালে চলে আসি। শ্রীলঙ্কার আরেকটি শহর। তাদের এখানে একটি দুর্গ এবং ক্রিকেট স্টেডিয়াম আছে। বেনটোটা থেকে গ্যালে প্রায় ৫০ কি.মি। বিকেল ৩টায় আমরা রিসোর্টে ফিরে আসি। দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিলাম। বিকাল ৫.৩০ নাগাদ আমরা বেনটোটা সমুদ্র সৈকতে গেলাম। খালি পায়ে ভিজে বালিতে হাঁটা আর মাঝে মধ্যেই নোনা জলের ছোঁয়া। সুন্দর হাওয়ায় শ্বাস নিতে নিতে মনে হচ্ছিল, সত্যিই এ পৃথিবী কলুষহীন। তারপরে স্থানীয় কেনাকাটা করলাম। হোটেলে ফিরে সারাদিন বিশ্রাম নিলাম।
সপ্তম দিন : ০২.০২.২০২৪। হোটেল নেলি মেরিন আমরা যাত্রার চূড়ান্ত পর্বের জন্য কলম্বোতে যাত্রা শুরু করি। এটি প্রায় ৫০ কি.মি। কলম্বোতে হোটেল থেকে স্নান করে – পায়ে হেঁটে ( কাছেই ) কলম্বো রামকৃষ্ণ মিশন গিয়ে ঠাকুরের সামনে বসে সেদিন আমার স্বামী শ্রী জয়ন্ত কুমার দে আমার বাঁ হাতের মধ্যমা আঙুলটিতে আগে থেকে কেনা নীলার আংটিটি পরিয়ে দিল। আমি তার স্ত্রী শ্রীমতী অঞ্জলি দে, তখনও পর্যন্ত উপবাস করে ছিলুম। এবার ওখানকার স্বামীজি আমাদের প্রসাদ দিলেন। যেন মনে হল আমার ইষ্ট দেব ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ পরম হংস দেব আমাকে এখানে এনেছেন। আমি তো ওনার নাম জপ করি। যখন কলকাতার রাম মোহন কলেজে পড়তাম ও ওই কলেজের লেডিস হোস্টেলে থাকতাম তখন ফার্স্ট ইয়ারে ( ১৯৮৬ ) তে বেলুড় মঠে আমার দীক্ষা হয়। আর এতো বছর পরেও ঠাকুর আমাকে বুঝিয়ে দিলেন যে, দূরত্ব কোন ভক্তির বাধা হতে পারে না। সারা বিশ্ব জুড়ে উনি তাঁর ভক্তদের সঙ্গ দেন আজও। আমার পতি ও পুত্র নতুন দিল্লীর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষা নিয়েছে। আমি ঊনিশ বছর বয়সে নিয়েছি। আমার স্বামী আমার সঙ্গে বিয়ে হবার পর নেয়। আমার ছেলের জন্ম ওর বাবার দীক্ষা নেওয়ার ঠিক এক বছর পর হয়। পয়লা চৈত্র ও দীক্ষা নিল। আর তার পরের বছর দোসরা চৈত্র আমাদের ছেলে ভূমিষ্ঠ হল। আমার সুপুত্র যখন ক্লাস নাইনের ছাত্র তখন দীক্ষা নেয়।
এরপর আমরা হোটেলে এসে বাঙালির প্রিয় লুচি আর আলুর দম খেলাম। কলম্বো সৈকত দর্শন করেছি। আর দেখেছি, লোটাস টাওয়ার, ৩৬৫ মিটার উঁচু যার ২৯ তলা রয়েছে – দ্রুত লিফট সহ আপনাকে ৪৫ সেকেন্ডে উপরে নিয়ে যাবে। ৩ রা ফেব্রুয়ারী শ্রীলঙ্কার জাতীয় দিবসের কারণে অনেক রাস্তা বন্ধ থাকায় আমরা অনেক জায়গায় যেতে পারিনি।
অষ্টম দিন : ০৩.০২.২০২৪ – স্থানীয় কলম্বো শহর ভ্রমণ। গঙ্গারাময়া মন্দির পরিদর্শন। এটি একটি বৌদ্ধ মন্দির ও একটি যাদুঘর – এখানে রত্ন, গহনা, ভিন্টেজ গাড়ি এবং হাতির tusk.ivory সংগ্রহ করা আছে। পরিদর্শন করেছিলুম স্বাধীনতা স্কোয়ার, ভাসমান বাজার, জাতীয় জাদুঘর, স্থানীয় বাজার এবং ভিক্টোরিয়া পার্ক।
নবম দিন ০৪.০২.২০২৪ – কলম্বো থেকে হায়দ্রাবাদ হয়ে মুম্বাই যাওয়ার ইন্ডিগো ফ্লাইটে বিমানবন্দরে স্থানান্তরের জন্য কলম্বোতে হোটেল থেকে চেক আউট করা হয়েছিল। ভারতের, মুম্বাইয়ের সাকি বিহার রোড, আন্ধেরি ( পূর্বের ), ফ্যাব হোটেল – ড্রিম রেসিডেন্সিতে (মুম্বাই) – এখানে বিশ্রাম নিয়েছিলাম। হ্যাঁ, রাত ১১টায় মুম্বাইয়ের এই হোটেলে পৌঁছালাম এসে আমরা। খেয়ে, ঘুমিয়ে পড়লাম।
এরপরের দিন মুম্বাই ঘুরলাম। শ্রী সিদ্ধি বিনায়ক মন্দির। গেট ওয়ে অফ ইন্ডিয়া। মহালক্ষ্মী মন্দির। একটি উবের ট্যাক্সী ভাড়া করে নিয়েছিলুম। দুপুরে রেস্টুরেন্টে ঢুকে খেয়েছিলুম। দিনে ঘুরে সন্ধ্যের সময় এরোপ্লেন চড়ে নতুন দিল্লী রওনা দিলুম।