সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব – ৭৪)

পুপুর ডায়েরি
প্রথম কদম ফুলের ও গল্প হয়।
স্নান যাত্রার সময় থেকেই মেঘলা আকাশ চিরকাল লোভ দেখিয়ে হাত ছানি দেয় পুপুকে
বিশেষ করে, গরমের ছুটির শেষ দিকটা।
দুপুর বেলায়।
আবার শীত পেরিয়ে রাস পূর্ণিমা আসে যখন, তখনও।
কদম ফুলের প্রতি মেয়েটার অনেক দিনের লোভ।
হলুদ রঙ গায়ের ওপর এই যে সাদা সাদা রোঁয়ার আস্তরণে, যেন রোদের রশ্মির মত, নাকি গোল পূর্ণিমার চাঁদের মতন, সারা গাছ আলো করে ফুটে থাকে।
পুপুর ঠাকুমা রাসের মেলা থেকে ট্যামটেমি কিনে দেন।
একখানা মাটির সরার ওপরে পাতলা কাগজ সাঁটা। সে কাগজের ওপর, আলতার মত কি জানি রঙ দিয়ে আঁকিবুঁকি করা থাকে । ফুলের মত আলপনা।
মাটির সরার নিচে পাতলা কাঠের এক জোড়া চাকা লাগানো । আর পাতলা বাখারির টুকরো তিন কোনা করে লাগানো থাকে ওই পাতলা কাগজের ওপরে।
ট্যামটেমির চাকার পাশ দিয়ে লম্বা দড়ি বাঁধা।
দুটো ছোট কঞ্চির টুকরো আটকে রাখা আছে তিন কোনা বাখারির গায়ে।
আজব যন্ত্রখানা।
দড়ি ধরে টানলেই ট্যামটেমি এগিয়ে চলে মালিকের পিছু পিছু।
তিন কোনা বাখারির সাথে বাঁধা কঞ্চি ওঠে নামে চাকা ঘোরার সাথে।
পাতলা কাগজের গায়ে আওয়াজ ওঠে,
ট্যামট্যাম ট্যামট্যাম।
আরও কতকিছু কিনে পাঠান ঠাকুমা।
ছোট ছোট পোড়া মাটির হাঁড়ি কড়া উনুন পুতুল, শিল নোড়া ও। এই সব পাওয়া যায় রাসের মেলাতে।
রাস বললেই মেয়েটা জানে কদম ফুল। আর আষাঢ় মাসে যখন মেঘের ছায়া ঘন হয়ে ঘিরে আসে। তখনও। কদম ফোটে। আর বকুল ফুলের গন্ধ ঘনিয়ে থাকে রেল লাইনের গা ঘেঁষে, লেকের পাঁচিল ধরে।
বকুল ফুলে ছেয়ে থাকে লেকের ভেতরের লাল ইঁটের রাস্তা। তারা পৌঁছে দেয় সারি সারি লোহার দোলনা, যার পিঁড়ির মত কাঠের বসার জায়গা।
পৌঁছে দেয় ছোটো লোহার স্লিপ, আর মস্ত বড়ো সিমেন্ট দিয়ে বানানো স্লিপের সামনে।
স্লিপ আর দু দিকের সারি সারি দোলনার মাঝে একটা সিমেন্ট দিয়ে বানানো বাচ্চা লেক ছিলো ছোটোদের জন্য।
একেবারে ছোটো বেলায় পুপু তাতে জল ভর্তি হতে দেখেছে।
কিন্তু, একটু বড়ো হতে হতে, সে আর জল ভরা হত না।
ছোটোরা এমনিই দৌড়ে দৌড়ে খেলত সেই ঢালু ঘেরা গোল জায়গায়।
বাকি সব খানে সবুজ ঘাসের কার্পেট।
তার ওপরে খালি পায়ে দৌড়োতে কী আরাম!
কিন্তু মা বকেন।
খালি পায়ের তলায় নাকি ফুটো থাকে। চটি না পড়লে ঘাসের মধ্যে থেকে পোকার ঢুকে পেটে অসুখ বাধাবে।
পুপুকে যে কত কিছু মেনে চলতে হয়।
ওরে বাবা রে বাবা।
আর কারো মায়েরা এইসব বলে না।
কিন্তু মাকে কিছু বলার সাহস ও নেই পুপুর।
মা তো চেঁচামেচি করেন না।।
খালি আস্তে আস্তে মোটা গলায় বিজ্ঞান বোঝান। শুদ্ধ সাধু ভাষায়।
তার ওপরে তর্ক ও চলে না।
খুবই মুশকিল।
অফিস থেকে ফিরে, বাবা গান ধরেন রাতের পূর্ণ চাঁদের আলোয়।
বলেন রাস মানে বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়া।
তারপর কেমন মিষ্টি মায়াবী হাসি হেসে বলেন, মা গো, মাটির পৃথিবীতে রাস মানেই মৃত্যু।
অক্রুর রথ নিয়ে রওনা হবেন পর দিন সকালে যে।
কিন্তু সে অন্য গল্প।
সে এতো আগে আগে ভাবতে নেই।
রাসে গলানো রুপোয় ভেসে যায় চারদিক।
সবই পূর্ণ। সবই মধুর। গোপা মধুরা গাবো মধুরা। মথুরাধিপতি র অখিলং মধুরম।
মেয়েটা সংস্কৃত অত বোঝে না।
খালি বাবার গলাটা আর গানটা ভারি মিষ্টি, সেই বুঝে ভিতরে ভিতরে নতুন গুড়ের তালশাঁসের মত মিষ্টি রসে ভর্তি হয়ে ওঠে।
গলানো রূপোয় ভেসে যায় চার দিক।
সে দিকে তাকিয়ে মেয়েটার ভিতরে ছবি ফোটে।
ঝাঁকড়া চুলের শ্যামলা ছেলে একটা।
মাথায় ময়ূরপাখা গোঁজা। হলুদ ধুতি।
বাঁশির সুর।
আড় বাঁশি কি?
ইস্কুলে ক্লাস টেন ছুঁয়ে, মেয়েটা ভাবে, কই সে দিন ত রাস ছিলো না।
সে দিন তো রাখীপূর্ণিমা ছিলো। তাকে রাখী দিয়েছিলাম। আর তাইতেই কেন যেন চটমটে চলে যাচ্ছিলো।
আরে মাথা খারাপ নাকি?
তবে যে ও পাড়ার রোগামতো ছেলেটাকে তখন ডাকতে গিয়ে, যেই তার কনুইয়ের কাছে হাত রাখলাম আর কদম ফুলের রোঁয়ার মত কাঁটা কাঁটা হয়ে উঠলো সে ?
সে ত সন্ধ্যেও নয়।
নেহাৎ গোধুলির আলো বিকেলে।
তপাদাদের ছাদে।
তবে ?
মানুষ কি ফুলের মতই ফোটে ?
সেই ছেলেটা আমায় কি যেন বলতে পিছু ডেকেছিল বটে।
আমার কেমন অস্থির লাগছিল ভিতরে, তাই দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে এসেছিলাম।
পুপু ভাবে, আমি যে পড়াশোনার ফাঁকে নিজেদের ছাদে উঠে এইসব সাত পাঁচ ভাবি ;কি রকম গরম লাগে কেন, কানে গলায়?
জ্বর আসে নাকি ?
কিন্তু এত সবে শ্রাবণ ভাদ্র।
এখনো ত হিম পড়ে না।
খালি ছাদের এত বড় আকাশে তারাদের ভারি ভালো লাগে।
হাওয়া দিলে মনে হয়, কি মিষ্টি!
ঠাকুমা বলেন ফুলন্ত কদম বৃক্ষের নীচেই রাস হয়, আর বর্ষাকালে ঝুলনের দোলনা দোলে।
তবে মানুষ কদম ফুল হয়ে ফুটলে তার ভিতরেও উৎসব হয় কি ?
আলোয় থই থই করে চারদিক…