অথ শ্রী উপন্যাস কথা-তে সুতনু হালদার – ধারাবাহিক (অন্ধকারের উৎস হতে)

(তিন)
এই বছর মোটামুটি গরমটা বেশ জাঁকিয়েই পড়বে বলে মনে হচ্ছে। জয়িতা সকাল নটার মধ্যে রেডি হয়ে স্কুলে যাবার জন্য বেরিয়ে পড়ে, তারপর সারাদিনটা তুষার ডুবে যায় নিজের লেখার মধ্যে। দুপুরের দিকে টিফিনের সময়, নিয়ম করেই জয়িতা একবার ফোন করে তুষারকে। স্নান, খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দ্যায়, তুষারের ওষুধগুলো সে ঠিকঠাক খেয়েছে কিনা এইগুলো ভালো ভাবে ব’লে এবং শুনে যেন জয়িতা নিশ্চিন্ত হতে চায়। অবশ্য এর সঙ্গে আরও কিছু ক্যাজুয়াল কথা বলে সে ফোনটা রেখে দ্যায়। তুষার জানে প্রতিদিন মিনিট দুয়েকের জন্য হলেও জয়িতার এই ফোনটা আসবেই। শত ব্যস্ততার মধ্যেও সে ফোন করতে ভোলে না। তুষার ঠিক মতো স্নান খাওয়া করল কিনা, ওষুধপত্র খেয়েছে কিনা, এটা নিয়ে সে সব সময় চিন্তিত। গতবছর তুষার বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ভরতি ছিল, দিব্য সুস্থ একটা মানুষ এমন অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে, সেটা কী তুষার নিজেও ভাবতে পেরেছিল! অনিয়মিত জীবনধারণ, বাউণ্ডুলেপনা বিসর্জন না দিলে কোনও ওষুধই তুষারকে ভালো করতে পারবে না, এই কথা ডাক্তার স্পষ্টভাবেই জয়িতাকে জানিয়েছিল। সেই যাত্রায় তুষার বেঁচে ফিরলেও জয়িতার কোপ অনেকাংশেই পড়ল তার লেখালেখির ওপর। আজকাল তাই তুষারের লেখার টাইম বদলে গেছে, জয়িতার বেরনোর পর থেকে শুরু আর সন্ধে নাগাদ জয়িতার ফিরে আসার আগে পর্যন্ত চলে এই সৃজনশীলতা। তবে সেটা জয়িতা পুরোপুরি জানে না। জয়িতা জানে সারাদিনে তুষার ঘন্টা তিন চারেকের বেশি লেখালেখিতে ব্যয় করে না। সুতরাং জয়িতা বাড়ি ফেরার পর থেকে লেখালেখির পাটাপাট এ-বাড়িতে তুষারের একদম বন্ধ। যদিও তার অনুপস্থিতিতে তুষার যে লেখালেখি করে, সেটা জয়িতা খুব ভালো করেই জানে। তাই সে ওই তিন চার ঘন্টা সময় নিজে থেকেই তুষারকে বেঁধে দিয়েছে। এই সময়টাতে সে কোনও আপত্তি করে না। সারাটা দিন কাটাতে কিছু তো একটা করতে দিতে হবে লোকটাকে, তাছাড়া লেখা ছাড়া তুষারের পক্ষে যে বাঁচা অসম্ভব সেটাও জয়িতা বিলক্ষণ জানে। তুষারের লেখা কবিতার অমোঘ টানেই তো একদিন মানুষটাকে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিল জয়িতা। সেই দিনগুলোকে সে এখনও ভোলেনি।
ভোলেনি তুষারও। বাংলা ভাষার সহায় সম্বলহীন একজন কবিকে ভালোবেসে, নিজের নিশ্চিন্ত জীবন ত্যাগ করে, তার সঙ্গে বেরিয়ে আসার ঝুঁকিটা যে খুব একটা কম নয়, সেটা বোঝার বুদ্ধি তুষারের যথেষ্ঠই ছিল।আর ছিল বলেই জয়িতাকে সে বারবার সিদ্ধান্ত বিবেচনা করতে বলেছিল।জয়িতা শোনেনি। প্রত্যেকবারই সে বলেছিল, ‘সিদ্ধান্ত তার অনেক আগেই নেওয়া হয়ে গ্যাছে। এখন সেখান থেকে ফিরে আসার পথ নেই। তাই এই মুহূর্তেই সে বাড়ি ছাড়তে ইচ্ছুক।‘
তুষার আর কিছু বলার সাহস পায়নি। সে রাজি হয়ে গিয়েছিল। তখন সে মোটামুটি একটা বানিজ্যিক কাগজে প্রুফ রিড়ারের চাকরি করে। জয়িতা স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বিয়ের আগে থেকেই জয়িতা প্রচুর টিউশনি করত। তাছাড়া বেশ কয়েকটা টিউটরিয়াল হোমের সঙ্গেও যুক্ত ছিল। দু’জনের রোজগারের টাকায় কোনোরকম সংসারটা চলে যাবে, শুধুমাত্র এই ভরসাতে সেই সময় জয়িতা এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। তুষারের দ্বিমত পোষণ করার কোনও অবকাশ আর ছিল না। ওদের বিয়েটা হ’ল নিতান্ত ঘরোয়াভাবে, অনাড়ম্বর রেজিস্ট্রী ম্যারেজের মাধ্যমে। দু’চারজন মাত্র নিমন্ত্রিত। বিয়ের পর জয়িতার টিউশনগুলো দুরত্বের কারণে আর রাখা সম্ভব হয়নি, কিন্তু বিয়ের পর তাদের নতুন বাসার কাছে ভাগ্য জোরে নতুন কয়েকটা টিউশন পেয়েও গিয়েছিল, আর টিউটোরিয়াল হোম থেকে যা উপার্জন হত তার সঙ্গে তুষারের সামান্য উপার্জিত অর্থেই শুরু হ’ল তাদের নতুন জীবন-সংগ্রাম।
অবশ্য মাস ছয়েকের মধ্যেই জয়িতা স্কুল সার্ভিস কমিশন মারফত শিক্ষকতার একটা চাকরি পেয়ে গিয়েছিল, আরও তিনমাস পরে চাকরির অ্যাপ্রুভাল হয়ে বেতন শুরু হবার মাসেই তুষারের চাকরিটা চলে গিয়েছিল; চলে গিয়েছিল বলা ভুল, জয়িতাই চায়নি তুষার ওই চাকরিটা করুক। তুষার লিখুক, প্রাণভরে লিখুক, এটাই চেয়েছিল জয়িতা। তুষার শুধু বলেছিল,’ চাকরি ছেড়ে দিয়ে তোমার ঘাড়ে বসে বসে খাব জয়ি! এটা কী ঠিক হবে?’
জয়িতা তুষারের দিকে নরম হাসিতে তাকিয়ে বলেছিল, ‘বসে বসে খেতে তো বলছি না তোমাকে, আমি লেখাটাকেই তোমার আসল কাজ বলে মনে করি । তুমি লেখো। বাকিটা আমি সামলে দেব।‘
-‘তোমার ওপর অনেক বেশি চাপ পড়ে যাবে। তাছাড়া লোকে কী ভাববে বলত?’
-‘কী ভাববে গো?’
-‘ভাববে একটা দামড়া গরু বসে বসে বউয়ের পয়সায় খাচ্ছে, আর শুয়ে বসে আরামে দিন কাটাচ্ছে।‘
-‘বেশ, তেমন কেউ যদি তোমার কান ধরে এসে বলে তো তাকে তুমি তোমার নতুন একটা কাব্যগ্রন্থ উপহার দিয়ে, মন দিয়ে পড়ে, একটা রিভিউ লিখতে বলো। কেউ গালি দিলে যেমন তাকে গোলাপ ফুল দিয়ে তাচ্ছিল্য করতে হয়, তেমন আর কী…’
-‘কিন্তু এই কথা আমার বিবেক যদি আমাকে বলে, তাহলে তাকে কী দেব জয়ি?’
জয়িতা অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ তুষারের দিকে তাকিয়ে বলল,’কবিদের কিন্তু সংকীর্ণ হলে চলে না, আমি যে তুষার সেনের কবিতা পড়ে তার প্রেমে পড়েছিলাম, তাকে ভালোবেসেছিলাম, নিজের ঘর বাড়ি, বাবা-মা, ভাই, সবাইকে ছেড়ে চলে আসার ভরসা পেয়েছিলাম, সে কিন্তু সংকীর্ণ কোনও মানুষ নয়। আদ্যপান্ত একজন সৎ কবি; যে নিজের লেখার ওপর আত্মবিশ্বাসী; আমি নিজেও তার ওপর নির্ভরশীল। এমন কথা বলে তুমি আমায় হারিয়ে দিও না প্লিজ।‘
তুষার আর কথা বাড়ায়নি, জয়িতাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলেছিল, ‘যদি তুমি তোমার বাড়ির কথা শুনতে, আর তোমার বাবার পছন্দ করা পাত্রকে বিয়ে করতে, তাহলে আজ তোমার কিন্তু…’
তুষারের বুকে মাথা গুঁজে জয়িতা পরম নিশ্চিন্তে বলে উঠল, ‘থামলে কেন? কী হত বাড়ীর কথা শুনলে?’ বলেই একটা চিমটি দিল তুষারের পিঠে।
তুষার ‘উফফ…’ করে হেসে উঠল।
জয়িতা বলল, ‘ অনেকদিন পরে খেলে তো, তাই একটু আস্তে দিলাম। এই রকম কথা বললে কিন্তু আর আস্তে দেব না, চিমটি এমন জোরে কাটব যে নিজেই এসব বলতে ভুলে যাবে।‘
এরপর তুষার বানিজ্যিক কাগজে তার চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি লেখায় আত্মনিযোগ করতে পেরেছিল। কবিতা দিয়েই তার সাহিত্য জীবনের শুরু হয়েছিল। বিয়ের সময়েই সে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত কবি। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলা কবিতার বইয়ের যা কাটতি, তাতে টাকা পয়সা ছাড়া বাকি সবই মেলে। তবে কিছু সহৃদয় সম্পাদক কবিকে লেখক বানাতে সদা সচেষ্ট থাকেন। এমন সম্পাদক তুষারের ভাগ্যেও জুটে গেল! আর তুষারেরও তখন নতুন সংসার, বউয়ের ঘাড়ে বসে বসে খেতে একটু হলেও তার পৌরুষে লাগছে, ফলে সে দুহাত খুলে লিখতে শুরু করে দিল। আস্তে আস্তে গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, ভ্রমণ কাহিনী, রম্যরচনা প্রভৃতি অনেক কিছুই তার হাত দিয়ে অবিরত বেরতে লাগল। পাঠক মহলে সেগুলো সমধিক জনপ্রিয়তাও পেল। জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গেই তার লেখার চাহিদাও বাড়তে থাকল, হোক না বাংলা ভাষা! একবার নাম হয়ে গেলে বইয়ের কাটতি উত্তরোত্তর বেড়েই চলে। সেই চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে তুষারকেও অত্যন্ত বেশি মাত্রায় পরিশ্রম করতে হচ্ছিল। জয়িতা মাঝে মাঝে বারণ করলেও তুষার শুনত না। ফলত যা হাবার তাই হ’ল। এত অত্যাচার শরীর সইবে কেন?একরাতে হঠাৎ মৃদু সেলিব্রাল অ্যাটাক। তুষার তখন মাত্র পঁয়তাল্লিশ।
এই লকডাউনেও জয়িতাকে দু’দিন স্কুলে যেতে হ’ল। লকডাউনের জন্য উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষা স্থগিত করে দেওয়ার পর, মার্চ মাসের তেইশ তারিখ আর এপ্রিল মাসের একুশ তারিখ জয়িতাকে স্কুল যেতে হ’ল। মিড ডে মিলের চাল আর আলু অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং ভাগাভাগি করে স্কুলের কিছু কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মীদের এই কাজটা করতে হচ্ছে। ফলত সারা রাজ্যের অসংখ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মীর মতো জয়িতাকেও যেতে হ’ল নিজের কর্মস্থলে। সে অবশ্য নিজের স্কুটি হাঁকিয়ে স্কুলে গেল। শেষবার অবশ্য স্থানীয় বিডিও অফিস থেকে তাদের একটা পাস ইস্যু করা হয়েছে। যার ফলে রাস্তায় তাদের কেউ আটকাবে না। তেইশে মার্চ স্কুল যাবার সময় অস্বাভাবিক তেমন কিছু একটা চোখে পড়েন জয়িতার, কিন্তু একুশে এপ্রিল যখন সে স্কুল অভিমুখে রওনা দিল, তখন সাড়া রাস্তাটা কেমন যেন গা ছমছমে ফাঁকা। সর্বত্র যেন একটা হাহাকার করা শূন্যতার করাল গ্রাস থাবা বসিয়েছে বলেই মনে হতে লাগল। স্কুলে এই তার এই অনুভূতির সঙ্গে প্রায় সকলেই সহমত হ’ল। ঝুমাদি একটু ঠোঁককাটা মানুষ। কোনও কিছুই চেপে রাখতে পারে না। অপ্রিয় সত্যকথা স্পষ্টাস্পষ্টি বলে দ্যায় বলে অনেকেই তাকে অপছন্দ করে। কিন্তু জয়িতার ভালো লাগে ঝুমা দিকে। তাদের মধ্যে সম্পর্কও ঠিক সহকর্মীর মতো নয়। বেশ একটা মিষ্টি বন্ধুত্ব আছে ওদের। ঠিক আর একজনের সঙ্গেও এমন মিষ্টি একটা বন্ধুত্ব আছে তার।
ইতিমধ্যে স্কুলে অভিভাবকরা আসতে শুরু করেছেন। অভিভাবকদের জন্য গতকালই স্কুলের মধ্যে সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং মেন্টেন করার জন্য চক দিয়ে স্থান নির্ধারিত ছিল, সেইগুলো কঠোরভাবে লক্ষ্য রেখে তাঁদের হাতে সরকারি নির্দেশিকা মতো মিড-ডে-মিলের চাল আর আলু তুলে দেওয়া শুরু হ’ল। কোনও কোনও অভিভাবকের মাস্ক ছিল না, স্কুল থেকেই তাদের হাতে নতুন একটি করে মাস্কও তুলে দেওয়া হ’ল। সমস্ত কাজ শেষ হতে প্রায় তিনটে বেজে গেল। জয়িতার বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল চারটের কাঁটা ছুঁয়ে গেল।