সম্পাদকীয়

কয়েকদিন আগেই অন্নপূর্ণা পুজো গেল । এই ভয়াবহ সময়ে দাঁড়িয়ে মনে হয় মা অন্নপূর্ণা তো জাতের তফাত করেন নি । তিনি চাইলে তো
মায়াবলেই নদী পার করতে পারতেন । তাঁর নামে তো ভবের খেয়া পারাবার পার করে । আর সেই নির্লোভ মাঝিকেও প্রণাম করি যে সন্তানের দুধভাতটুকু ছাড়া কিছুই চাওয়ার কথা ভাবতে পারল না । আজ সেই অন্নদা মঙ্গলের কিছু অংশ রইল ।
অন্নপূর্ণা উত্তরিলা গাঙ্গিনীর তীরে।
পার কর বলিয়া ডাকিলা পাটনীরে॥
সেই ঘাটে খেয়া দেয় ঈশ্বরী পাটনী।
ত্বরায় আনিল নৌকা বামাস্বর শুনি॥
ঈশ্বরীরে জিজ্ঞাসিল ঈশ্বরী পাটনী।
একা দেখি কুলবধু কে বট আপনি॥
পরিচয় না দিলে করিতে নারি পার।
ভয় করি কি জানি কে দিবে ফেরফার॥
ঈশ্বরীরে পরিচয় কহেন ঈশ্বরী।
বুঝহ ঈশ্বরী আমি পরিচয় করি॥
বিশেষণে সবিশেষ কহিবারে পারি।
জানহ স্বামীর নাম নাহি ধরে নারী॥
গোত্রের প্রধান পিতা মুখবংশজাত।
পরমকুলীন স্বামী বন্দবংশখ্যাত॥
পিতামহ দিলা মোরে অন্নপূর্ণা নাম।
অনেকের পতি তেঁই পতি মোর বাম॥
অতিবড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ।
কোন গুণ নাহি তাঁর কপালে আগুন॥
কুকথায় পঞ্চমুখ কণ্ঠভরা বিষ।
কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ॥
গঙ্গা নামে সতা তার তরঙ্গ এমনি।
জীবনস্বরূপা সে স্বামীর শিরোমণি॥
ভূত নাচাইয়া পতি ফেরে ঘরে ঘরে।
না মরে পাষাণ বাপ দিলা হেন বরে॥
অভিমানে সমুদ্রেতে ঝাঁপ দিলা ভাই।
যে মোরে আপনা ভাবে তার ঘরে যাই॥
পাটনী কহিছে আমি বুঝিনু সকল।
যেখানে কুলীন জাতি সেখানে কোন্দল॥
শীঘ্র আসি নায়ে চড়, দিবা কিবা বল।
দেবী কন দিব, আগে পাড়ে লয়ে চল॥
যার নামে পার করে ভবপারাবার।
ভাল ভাগ্য পাটনী তাঁহারে করে পার॥
বসিলা নায়ের বাড়ে নামাইয়া পদ।
কিবা শোভা নদীতে ফুটিল কোকনদ॥
পাটনী বলিছে, মাগো বৈস ভাল হয়ে।
পায়ে ধরে কি জানি কুম্ভিরে যাবে লয়ে॥
ভবানী কহেন তোর নায়ে ভরা জল।
আলতা ধুইবে পদ কোথা থুইব বল॥
পাটনী বলিছে মাগো শুন নিবেদন।
সেঁউতি উপরে রাখো রাঙ্গা চরণ॥
পাটনীর বাক্যে মাতা হাসিয়া অন্তরে।
রাখিলা দুখানি পদ সেঁউতি উপরে॥
বিধি বিষ্ণু ইন্দ্র চন্দ্র যে পদ ধোয়ায়।
হৃদে ধরি ভূতনাথ ভূতলে লুটায়॥
সে পদ থুইলা দেবী সেউতি উপরে।
তার ইচ্ছা নাহি ইথে কি তপ সঞ্চারে॥
সেঁউতিতে পদ দেবী রাখিতে রাখিতে।
সেঁউতি হইল সোনা দেখিতে দেখিতে॥
সোনার সেঁউতি দেখি পাটনীর ভয়।
এ তো মেয়ে মেয়ে নয়, দেবতা নিশ্চয়॥
তীরে উত্তরিল তরী, তারা উত্তরিলা।
পূর্বমুখে সুখে গজগমনে চলিলা॥
সেঁউতি লইয়া বক্ষে চলিলা পাটনী।
পিছে দেখি তারে দেবী ফিরিলা আপনি॥
সভয়ে পাটনী কহে চক্ষে বহে জল।
দিয়াছ যে পরিচয় বুঝিনু সে ছল॥
হের দেখ সেউতিতে থুয়েছিলা পদ।
কাঠের সেউতি মোর হইল অষ্টাপদ॥
ইহাতে বুঝিনু তুমি দেবতা নিশ্চয়।
দয়ায় দিয়াছ দেখা দেহ পরিচয়॥
জপ স্তব নাহি জানি ধ্যান জ্ঞান আর ।
তবে যে দিয়াছ দেখা সে দয়া তোমার ।
যে দয়া করিলা মোর এ ভাগ্য উদয়।
সেই দয়া হইতে মোরে দেহ পরিচয়॥
ছাড়াইতে নারি দেবী কহিলা হাসিয়া।
কহিয়াছি সত্য কথা বুঝহ ভাবিয়া॥
আমি দেবী অন্নপূর্ণা প্রকাশ কাশীতে।
চৈত্রমাসে মোর পূজা শুক্লা অষ্টমীতে॥
এতদিন ছিনু হরিহোড়ের নিবাসে।
ছাড়িলাম তার বাড়ি কোন্দলের ত্রাসে॥
ভবানন্দ মজুন্দার নিবাসে রহিব।
বর মাগো মনোনীত যাহা চাহ দিব॥
প্রণমিয়া পাটনী কহিছে জোড়হাতে।
আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে॥
তথাস্তু বলিয়া দেবী দিলা বরদান।
দুধেভাতে থাকিবেক তোমার সন্তান॥
বর পেয়ে পাটনী ফিরিয়া ঘাটে রায়।
পুনর্বার ফিরে চাহে দেখিতে না পায়॥
অন্নদার ভবানন্দ ভবনে যাত্রা।
কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র॥
.
ইন্দ্রাণী ঘোষ।