কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) – নীলম সামন্ত (অন্তিম পর্ব)

মহাভারতের মহানির্মাণ (যাজ্ঞসেন তথা দ্রুপদ)

দ্রোণাচার্য দুঃস্থ হলেও কখনোই লোভী কিংবা মানহীন মানুষ ছিল না৷ তবে বিশ্বাসঘাতকতাও বরদাস্ত করার মতো মন নয়। সেই দিন ভরা রাজসভায় সবার সামনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন এমন শিষ্য তিনি প্রশিক্ষণ দেবেন অর্থাৎ তৈরি করবেন যে বা যারা এসে দেখিয়ে দিয়ে যাবে দ্রোণাচার্যের ক্ষমতা কতটা কিন্তু দ্রোণাচার্য নিজে কখনোই তার বন্ধু তথা গুরু ভাইকে আক্রমণ করবে না।

দ্রুপদের এখানে অহংকার কখনো যে থেমেছে এমনটা দেখা যায় না। তিনি জানতেন তাঁর কন্যা শিখন্ডি গত জন্মের অম্বা এ জন্মে আরো একবার নারীরূপে জন্মেছেন শিবের বরদান নিয়ে যে কিনা মহামহিম ভীষ্ম কে মারবেন কিংবা নিজে ভীষ্মর মৃত্যুর কারণ হবে। এই জ্ঞাত বার্তাটুকু কাজে লাগিয়ে ভেবেছিলেন শিখন্ডি অত্যন্ত বলশালী এবং বুদ্ধিদীপ্ত যোদ্ধা যে তাঁর রাজ্যকে অনায়াসে সমস্ত শক্তি দিয়ে রক্ষা করতে পারবে। এখানে দ্রুপদের মোহ তাকে এত ঘিরে রেখেছে যে বাস্তবিকতা ভুলে গেছে এবং সমস্ত স্থুল চিন্তায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। কারণ শিখন্ডি যেমনই হোক সে তো নারী তাই তার বল যে কোন পুরুষ যোদ্ধার সমান সমান হবে তা কিন্তু নয়। ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ শিখন্ডি হবে এমন অভিশাপ ছিল কিন্তু ভীষ্মর র সাথে শিখন্ডি যুদ্ধ করে জিতবে এমনটা নয়। আর দ্রুপদ ওখানেই ভুল করে ফেলেছিলেন। তৎকালীন আর্যাবর্তে ভীষ্মর মতো যোদ্ধা আরেকটিও ছিল না তাই ভীষ্মর প্রাণ শিখন্ডির কারণে চলে যাবে তাহলে শিখন্ডিকে বলশালী ভাবা যেতেই পারে। অগত্যা পাঞ্চাল বা কাম্পিল্যা নগরীর সেনাপতি হিসেবে আসীন ছিলেন শিখন্ডি৷ যার মধ্যে প্রতি মুহুর্তেই টগবগিয়ে ফুটছে ভীষ্মকে মারার কথা।

দ্রুপদকে এই জায়গায় আমার ভারী মনে হয়েছে যে তিনি কেবল মাত্র ওপর ওপর ভেবে কেবল মাত্র হাওয়ায় ভাসতেই পারেন। শারীরিক বল অভাবের পাশাপাশি তাঁর বুদ্ধি বলও যে অভাব সে কথা স্পষ্টই বোঝা যায়৷

এদিকে দ্রুপদের সাম্রাজ্য নিজের মতো চললেও দ্রোণাচার্য তার অপমান ভোলেননি। তাই অনেক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গিয়ে পঞ্চ পান্ডব সহ কৌরবদের একশ’ ভাইকে অস্ত্র শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুললেন। দীর্ঘ বারো বছর ধরে এই শিক্ষা চলার পর যখন সবকিছু সম্পন্ন হয়েছে বলে জ্ঞাত হল তখন তিনি গুরুদক্ষিণা চাইলেন। এবং গুরুদক্ষিণা হিসেবে দ্রুপদকে হারিয়ে দেওয়ার কথা বললেন।

প্রথমে কৌরবরা গিয়ে আক্রমণ করলেও যুদ্ধে জয়ী লাভ হয় পান্ডবদের। কিন্তু যেহেতু যুদ্ধের নেপথ্যে ছিল দ্রোণাচার্যের প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধ মানসিকতা তাই বলা চলে এখানেই দ্রোণাচার্যেরই জয়। তবে দ্রুপদ এই হার কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি। কারণ তাঁকে পূর্বে দেওয়া কথা অনুযায়ী অর্ধেক সম্পত্তিতে বা রাজ্যে অশ্বত্থামাকে রাজা হিসেবে রাজ্যভিষেক করতে হয়েছিল। মনের সেই অবস্থা যেখানে তিনি ভেঙে চুরে যাচ্ছেন আর সেখানে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মত দ্রোণাচার্য বলছেন দ্রুপদের যেহেতু কোন মেয়ে নেই তাই অশ্বথামাকেই নিজে সন্তান গুনে মেনে নিতে এবং স্বীকৃতি দিতে। সত্যিকারের বন্ধু হলে হয়তো এই প্রস্তাবে মন থেকে খুশি হওয়া যেত কিন্তু স্বার্থের বাইরে তো কোনো বন্ধুত্ব ছিল না কোনদিন। তাই এই কথাগুলো কন্যা সন্তান জন্ম না দেওয়ার গোপন অপরাধ হিসেবে গায়ে যেন কাঁটা ফুটছিল। মানুষ ভাবে এক হয় আরেক। দ্রুপদ যদি সামান্যও সূক্ষ্ম চিন্তায় নিজেকে মশগুল করতে পারতেন তাহলে দ্রোণাচার্যের প্রতি শুরু থেকেই এতটা অবিচার করতে পারতেন না।

এই কাঁটার ফল খুব একটা ভালো হয়নি কারণ অত্যন্ত ক্রোধিত হয়ে শুরু হয়েছিল সেই মহাযজ্ঞ যার উদ্দেশ্য ছিল পুত্র সন্তান লাভের। সত্যিই যুগে যুগে আমাদের পুত্র সন্তান লাভ করার প্রতি মোহ যে কি অসম্ভব তা ধ্রুপদ চরিত্রটি না থাকলে হয়তো এতটাও স্পষ্ট জানা হত না৷ মহাভারত লেখা হয়েছে আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। এবং সেই যুগে যখন দেখানো হচ্ছে মাদ্রি শিখন্ডি গান্ধারী কিংবা ভানুমতির মতো শক্তিশালী মেয়েদের যারা একদা তাদের বাবার রাজ্যে সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। সেই যুগে যেখানে সত্যবতীর মতো এক অসম্ভব নারীর কোথায় হস্তিনাপুরের সিংহাসন চলত। তারপরও বংশ রক্ষার জন্য পুত্র চাই। যেন বংশ রক্ষার জন্য কন্যা না হলেও চলবে। যাজ উপযাজ যখন অক্ষম হয়ে যাচ্ছিল তখন দ্রুপদের মরিয়া হয়ে ওঠার মুহূর্তগুলো স্পষ্ট হয়েছে। অথচ দ্রুপদের সেই ক্ষমতাই নেই দেখি না আরেকটি সন্তান জন্ম দিতে পারে কন্যা এবং পুত্র তো অনেক দূরের কথা।

দৈববাণী হল একটি পুত্র সন্তান এবং একটি কন্যা সন্তান জন্ম হবে। সে যজ্ঞের আহুতি থেকে উঠে আসবে। বাস্তবিকভাবে যজ্ঞের আহুতি থেকে তো আর সন্তান উঠে আসে না, তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে এটি টেস্টটিউব বেবি ছিল। বর্তমানে যেমন টেস্টটিউব বেবি হলে সাধারণত দুটো ডিম্বাণু ফার্টিলাইজ করা হয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় একটি ছেলে সন্তান এবং একটি মেয়ে সন্তান। এরপর কোনটা বাঁচবে কোনটা বাঁচবে না সেটা সময় এবং চিকিৎসার ওপর নির্ভর করে। আর সেই সূত্র ধরে পুরনো দিনেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে যজ্ঞের আহুতি থেকে পুত্র এবং কন্যা সন্তান উঠে আসবে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।