গল্পেরা জোনাকি তে ঋতশ্রী মান্না

সমান্তরাল

-বসি একটু এখানে?
রোদে অনেকক্ষণ হেঁটে এসে দৃশ্যতই ক্লান্ত মেধা। অন্তুর উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে বসে পড়েছিল একটা শালগাছের তলায়। গাছের তলাটা ঝরা শালফুলে হলুদ আলোর মত জ্বলেছিল।
কলেজফেরত ক্লান্ত অন্তু মাঠের ধূলোর ওপরেই শুয়ে পড়েছিল…

হাঁটতে হাঁটতে কখন পিচরাস্তা পেরিয়ে মেঠোরাস্তায় এসে পড়েছিল ওরা। দুপুর ঢলে আসছে নির্জন মাঠে,দূরে আগুনরঙা পলাশ গাছগুলো বসন্ত-প্রহেলিকার মত জ্বলে আছে।

এখনও অন্তুর চুলময় শুকনো ঘাসের কুচি,শুকনো শালফুল–টি-শার্টের পিছনে ধূলো,হলুদ পাতা–দূরে নির্জন শিরিষ গাছের হালকা হলুদ আভার ফুলগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল সে।

মেধা জিজ্ঞেস করল,কিছু বলবেনা?

-যদি বলি থেকে যাও,তুমি কি শুনবে?

-আর কিছুই বলার নেই এটা ছাড়া?

মুখ ফেরায় অন্তু,চশমার কাঁচ পেরিয়ে তার বিষণ্ণ দৃষ্টি এসে পড়ে মেধার মুখে -সত্যিই এর চেয়ে বেশি আর কিছুই বলার নেই এই মুহূর্তে,অন্তত আমার কাছে নেই।

খেয়াল করেনি মেধা এতক্ষণ,অন্তুর গালে একটা ব্রণ উঠছে এবং গালে কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি পেরিয়েও সেটা বেশ স্পষ্ট। অন্তুর অগোছালো চুলের গা ঘেঁষে একটা নীলচে ফড়িং উড়ে গেল বিকেলের নরম আলোর দিকে।

এই মুহূর্তে অন্তুর অগোছালো চুলে লেগে থাকা শুকনো ঘাসগুলো ঝেড়ে দিতে খুব ইচ্ছে করছিল মেধার…অন্তুর ঈষৎ কালচে ঠোঁট অথবা ঠোঁটের গায়ে ঘন হয়ে আসা অভিমান –এসবের ওপর আঙুল ছুঁইয়ে রাখতে বড় ইচ্ছে করছিল, অন্ততঃ কিছুক্ষণের জন্য…

হাওয়া দিচ্ছে। মেধার লাল ওড়নায় ঝরে ঝরে পড়ছে নরম শালফুল।
ওরা অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। কারণ-বলা যায় এরকম কোনো কথা ছিলনা ওদের কাছে।

একটা সময় অন্তু উঠে দাঁড়ায়,কাল ভোরে ট্রেন তো তোমার। চলো,তোমায় ড্রপ করে দিয়ে আমি মেসে ফিরব।

দূরে মেঘ জমেছে। ঘোলাটে আকাশের গায়ে কাটাঘুড়ির মত লাট খেতে খেতে নেমে আসছে সন্ধে। শহরতলি সেজে উঠছে মায়াবী নিয়নে।
…ওরা পাশাপাশি হাঁটে,সমান্তরাল সরলরেখার মত।

অন্তু বলে,চাকরিটা বোধহয় এই মুহূর্তে অতটাও জরুরি ছিলনা তোমার জন্য।

মেধাও জানে,চাকরিটা অজুহাত। এ শহরের গায়ে জড়িয়ে থাকা, শেষ হয়ে আসা গল্পগুলো ভুলে থাকার জন্য এই শহর থেকে দূরে চলে যাওয়াটা জরুরি ছিল। আসলে সে পালিয়ে যেতে চায়,হয়ত বা নিজের থেকেই।

-“এতটাই দূরে চলে যাচ্ছ,হয়ত দেখাই হবেনা আর কখনও…”
অন্তুর গলার স্বর কি সামান্য ভারী লাগে?

মেধা বুঝতে পারে ঠিক এই মুহূর্তে খুব কষ্ট হচ্ছে তার।সেটা কি অন্তুর জন্য?
জানেনা মেধা। শুধু জানে ততটাই কষ্ট হচ্ছে তার,যতটা কষ্ট হলে পা ভারী হয়ে আসে। কঠিন হয়ে আসে ছেড়ে যাওয়া।

হাওয়া বয়,দূরে মেঘের গায়ে দুলে ওঠে চৈত্রপলাশ। তিক্ততার গায়ে দুলে ওঠে নিমফুলের মায়া। কষ্ট বুকে নিয়ে মেঘে মেঘে ভারী হয়ে আসে চৈত্রসন্ধ্যা–বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামে,বহুদিন পর।

তারপর,ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ জুড়ে হেঁটে যেতে থাকে সমান্তরাল সরলরেখারা।

এমন অনন্ত পথ হাঁটতে হাঁটতে অজান্তে কখনও কি তার অসমান্তরাল সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যায়…?

#ঋতশ্রী

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।