অথ শ্রী উপন্যাস কথা-তে সুতনু হালদার – ধারাবাহিক (অন্ধকারের উৎস হত)

(এক)

শ্রাবণীকে সকাল থেকে ফোনে না পেয়ে নির্ঝর একেবারে ভরদুপুর বেলায় শিশিরবাবুর বাড়িতে হাজির। আসা ইস্তক তাকে পাকড়াও করে শিশিরবাবু অপ্রাসঙ্গিক নানা কথার অবতারণা করে চলেছেন এবং একান্ত অনুগত শ্রোতার মতো নির্ঝর সেই ক্লিশে হয়ে যাওয়া কথাগুলোকে হজম করতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু যার জন্য এই বাড়িতে আসা, সেই শ্রাবণীর দ্যাখা সে এখনও পর্যন্ত একবারও পেলো না! অগত্যা শিশিরবাবুর কথাগুলোই সে হাসিহাসি মুখে শুনতে বাধ্য হচ্ছে আর উশখুশ করে এদিক ওদিক তাকিয়ে শ্রাবণীকে খুঁজে চলেছে। কিন্তু শ্রাবণীর দ্যাখা পাওয়া তো দূরে থাক, তার কোনও সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছে না!
-‘তুমি কি কিছু ভাবছ নাকি নির্ঝর?’ শিশিরবাবু বললেন।
‘হুম! কই! না-আ-অ তো!’ শিশিরবাবুর প্রশ্নে একটু চমকে উঠে নির্ঝর উত্তর দিল।
‘বেশ। ভালো। কিন্তু তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়েছ কেন? এখানেই বা এসেছ কেন? কী দরকার তোমার?’
‘না, কোনও দরকার নেই জ্যেঠু, এমনিই এসেছিলাম। বাড়িতে ভালো লাগছিল না, তাই আর কী…’
‘বাড়িতে ভালো লাগছিল না বলে এখন এখানে আসবে? জানো না এখন অকারণে রাস্তায় বেরোনো, ঘোরাঘুরি করা সরকারের বারণ আছে। তোমরা শিক্ষিত ছেলেরা যদি এই ভুলগুলো করো তো অশিক্ষিত মানুষেরা কী করবে ভাই? যাও, বাড়ি চলে যাও। এরমধ্যে আর ভুল করেও এইবাড়ি মুখো হ’য়ো না। যাও।’
এবার যেন নির্ঝর একটু ভড়কে গেল, কারোর বাড়িতে এসে এইকথা শুনতে হতে পারে সে ভাবতে পারেনি। কিন্তু ভদ্রলোকের কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, মিথ্যা কিছু বলেননি। অতএব এখান থেকে কেটে পড়া ছাড়া আপাতত তার আর কোনও গতি নেই। অগত্যা সে মরিয়া হয়েই মনের কথাটা বলে ফেলল, ‘বলছি কী যে, জেঠু, শ্রাবণীকে একবার ডেকে দেবেন? একটু দরকার ছিল।‘
শিশিরবাবু নির্ঝরকে আপাদমস্তক একপলক দেখে নিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি এখানেই দাঁড়াও। আমি ডেকে দিচ্ছি।’
‘আচ্ছা। ঠিক আছে।‘ প্রত্যুত্তরে নির্ঝর জানাল।

নির্ঝরকে দরজার বাইরেই দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতরে ঢুকলেন শিশিরবাবু। একটু পরে শ্রাবণী বেরিয়ে এলো।
শ্রাবণীকে দেখে নির্ঝর যেন ক্ষণিকের শান্তি পেল! ‘এতক্ষণ এসেছি! থাকো কোথায়? কাল দুপুর থেকে তোমার ফোন সুইচট অফ! কী ব্যাপার?’
নির্ঝরের কথায় শ্রাবণীর মনে পড়ল গতদিন দুপুর থেকে তার স্মার্টফোনটি দেহ রেখেছে। সে বলল, ‘একটা উপকার করবে?’
-‘কী?’
-‘আমার মোবাইলটা কাল থেকে খারাপ। বাপি তো আমাকে বেরোতেই দিচ্ছে না, তুমি নিয়ে গিয়ে কোনও মোবাইলশপ থেকে সারিয়ে দেবে? প্লিজ।’
-‘এখন তো সব দোকান বন্ধ। কেউ দোকান খুললেই পুলিশ গিয়ে বন্ধ করে দিচ্ছে। জানো না? খবর টবর দেখছ না?’ নির্ঝর কিছুটা আশ্চর্য হয়েই শ্রাবণীকে প্রশ্নটা করল।
-‘আরে বাবা! সবই জানি। তোমার বন্ধু দেবেশদার কাছ থেকে সারাতে পারবে না?’
-‘হুম। দেবেশের দোকান বন্ধ। ঠিক আছে দাও। ওর বাড়ি গিয়ে দেখব।’
-‘তাহলে দাঁড়াও। ফোনটা ঘরে রেখে এসেছি। এনে দিচ্ছি।’
মোবাইল আনতে শ্রাবণী ভেতরে চলে গেল। নির্ঝর সামনের পাঁচিলে একটা কাঠবেড়ালির আপন মনে খেলা করা দেখতে দেখতে ভাবছিল, ক’দিন আগেও এদের দ্যাখা মিলত না, আর আজ মানুষ ঘরে সেঁধিয়ে যেতেই এরা আবার ফিরে এসেছে। সত্যিই প্রকৃতি কীভাবে প্রতিশোধ নেয়! পৃথিবীটা যে সবার, এটা যে শুধু মানুষের পৈত্রিক সম্পত্তি নয়, সেটাই আমরা ভুলে গিয়েছিলাম! হয়ত এই পৃথিবীতে মানুষই যথার্থ অর্থে অনুপ্রবেশকারী।
-‘এই নাও ধরো।’ শ্রাবণী বলল।
ফোনটা নিয়ে সে শ্রাবণীকে বলল, ‘কাল বিকেল পাঁচটা নাগাদ আসব, দরজার সামনে থেকো। ফোনটা সারাতে পারলে তখনই আনব।’
-‘আচ্ছা দাঁড়াব। তবে, সারাতে পারলে না, যেভাবেই হোক সারিও কিন্তু। সারাদিন বাড়িতে বন্দী! তার ওপর বিকল মোবাইল! আমি স্রেফ পাগল হয়ে যাব কিন্তু।’
-‘বেশ। আমি রাঁচির একটা টিকিট কনফার্ম করে রাখছি তাহলে।’
-‘কনফার্ম কি ট্রেনে করবে ভাবছ? কবে চলবে ট্রেন, তার তো কোনও ঠিকই নেই! ততদিনে তো আমি তাহলে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাব!’
-‘এখনও কিছু বাকি আছো নাকি?’
-‘আছি বলেই তো জানতাম। কিন্তু তোমার পাল্লাই পড়লে যে সেই সৌভাগ্য আমার আদতে স্থায়ী হবে না সেটা জানি।’ কথা শেষ করে শ্রাবণী একটু জোরেই হেসে উঠল।
-‘মানে! আমার পাল্লাই পড়লে মানে!’
-‘কিছু নয় বুদ্দুরাম। কাল যেভাবেই হোক মোবাইলটা ঠিক করে এনো। এখন যাও, না হলে আমার বাপি এবার খেপে যাবে।’
-‘এখনও খ্যাপার কিছু বাকি আছে!’
-‘ এএএই! ভীষণ মার খাবে কিন্তু এবার।’
‘তাও ভালো। কিন্তু এখানে আসা ইস্তক যা জ্ঞান খেলাম! মাথায় আর মাথা ছিল না আমার! সব কানে নেমে এসেছিল।’
শ্রাবণী হেসে উঠে বলল, ‘ঠিক হয়েছে। এখন পালাও।’
-‘হ্যাঁ। চলি। কাল যদি বাইরে দাঁড়িয়ে না থাকো তো ফোন পাবে না। আর টুপিটাপি দিয়ে তোমার বাপিকে অন্তত ওই সময় বাড়িতে আটকে রেখো।’
-‘হুম। আসলে বাপি এখন বাড়ির বাইরে একদম আর বেরোয় না। বাজার-হাট দাদা করে আনে। দাদা ফেরার পর থেকে বাপি তার পেছনে লেগে থেকে বাইরেই জামা-কাপড় খুলিয়ে, স্নান করিয়ে, তবে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেয়। বেচারা দাদার মুখ যদি তখন দেখো! রেগে গিয়ে প্রতিবারই বলে আমি আর দোকান, বাজার যেতে পারব না! তবে সপ্তাহে দু’দিনমাত্র। তার বাইরে ও আর বেরোয় না। আমার তো সেই অবকাশও নেই!’
-‘শিশিরজেঠুর কথা শুনতে খারাপ লাগলেও উনি কিন্তু ঠিকই বলছেন। এই সময় লকডাউন আর সতর্কতা এমনভাবেই পালন করা উচিত।’
-‘তা তো ঠিকই। কিন্তু এত বুঝেও অকারণে তুমি বাইরে এলে কেন সোনা? জ্ঞানপাপী একটা!’
-‘ওই যে তোমার টানে।’
-‘আহা রে! কত টান!’
নির্ঝর খপ করে শ্রাবণীর ডানহাতটা ধরে বলল, ‘টান দেখবে?’
-‘থাক। খুব হয়েছে, এখানে আর বীরত্ব দ্যাখাতে হবে না। বাড়িতে সবাই আছে, জানলা টানলা দিয়ে কিছু দেখতে পেলে তোমার বীরত্ব শেষ। এইটুকুও আর দেখা হবে না।’
নির্ঝর শ্রাবণীর হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘ওকে। যাও ক্ষমা করে দিলাম।’
-‘এবার এসো। আর দেরি করলে সন্দেহ হতে পারে।’

-‘আরে, পাড়ার ছেলের সঙ্গে কথা বললে সন্দেহ করার কী আছে?’
-‘ঠিক আছে, তোমার মেয়ে যখন গল্প করবে তুমি সন্দেহ করো না। কিন্তু আমার বাড়িতে সন্দেহ করবে। সুতরাং আমি এখন যাচ্ছি। তুমি বাইরে থেকো না। প্রয়োজন ছাড়া বেরিয়ো না। সাবধানে থেকো। চলি।’
শ্রাবণী চলে গেল। নির্ঝর কিছুটা এগিয়ে এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে নিজের বাড়ির দরজা অবধি পৌঁছে গেল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *