ধারাবাহিক ভ্রমণ সিরিজ আমেরিকার ডায়েরি || সুব্রত সরকার – ৯

আমেরিকার ডায়েরি -৯
।।১৮ অগাস্ট, রবিবার।। বিদায় বল্টিমোর, গুডবাই মেরিল্যান্ড ।।
আজ খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল অ্যালার্মের ঝঙ্কারে!..
বিছানায় আর আড়মোড়া নয়। আয়েশ নয়। উঠে পড়তে হলো। চটজলদি তৈরী হয়ে নিয়ে বেরতে হবে বল্টিমোর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের পথে। আমেরিকার ডোমেস্টিক বিমান Southwest ধরে যাব বল্টিমোর থেকে শার্লট, নর্থ ক্যারোলাইনায়। বিমান ছাড়বে সকাল ৮.২০ তে। আমাদের দু’ঘন্টা আগে পৌঁছাতে হবে লাউঞ্জে।
লাগেজ সব গোছানোই ছিল। গাড়ি সঙ্গে আছে। আজ আমাদের তিনজনের একসাথে ভ্রমণের শেষ দিন। গত একসপ্তাহ একসাথে এত সুন্দর সুন্দর জায়গায় বেড়ালাম, দেখলাম কত কিছু, কত স্মৃতি বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আজ দল ভেঙ্গে যাবে। আমি আর ডুলুং চলে যাব সাউথ ক্যারোলাইনায়। সেখানে টানা কিছুদিন থাকব। ডুলুং এর কলেজ শুরু হয়ে যাবে। সোহম আমাদের বল্টিমোর এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে ফিরে যাবে সিরাকিউজ। ফিরে গিয়ে গাড়িটা আজ জমা করে দিতে হবে Enterprise এর অফিসে।
সোহমের কলেজ শুরু হবে আগামী সপ্তাহে। ফিরে গিয়ে ও একটু বিশ্রাম নিতে পারবে।
বল্টিমোর হোটেল থেকে কফি খেয়েই বেরোলাম। ভোরের আকাশ কি সুন্দর নির্মল নীল। বাতাসে হাল্কা ঠান্ডার আমেজ। সব লাগেজ গাড়িতে তোলা হচ্ছে। এমন সময় চোখ চলে গেল কয়েকহাত দূরের গাছতলার দিকে। গতকাল ওখানে সবুজ কভার দেওয়া দুটো বড় কুশন রাখা ছিল। এবং দেখেছিলাম কুশন দুটোর ওপর একটা কাগজে লেখা- “FREE”। পথচলতি একজন পথচারীর কাছে জেনেছিলাম, বাড়ির বাড়তি জিনিস এভাবে ফুটপাতে রেখে দেওয়া হয়। যার প্রয়োজন হয় সে নিয়ে যেতে পারে। আজ দেখলাম সেখানে একটা কুশন রয়েছে। তার মানে কাল কেউ একটা নিয়ে গেছেন। তাঁর হয়তো একটাই প্রয়োজন ছিল! বাহ্ বেশ লাগল ব্যাপারটা। এমন তো করাই যায় আমাদের দেশেও। সবার বাড়িতেই থাকে অনেক অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার করার মত বাড়তি জিনিস। এমন করে রেখে দিলে অনেক মানুষেরই কাজে লেগে যেতে পারে।
“অন্যভুবন – সবুজ পাঠ” এর জন্য অনেকেই আমাকে তাঁদের পুরোনো শাড়ি জামা বই ও আরও অনেক কিছু দিয়ে সাহায্য করেন। আমিও সেসব নিয়ে যাই, আমাদের ছাত্র ছাত্রী, অভিভাবক ও গ্রামবাসীদের দিয়ে দিই। কিন্তু এখানকার এই ব্যবস্থাটাও বেশ লাগল। শহরের মধ্যেও তো কত মানুষ আছেন, যাঁরা পেলে উপকৃত হন।
সব লাগেজ গুছিয়ে হোটেলের ম্যানেজারকে গুডবাই বলে গাড়ি ছাড়লাম ৫.৫০ এ। পথ বেশি নয়। কুড়ি মিনিট লাগবে এয়ারপোর্ট যেতে।
গাড়ি বড় রাস্তায় এসে প্রথম সিগন্যালেই থমকে দাঁড়াল। চৌমাথার সিগন্যাল। একটু সময় লাগে গ্রিন হতে। শেষবারের মত বল্টিমোর শহরটাকে দেখছি। শহরের ঘুম ভাঙ্গে নি। দোকানগুলো সব বন্ধ। শান্ত চারপাশ। কিছু মানুষ মর্নিং ওয়াক করছেন। অনেক মহিলা জগিং করছেন। কেউ কেউ প্রিয় পোষ্যকে নিয়েও বেরিয়ে পড়েছেন। আমেরিকায় এই পোষ্য-প্রেম চোখে পড়ার মত। প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ জনের হাতে থাকে তাঁর প্রিয় পোষ্যছানা। এবং অতিযত্নে ভীষণ নিয়মমেনে তাকে লালনপালন করা হয়।
রাস্তার স্ট্রীট লাইটগুলো নেভে নি। রাস্তাগুলো অল্প ভেজা ভেজা। সেটা ভোরের হাল্কা বৃষ্টি বা কুয়াশার কারণে হতে পারে। হঠাৎই তখন চোখে পড়ল এক স্ট্রীট লাইটের নিচে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে দুই গৃহহীন মানুষ। রাতে ঠান্ডা ছিল। ভোরেও হাল্কা ঠান্ডা আছে। তাই দুটো মানুষই এই ঠান্ডার মধ্যে চাদরহীন প্রায় উদোম শরীরে ঘুমিয়ে রয়েছে। একদম ঘুমিয়ে কাদা বললে যা বোঝায় তাই। এদৃশ্য দেখে কষ্ট হয়, না মায়া হয় কি বলব বুঝতে পারছি না। আসলে মনে মনে রাগ হয়। বলতে ইচ্ছে করে, “মিস্টার আমেরিকা, এ কেমন বিচার তোমার? এত বড় রাষ্ট্র, তোমার কত বড় বড় রাষ্ট্রনেতা, বৈভব ও প্রাচুর্যের তো অভাব নেই তোমাদের! তোমাদের ইতিহাসও সমৃদ্ধ। তবু কেন পথে পথে দেখব এমন অভাবী বিপন্ন মানুষদের? গৃহহীন, হা- অন্ন দুঃখীদের?” নিজের মনে বিড়বিড় করলাম আর অসহায় চোখে ওদের দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। আজ সকালের সমস্ত মাধুর্য এই একটা দৃশ্যে কেমন ফিকে হয়ে গেল!
বল্টিমোর এয়ারপোর্টে সোহম আমাদের সময়মত নামিয়ে দিল। এবার ও একা ফিরে যাবে সিরাকিউজে অত বড় গাড়িটা নিয়ে। তিনজনেরই মন একটু খারাপ। গুডবাই বলতেই হলো। পাঁচ ছ’ঘন্টা লাগবে ড্রাইভ করে ওকে ফিরে যেতে। গত ছ’দিন ধরে টানা গাড়ি চালিয়ে ও খুব ক্লান্ত। তাই বললাম, “একটু সাবধানে যেও। এক দু’বার নয় ব্রেক নিও।” ডুলুং বলল, “মেসেজ করবি টাইম টু টাইম।..”
আমরা লাউঞ্জে ঢুকে পড়লাম। সোহম গাড়ি নিয়ে ফিরে গেল।..
ডুলুং চটজলদি সেল্ফ অপারেটেড যন্ত্র থেকে বোর্ডিং পাস ও লাগেজ ট্যাগগুলো নিয়ে চলে এলো। তারপর বড় লাগেজগুলো দিয়ে দিলাম, ছোট লাগেজ নিজেদের কাছে রাখলাম। ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। তাই বেশ ভিড় আছে। এবার একটু অপেক্ষা করতে হবে। শান্ত হয়ে বসলাম এক জায়গায়।
Southwest এর ডোমেস্টিক ফ্লাইট। খুব বড় নয়। চেক ইন, সিকিউরিটি চেক সব সময় মত করে বিমানে উঠে পড়লাম। জানলার ধারটা ডুলুং আমাকে ছেড়ে দিল। বিমানের ছোট্ট জানলা দিয়ে মেরিল্যান্ডকে দেখছি। আকাশ ঝকঝকে নীল। বড় সুন্দর লেগেছে মেরিল্যান্ড। তোমার বড় শহরে তিন তিনটে রাত কাটালাম। একটা শহরে তিনটে দিনরাত্রি থাকলে একটু মায়া তো হবেই। তাই মনে মনে বল্টিমোরকে বিদায় জানালাম। ভালো থেকো বল্টিমোর। প্লেন রানওয়েতে গড়াতে শুরু করল। একটু একটু করে টেক অফ পয়েন্টের কাছে যাচ্ছে। আমি মুসাফির মন নিয়ে চেয়ে আছি জানলায় চোখ রেখে। টেক অফ করবে, স্পিড বাড়াছে ইন্জিন, গুডবাই মেরিল্যান্ড!… টেক অফ হয়ে গেল! বিমান শূন্যে এখন। উড়ছে উড়ছে একটু একটু করে ওপরে উঠে যাচ্ছে। এভাবে উঠে যাবে পাঁচ দশ পনেরো কুড়ি পঁচিশ তিরিশ পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট উচ্চতায়। হারিয়ে যাবে বিমান মেঘের দেশে!
এই মেঘমুলুকে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চললাম। ছোট্ট জানলাটা দিয়ে খুব সুন্দর দেখতে পাচ্ছি মেঘেদের ঘর-বাড়ি উঠোন বাগান গোয়াল রান্নাঘর! আহা! এদৃশ্য দেখার আনন্দকে কি বলে জানি না! হোক না কল্পনার আতিশয্য! তিরিশ- পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট উচ্চতায় উঠে এই কল্পনার ডানায় ভাসতে ভাসতে তো মেয়ের বাড়ি যাওয়ার আনন্দ একজন পিতা পেতেই পারে!..
।। ওয়েলকাম শার্লট। নর্থ ক্যারোলাইনা।।
বল্টিমোর থেকে শার্লট একঘন্টা কুড়ি মিনিটের সফর। এর মধ্যে বিমানে একবার কুকিজ ও হট চকলেট দিয়েছে। অন্য অপশনও ছিল। আমি হট চকলেট নিলাম। ডুলুং নিল Ginger Ale। আমার বিমানে এই রকম ছোট্ট জার্নি ভালো লাগে। এর বেশি হলে খুব বিরক্তি ও কষ্ট হয়। দোহা থেকে নিউইয়র্ক এসেছিলাম প্রায় টানা ১৪ ঘন্টা সফর করে! এত দীর্ঘ সফর পারি না নিতে। কষ্ট হয়। আবারও ফিরব যখন নিউইয়র্ক থেকে দোহা যাব- সেই ১৪ ঘন্টা!..তারপর আবার দোহা থেকে কলকাতা ৫ ঘন্টা!..
নর্থ ক্যারোলাইনার শার্লটও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। বেশ বড়, পরিস্কার ও ঝকঝকে।বিমান থেকে রানওয়েতে নামতে হলো না। সরাসরি জেটব্রিজ দিয়ে চলে এলাম লাউঞ্জে। তারপর কনভেয়র বেল্টে এসে লাগেজ কালেক্ট করলাম। ডুলুং বলল, “Shuttle বুক করা আছে চলে আসবে। চলো আমরা এক জায়গায় দাঁড়াই।”
এয়ারপোর্টের বেসমেন্টে শাটল চলে এলো। বেশ বড় গাড়ি। আমাদের সাথে আরও তিনজন শাটল গাড়িতে উঠল। তিনজনই অল্পবয়সী। ডুলুং ফিসফিস করে বলল, “এরা সব ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। কাল থেকে কলেজ খুলবে তাই চলে এলো বাড়ি থেকে।”
আগামীকাল থেকে ডুলুং এরও ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। এই ক্লান্ত শরীরেই কলেজ যেতে হবে। পি এইচ ডির তৃতীয় বছরের প্রথম ক্লাস। সুতরাং যাওয়াটা খুব জরুরি। এমনিতেই নাকি খুব চাপ থাকে পড়াশোনায়। একদিকে যেমন ক্লাস করতে হয়, অন্যদিকে তেমন ক্লাস করাতেও হয়। ফলে স্বাভাবিক কারণেই অনেকটা ধকল নিতে হয়। ডুলুং এর পি এইচ ডির বিষয় – “Climate Fiction, Post Colonial Studies”।
শার্লট এয়ারপোর্টের সীমানা পেরিয়ে বাইরে চলে এলো আমাদের গাড়ি। শার্লট নর্থ ক্যারোলাইনায়। আমরা এখন যাব সাউথ ক্যারোলাইনায়। ঘন্টা দেড়েকের সড়ক সফর। রাস্তা যথারীতি খুব ভালো। রাস্তার দু’ধারে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাল ফুরুশের গাছ। কি অপূর্ব লাগছে দেখতে। অনেকটা জুড়ে এই ফুরুশ গাছের সারি। আমাদের দেশেও বর্ষার সময় ফুরুশ ফুল গাছ ভরে হয়। এখানে এখন অগাস্ট মাস। ওরা বলে সামার। কিন্তু আমাদের ওখানে অগাস্ট মানে তো শ্রাবণ মাস। ভরা বর্ষা। এদেশে শুনলাম চারটে ঋতু- সামার, উইন্টার, ফল ও স্প্রিং । বৃষ্টি নাকি সারাবছর যখন তখন হতে পারে। তাই ওদের সেভাবে কোনও বর্ষা ঋতু নেই!.. ইস্ কি দুর্ভাগ্য ওদের। বর্ষার মত মন কেমন করা একটা সুন্দর ঋতু ওদের নেই!..বেচারা!.. ভগবান তো আর সবাইকে সব কিছু দেয় না!.. কি আর করবে, এটা আমেরিকা মেনে নিয়েছে!..
শার্লট থেকে সাউথ ক্যারোলাইনার কলম্বিয়ার দিকে গাড়ি গতি মেনে ছুটছে। সুন্দর একটা হাইওয়ে। দৃশ্যময় অপূর্ব পথ। খুব ক্লান্ত ছিলাম। অনেক ভোরে আজ ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে। তাই চোখ ঘুমের আবেশে বারবার জুড়িয়ে আসছিল। আবার পথের দৃশ্যও না দেখে থাকতে পারছিলাম না।
এভাবেই পৌঁছে গেলাম কলম্বিয়া শহরে। বেশ পরিচ্ছন্ন শহর। প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গেল। মনে মনে বেশ আনন্দ হলো- বাহ্ এই সুন্দর শহরে আমার মেয়ে থাকে। পড়াশোনা করে এই শহরেরই বিশ্ববিদ্যালয়ে। শহরটাকে দেখছি নতুন চোখ দিয়ে। ডুলুং মাঝে মাঝে বলে দিচ্ছে রাস্তার নাম, কোন বিল্ডিংটা কিসের, কি নাম তার? সাউথ ক্যারোলাইনার রাজধানী কলম্বিয়া। এই রাজধানী শহর পেরিয়ে গাড়ি ইউনিভার্সিটির পাড়ায় চলে এলো। এখানে রাস্তার দু’পাশে সুন্দর সুন্দর স্টুডেন্ট অ্যাপার্টমেন্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা সব থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব হস্টেলও আছে। তবে সেগুলো শুধুমাত্র আন্ডার গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টদের জন্য।
আমাদের গাড়িতে আসা তিনজন ছাত্র ছাত্রী একে একে নেমে গেল তাদের হস্টেল ও অ্যাপার্টমেন্টে। আমরা নামলাম এসে SAGA Apartment এ। এখানেই ডুলুং নতুন ঘর নিয়েছে। এর আগের দু’বছর অন্য দুটো জায়গায় ছিল। আজই প্রথম এখানকার ঘরে ঢুকবে। ওর একজন জুনিয়র রুমমেট আছে। সে বাংলার মেয়ে। একদিন আগে চলে এসেছে।
SAGA র অফিসে ঢুকে কিছু ফর্মালিটিস সেরে ঘরের চাবি নিয়ে আমরা যখন এলিভেটরের কাছে এলাম ঘড়িতে বাজে প্রায় তিনটে। আজও লাঞ্চ হয় নি। এখন নতুন ঘরে গিয়ে ঢুকব। ঘর গোছাতে হবে। এবেলা আর রান্না করা সম্ভব নয়। ডুলুং বলল, “চলো, অনলাইনে খাবার নিয়ে নেব। বিকেলে ওয়ালমার্ট বাজার দিয়ে যাবে। সব অর্ডার করা আছে। রাতে রান্না করব!..”
সাগা একটা চারতলা মস্ত বড় অ্যাপার্টমেন্ট। এলিভেটরে চড়ে তিনতলায় উঠে এলাম। ডুলুং এর রুম নাম্বার ৩১১৪।
University of South Carolina আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়। সারা পৃথিবীর ছাত্র ছাত্রীরা পড়তে আসে। তাই এই অ্যাপার্টমেন্টে নানান দেশের ছাত্র ছাত্রীদের দেখছি, ওদের কথা শুনছি করিডরে। বেশ একটা কলেজ জীবনের ফিলিং হচ্ছে। সেই কবে ৪০ বছর আগে নিজের কলেজ জীবন শেষ করেছিলাম। আজ এই ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে খুব আনন্দ হলো। আমেরিকায় বেড়ানো যেমন হচ্ছে, তেমন প্রিয়জনদের জীবনযাপনও দেখার সুযোগ ঘটছে। এটা বাড়তি প্রাপ্তি।
দেশ ছেড়ে এই বিদেশে মেয়ের সাথে এসেছি, মেয়ের কাছে এসেছি, মেয়ের সহপাঠীদের দেখছি আর ভাবছি, সেই কোন ছোটবেলায় ডুলুংকে স্কুলে দিয়ে আসতাম, নিয়েও এসেছি কতদিন। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আজও যেন চলেছি…সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এখানেও এসেছি… একজন পিতার কাছে এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কি বা হতে পারে!…
।। প্রথমদিন – সাউথ ক্যারোলাইনায়..।।
লাঞ্চ যখন করছি, ঘড়িতে প্রায় সাড়ে চারটে। আজ খেলাম Chicken Wrap। SUBWAY Fast Food এর দোকান থেকে খাবার এলো। খেতে খানিকটা রোলের মত । অনেক স্যালাড, ভেজিটেবলস দিয়ে বানানো একটু হেভি ফুড। খেতে ভালো লাগল। পেটও ভরলো।
সন্ধে এখানে রাত্রির কোলে জন্ম নেয়। লাঞ্চ করে ক্লান্ত শরীরটা একটু এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভেঙ্গে দেখি সাতটা বাজে। কিন্তু বাইরে কি সুন্দর আলো। ডুলুং এর ড্রয়িংরুম লাগোয়া ছোট্ট বারান্দা থেকে দিনশেষের আকাশ দেখলাম। পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ। সূর্যাস্তের কোনও আভা নেই। কি সুন্দর নীল আকাশ আর সাদা মেঘের ভেলা। একবারে আমাদের শরতের আকাশ।
ডুলুং এর এই ফার্নিশড অ্যাপার্টমেন্টের নাম SAGA । ইউনিভার্সিটি থেকে খুব দূরে নয়।হেঁটেও চলে যাওয়া যায় ইউনিভার্সিটি। আবার ইউনিভার্সিটির নিজস্ব বাসও আছে অনেকগুলো। সারাদিন চলে সে সব বাস। ছাত্র ছাত্রীরা ফ্রিতে যাতায়াত করে।
SAGA Apartment একটু লাক্সারি অপ্যার্টমেন্ট। ওদের নিজস্ব কার পার্কিং, জিম, সুইমিং পুল, ক্যাফে সেন্টার, কোর্টইয়ার্ড আছে। বড় রাস্তার পাশেই সুন্দর ছিমছাম পরিবেশ।
এই অ্যাপার্টমেন্টে ওরা দু’জন শেয়ার করে থাকবে। দু’জনের দুটো আলাদা বড় ঘর, অ্যাটাচড বাথরুম। ঘর খাট বিছানা, পড়ার টেবিল দিয়ে সাজানো। বাথরুম বেশ বড়। বাথটাব রয়েছে। এদেশে বাথরুমে পা ধোয়া যায় না। বাথরুমের মেঝে শুকনো রাখতেই হবে। কারণ মেঝেতে জল বেরিয়ে যাওয়ার কোনও আউটলেট নেই। তুমি যদি জল ফেলে মেঝে নষ্ট করে যাও, তোমাকে তারজন্য পেনাল্টি বাবদ অনেক ডলার জরিমানা করবে ওরা। আর ওদের বাথরুমে কমোডের পাশে কোনও জেট শাওয়ার নেই। টিসু পেপার থাকে। এই ব্যবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে হয়। আমরা তো পা না ধুয়ে পারি না। বাইরে থেকে এসে পা ধোবই। তাই অগত্যা বাথটবে উঠে পা ধুয়ে বাথরুমকে শুকনো রাখতে হয়!..
ড্রয়িং- ডাইনিং কমন। বেশ ছড়ানো ড্রয়িং এ একটা বড় সোফা, রিডিং টেবিল ও চেয়ার আছে। রান্নার জায়গাটা খুবই সুন্দর। ওপেন কিচেন স্পেস। সমস্ত আধুনিক ব্যবস্থায় সাজানো। এটাও কমন। মাইক্রোওভেন, বড় ফ্রিজ, ডিসওয়াশার মেসিন,ওয়াশিং মেশিন সব কমন। দুজনে ব্যবহার করবে। দেওয়ালজুড়ে অনেকগুলো কাঠের বক্স, লম্বা এক স্টোর রুম, গ্রানাইটের সুন্দর কিচেন টেবিল ও টপ। রান্না করতে বড় আরাম। রান্নার সব জিনিস গুছিয়ে রাখাও যায় সুন্দর। এতটকু গরম বোধ হয় না। কারণ পুরোটাই সেন্ট্রালি এসি।
ডুলুং এর রুমমেট পি এইচ ডির প্রথম বছরের ছাত্রী। কোয়েল দাশগুপ্ত। বাড়ি বারুইপুরে। কোয়েলও ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পি এইচ ডি করতে এসেছে। ওর বিষয়- Feminist Studies, Medieval and Early Modern English Culture।
এই অ্যাপার্টমেন্টে এক একজনের মাসিক ভাড়া হলো- ৭৫০/ ডলার। জল ও বিদ্যুৎ খরচ আলাদা। সেটা নিয়ে হয়তো হবে ৮৫০/ ডলার!..মানে এক একজনের ঘর ভাড়া পড়বে ভারতীয় টাকায় ৭০,৫০০/। স্কলারশিপের অনেকটাই চলে যাবে ঘর ভাড়া দিতে।
জল ও বিদ্যুৎ আলাদা তাই এই দুটো জিনিস বুঝে ব্যবহার ও খরচ করতে হবে। আমরা তো জল অপচয় করতে খুব ভালো পারি। আমেরিকা জল সংরক্ষণে আগাম সতর্ক।
ওয়ালমার্ট থেকে সব বাজার চলে এলো। ডুলুং চটজলদি বাজারগুলো গুছিয়ে ফেলল। আটটা বেজে গেছে। কফি বানালাম। তারপর নেমে পড়লাম রান্নার কাজে। ডুলুং ঘর গোছাতে শুরু করল।
কতদিন একটু ডাল ভাত খাই নি! আজ সেই ডাল ভাত ডিমের ওমলেট খাব। গাজর, বিনস কড়াইশুটি, ধনেপাতা দিয়ে বানালাম ভেজ মুসুর ডাল। পেঁয়াজ কাঁচালংকা কুচিয়ে করলাম ডিমের ওমলেট। বাসমতী চালের গরম ভাত নামিয়ে ফেললাম। ঘি আনা হয়েছে কলকাতা থেকে। গরম ভাতে ঘি, ভেজ ডাল আর ওমলেট- খেতে খেতে মনে হচ্ছিল বাপ বেটিতে পৃথিবীর সেরা ডিশ খাচ্ছি। কি তৃপ্তি করে দুজনে খেলাম।
আমি এখানে এসেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, বড় ড্রয়িং কাম ডাইনিংটাই হবে আমার জায়গা। পাশেই বারান্দা। আকাশ দেখা যায় সারাদিন। সুন্দর সোফা সেট আছে। শুয়ে পড়তে কোনও অসুবিধা নেই আর পড়ালেখার জন্য একটা টেবিল চেয়ারও আছে। আর কি চাই! কিচেনও সামনে। যখন খুশি চা কফি বানাব আর খাব। কোনও ডলারের ভয় নেই!..
আজ সব কাজ সেরে শুয়ে পড়তে একটু রাতই হলো। বিদেশে এই পরবাসে মেয়ের কাছে এসেছি। ও কেমন থাকে, কিভাবে সব কিছু করে এসব নিজের চোখে দেখার একটা ইচ্ছেও ছিল। সব দেখে মন খুশ। নাহ্ বেশ আছে। ঠিকই আছে। পারিবারিক জীবনে সন্তানের জন্য চিন্তা করতে হয় সবাইকেই। মা বাবা দুজনেই সমান তালে করে। আমি তো এখন একই সঙ্গে ওর মা ও বাবা!.. তাই সব দেখে আনন্দ হল অনেক।
এবার ওর কাছে টানা দশ দিন থাকব। বিশ্রাম নেব একটু। ঘুরেও বেড়াব সাউথ ক্যারোলাইনার চারপাশ। তারপর আবার দশ দিনের জন্য চলে যাব আমেরিকার বিখ্যাত বিখ্যাত আরও ছটা শহরে!..
একে একে যাব ইন্ডিয়ানাপোলিস, শিকাগো, লুইসিয়ানার নিউ অরলিন্স, ফ্লোরিডার মায়ামি, চার্লসটন ও সাভানা।
শুরু হবে নতুন ভ্রমণ। লেখাও চলবে- আমেরিকার ডায়েরি!..
এবার খুব ঘুম নেমে আসছে চোখের পাতায়!.. আয় ঘুম, আয় রে!.
শুভরাত্রি। সাউথ ক্যারোলাইনা।