ভ্রমণে রোমাঞ্চ ধারাবাহিকে সমীরণ সরকার (পর্ব – ২৬)

তীর্থভূমি বীরভূম, ভ্রমণ তীর্থ বীরভূম
দেশীয় স্থাপত্যে বিদেশি প্রভাব:-
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির মোগল সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা খাজনা জমা দেওয়ার শর্তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা বিহার ওড়িশার দেওয়ানী নেবার পর থেকে ব্যবসা ও রাজত্ব আদায় বৃদ্ধির স্বার্থে সাহেবরা সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল।
বিদেশি বণিকদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে মন্দির স্থাপত্যে মিশ্রণ ঘটতে শুরু করেছিল। ১৮ শতকের শেষ থেকে বাংলার চিরন্তনী মন্দির স্থাপত্যের প্রথাগত ধারাটির সঙ্গে বিদেশি স্থাপত্য রীতির মিশ্রণ ঘটিয়ে স্থানীয় শিল্পীরা এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেছিলেন।
এদেশে পাকাপাকিভাবে বিদেশি রাজ কায়েম হবার পর থেকে কলকাতা সহ বিভিন্ন শহরে ঘরবাড়ি, সরকারি ভবন, গির্জা প্রভৃতি নির্মাণের জন্য বিদেশ থেকে স্থপতি ও কারিগরেরা এদেশে আসেন। তাদের নির্মাণের মধ্যেও ভারতীয় প্রভাব পরিলক্ষিত হল। এর ফলে একটা নতুন মিশ্র রীতির উদ্ভব হলো।
১৮ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বিশ শতকের প্রথম সময় অব্দি সারা বাংলায় যে সমস্ত মন্দির স্থাপত্য নির্মিত হল, সেগুলি গড়ে ওঠার পিছনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবদান ছিল স্থানীয় জমিদার, ভূস্বামী অথবা ধনী ব্যবসায়ীদের।
আর এরা তখন ক্ষমতার অলিন্দে বিচরণ করার জন্য অথবা সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য বিদেশি সাহেবদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছিল। ফলে তাদের রুচি পছন্দের পরিবর্তন শুরু হয়েছিল। বাংলার মন্দির স্থপতি ও কারিগরেরা তাদের এই সমস্ত নিয়োগকর্তা মালিকের মর্জি ও রুচি অনুযায়ী স্থাপত্য শিল্পে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করল। আর তার ফলে দীর্ঘকাল ধরে তাদের পিতা পিতামহের কাছ থেকে শেখা ভারতীয় নির্মাণ কৌশলের সঙ্গে বিদেশী শৈলীর মিশ্রণ ঘটিয়ে তারা নতুন কিছু তৈরি করার চেষ্টা করল।
বাংলার মন্দির শিল্পে এই বিদেশীর প্রবেশের উদাহরণ দিতে গেলে প্রথমে ই নজরে আসে মন্দিরের গর্ভ গৃহের সামনে ত্রিখিলান দালানে ব্যবহৃত লম্বাকৃতি গোলাকার থামের গুচ্ছ। দেশীয় স্থপতিরা যার নাম দিয়েছিল
‘কলাগেছে থাম’। এটা সেই সময়ে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’তে ও তার উল্লেখ আছে।
পরবর্তীকালে, বাংলার মন্দির স্থাপত্য শিল্পে,’ বিশেষত দালান রীতির মন্দির তৈরি করার সময় বিদেশি রীতির অনুসরণে নির্মিত হয় আয়োনিক, কোরিয়ান্থিয়ান অথবা ডোরিক শৈলী’। বাঁকুড়া জেলার বড়জোড়া থানার মুক্তাতোড় গোপাল মন্দির, মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোনায় পার্বতীনাথ শিব মন্দিরে এই রীতি লক্ষ্য করা যায়।
বীরভূম জেলার ময়ূরেশ্বর থানার অন্তর্গত কলেশ্বর গ্রামে কলেশনাথ শিব মন্দির ও কোরিনথিয়াল স্তম্ভ নির্মাণ রীতির নমুনা নজরে আসে।
শুধু থামের ক্ষেত্রেই নয়, বাংলার কয়েকটি মন্দির নির্মাণ শৈলীতে দেখা যায়, পুরাতন অর্ধ গোলাকৃতি খিলান রীতির পরিবর্তে বিদেশি স্থাপত্য শৈলীর অনুসরণে ‘গথিক খিলান’।
কলকাতা হাইকোর্ট নির্মাণের ক্ষেত্রে এই স্থাপত্যশৈলী বহুলাংশে ব্যবহৃত হয়েছে বলে দেশীয় স্থপতিরা এর নামকরণ করেছিলেন ‘হাইকোর্ট খিলান’।
শুধু থাম বা খিলানে নয় , বেশ কিছু মন্দিরে প্রবেশপথে বা জানলার উপরের খিলানে ব্যবহৃত হয়েছে বিদেশি ভাবধারার অনুসারী নকশা। কতগুলি মন্দিরের অলংকরণ সজ্জাতেও বিদেশি সৌধ সজ্জায় প্রচলিত নকশার অনুকরণ করা হয়েছে। কোথাও ইউরোপীয় ভাবধারার অনুসারী খড়খড়িযুক্ত গবাক্ষপথের নকশা ব্যবহৃত হয়েছে।
কোথাও মন্দিরের দেয়ালে দরজার অনুকৃতি করে সেটার গায়ে পঙ্খ পলেস্তারার সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে খড়খড়িযুক্ত অর্ধ উন্মুক্ত দরজা বা জানলার পাশে প্রতীক্ষারত এক যুবতী। কোথাও আবার টুপি পরা সাহেব অথবা মেম সাহেবের মূর্তি।
এই ধরণের স্থাপত্য শুধু মন্দিরে নয়, কোথাও কোথাও স্থানীয় জমিদার বা ভূস্বামীদের বসত বাড়িতেও অনুসৃত হয়েছে।
যার নমুনা আমরা বীরভূমের ইলামবাজারের সন্নিকটে মৌখিরা কালিকাপুর গ্রামে নির্মিত অনেক প্রাচীন সৌধে। ওই গ্রাম- দুটিসহ সমগ্র ত্রিষষ্টিগড়ের জঙ্গল এলাকা আগে বীরভূমের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে জানা যায়।
বীরভূম জেলার দুবরাজপুর থানার অন্তর্গত হেতমপুর গ্রামে গোলমন্দির নাম একটি রাসমঞ্চ আগে ছিল। যেটির গঠন ছিল পুরোপুরি বিদেশি আদলে। আট কোণা আকারে তৈরি আটটি খিলানযুক্ত রাসমঞ্চের চারিদিকে ঘিরে গোলাকার বারান্দাটিতে যুক্ত হয়েছিল বিদেশি শৈলের স্তম্ভ। ছাদের আট কোণে ছিল আটটি ত্রিকোণাকার চূড়া, যার মধ্যে বাংলার স্থাপত্যের কোন চিহ্ন প্রায় খুঁজেই পাওয়া যেত না।
ক্রমে এই সমস্ত বিদেশী স্থাপত্য রীতি স্থানীয় ধর্মীয় স্ট্রাকচার গুলিতেও ব্যবহৃত হতে থাকলো।
চলবে