ক্যাফে ধারাবাহিক ভ্রমণ সিরিজে সুব্রত সরকার (পর্ব – ৯)

মিজোরামের মুকুট – আইজল
কলকাতা থেকে আকাশপথে হুশ করে এক ঘন্টার উড়ানে পৌঁছে যাওয়া যায় লেং পুই বিমানবন্দরে। সেখান থেকে আর দেড় ঘন্টার সড়কপথে আইজল। মিজোরামের রাজধানী।
সুন্দর সাজানো গোছানো আধুনিক শহর। সমতল থেকে উচ্চতা বেশি নয়। মাত্র ১১৩২ মিটার।
আমি একটু ঘুরপথে শিলচর থেকে আইজল এসেছি। পথের দূরত্বে ১৮০ কিমি। এই সড়কপথটা বেশ উপভোগ্য। অসংখ্য পাহাড়, প্রায় লক্ষ লক্ষ সুপুরি গাছ, প্রচুর কলাগাছ, বাঁশগাছ, কফি গাছ দেখতে দেখতে এসেছি। মাঝে মাঝে পড়েছে ছোট ছোট শান্ত পাহাড়ি গ্রাম, জনপদ, স্কুল, চার্চ।
আমি আইজল শহরের এক পরিচিত জায়গা জারকোটে ছিলাম। এর পাশেই রয়েছে আইজলের বিখ্যাত বরাবাজার।
শিলচর থেকে আইজলে পৌঁছাতেই প্রায় বিকেল হয়ে গেল। আইজল শহর তখন জমজমাট। হোটেলে চেক ইন করে সামান্য রেস্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। জারকোটে একটু পায়ে হেঁটে ঘুরলাম। চলে গেলাম বিখ্যাত বরাবাজার দেখতে। বিরাট বাজার। রাস্তা থেকে শুরু হয়ে পাহাড়ি অলিগলি হয়ে চলে গেছে অনেকদূর। ঠাসা ভিড়ে বাজার জমে আছে। আমি শুধুই দর্শক। এই বাজারে দেখলাম ক্রেতা ও বিক্রেতার প্রায় নিরানব্বই ভাগ মহিলা। এরা সবাই নানান জাতি উপজাতির স্থানীয় মহিলা। সবাই খুব হাসিখুশি। ভীষণ স্মার্ট। অনেক মহিলা বিক্রেতারা বসে বসে দেদার সিগারেট খাচ্ছে। আমি কিছুই না কিনে শুধু ঘুরে বেড়ালাম। এবাজারে সব পাওয়া যায়। নিত্য ব্যবহার্য সব জিনিস। শাক সব্জি, মাছ, মাংস তো আছেই। কাপড় জামা জুতো থেকে শুরু করে হরেক কিসিমের সব জিনিস পাওয়া যায়। এই বরাবাজার ঘুরে দেখার আনন্দ উপভোগ করলাম প্রথম দিনের বিকেলে।
সন্ধ্যায় হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম পাশের জনপদ চানমারি। সেখানে আমাদের উত্তরবঙ্গের দিনহাটা থেকে আসা এক দোকানীর দেখা পেলাম। তার দোকানের চা সিঙ্গাড়া খেলাম। পাশেই ছিল একটা চার্চ। বাইরে থেকেই চার্চটা দেখলাম। ঘুরে বেড়ালাম আরও একটু। তারপর ফিরে এলাম আবার জারকোটে আমার হোটেলে।
আইজলে সন্ধে চট করে নিঝুম হয়ে যায় না। মোটামুটি রাত আটটা পর্যন্ত পথে লোকজন দেখা যায়। দোকান খোলা থাকে। কিন্তু রবিবার এখানে একদম ছুটি। প্রায় সব কিছু বন্ধ থাকে। রবিবার চার্চে যাওয়ার দিন। রবিবার আনন্দ করার দিন। পুরো হলিডে!
রাতের আইজল শহরকে দেখার জন্য হোটেলের ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। আলো ঝলমল চিকচিক করা চারপাশের পাহাড়ি সৌন্দর্য অপূর্ব। দু-চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলাম। এই রাতের রূপ দেখে মনে হবে আইজল মুকুট পরে বসে আছে। মিজোরামের রাজা! রাজমুকুটে সব ঝলমলে পাথর চিকচিক করছে। এ বড় অপূর্ব দৃশ্য। চোখ জুড়িয়ে যায়। মন ভরে যায়।
আইজল শহরে আমি টানা থাকি নি। চলে গিয়ে আবার ফিরে এসেছি। আইজলকে কেন্দ্র করে ঘুরে বেড়িয়েছি। এভাবে তিন তিনবার আইজলে ছিলাম। আইজলে দেখার আছে অনেক কিছু। একদম শহরের গা ঘেঁষে আছে মিজোরাম স্টেট মিউজিয়াম, সলোমন্স টেম্পল, বরা বাজার, ডার্টলং হিলস, কেভি প্যারাডাইস, সেলভেশান আর্মি টেম্পল। শহর থেকে অল্প দূরে আছে তামডিল লেক, জোরাম মেডিকেল কলেজ, রেইক, মুইফাং।
আমি মিজোরাম স্টেট মিউজিয়াম দেখে মুগ্ধ হয়েছি। পাঁচতলা এই মিউজিয়ামটা অত্যন্ত সুন্দর ও সাজানো গোছানো। ১৯৯৩ সালের ১৩ জুলাই এই মিউজিয়ামের দ্বারোদঘাটন হয়। আকারে ছোট্ট এই মিউজিয়ামটির সংগ্রহ অসাধারণ।
প্রথমতলে রয়েছে হিস্ট্রি গ্যালারি। মিজোরামের বিখ্যাত কিছু মানুষের ছবি ও লেখা দিয়ে সাজানো। অনেক কিছু জানা যায় এই হিস্ট্রি গ্যালারিতে ঘুরে ঘুরে। এর ওপর তলায় রয়েছে এনথ্রোপলজিক্যাল গ্যালারি। এখানে ঘুরে ঘুরে দেখা যায় প্রত্নতাত্বিক বহু কিছু। যা দেখে বিস্ময় ও ভালোলাগা তৈরী হবে। এরপর গেলাম এথনোলজিক্যাল গ্যালারিতে। প্রচুর মিজো বাদ্যযন্ত্র দেখলাম। নাম জানলান। জানলাম তার ব্যবহারের ইতিহাস। তারপর টেক্সটাইল গ্যালারি ঘুরে আর্কিওলজিকাল গ্যালারিতে। এই পাঁচতলা যাদুঘরটা ঘুরে বেড়িয়ে সুন্দর সময় কেটে যায়। তারপর ছাদে গিয়ে দাঁড়ালে আইজল শহরের একটা ছবি চোখে ধরা দেয়।
স্টেট মিউজিয়াম দেখে চলে গেলাম অল্প দূরের এক সুন্দর জায়গায়- সলোমন্স টেম্পল দেখতে।মিজোরামের কিছু ধর্মপ্রাণ মানুষ নিজেদের অর্থ ও অনুদান সংগ্রহ করে ২৩ বছরের চেষ্টায় এই অপূর্ব সুন্দর টেম্পলটি নির্মাণ করেছেন। ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৭ সালে এর দ্বারোদঘাটন হয়। এখানে কোনও প্রবেশমূল্য নেই। প্রবেশদ্বার থেকেই শুরু হবে মুগ্ধতা। যেমন তার ফুলের বাগান, তেমন তার পাথরে গড়া স্থাপত্য। আমি মুগ্ধ হয়ে অনেকটা সময় এই সলোমন্স টেম্পলে ঘুরে বেড়িয়েছি।
ডার্টলং হিলসও আরেকটি সুন্দর জায়গা। এই পাহাড়ে ভ্রমণ চোখ ও মনের জন্য দারুণ দৃষ্টিসুখ।
জোরাম মেডিকেল কলেজ দেখা ও মুইফাং বেড়ানোও এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
রেইক মিজোরামের এক সবুজ গ্রাম। আইজল থেকে ঘুরে বেড়িয়ে ফিরে এসেছি।
কে ভি প্যারাডাইস, তামডিল লেক ও সেলভেশান আর্মি টেম্পল দেখার সুযোগ এবার হয় নি। মিজোরামের চারপাশে ছুটতে ছুটতে দিন ফুরিয়ে গেছে!
আইজল শহরে টানা তিনদিন থাকলে সব কিছু সুন্দর দেখে নেওয়া যায়। আইজল এত সুন্দর পরিচ্ছন্ন এক আধুনিক পাহাড়ি শহর, যাকে কোনও পর্যটক ভালো না বেসে পারবেন না।
আইজল শহরের আরও এক সেরা জিনিস হল সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত। আমি সেই অপূর্ব সূর্যোদয় দেখেছি। মিজোরাম ভ্রমণে আইজলে ফিরে ফিরে তিন তিনবার এসেছি এবং রাত্রিবাস করেছি। এই আইজলকে গুডবাই জানিয়ে আসার সময় একটু মন কেমন যেন করছিল!.
কিভাবে যাবেন- কলকাতা থেকে আকাশপথে উড়ে সরাসরি চলে যাওয়া যায়।
আবার ট্রেন পথে গৌহাটি-শিলচর হয়ে সড়কপথে আইজল আসা যায়।
সমাপ্ত