|| ক-বর্গের কবিতা || সাহিত্যিক আলোক মণ্ডলের বই আলোচনায় চন্দন চৌধুরী

। ক-বর্গের কবিতা।
কবি আলোক মণ্ডল।
কবিতা সম্পর্কে এখন কিছু স্পেসিফিক বলা বা লেখা- ধৃষ্টতা মাত্র। কবি সম্পর্কে ও একই কথা প্রযোজ্য। তবু বলতে হয়,যদিও সে বলার মাঝে থাকে গভীর ফাঁক। আমাদের শ্রদ্ধেয় কবি আলোক মণ্ডলের সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ ‘ক-বর্গের কবিতা ‘ নিয়েই এরকম একটা মুখবন্ধ লেখা হয়ে গেল। কবিতার ফর্ম, কবিতার ভাবনাতে দুরারোগ্য প্রতিষ্ঠানবিরোধী মনোভাবের আত্মপ্রকাশ আলোচ্য গ্রন্থটি। তাই পাঠপ্রতিক্রিয়া দেওয়াও এক সাংঘাতিক ভয় ও দ্বিধার বিষয়। এক অসাধারণ ব্যতিক্রমী কাব্যগ্রন্থ ‘ক- বর্গের কবিতা ‘ পড়ে যার পর নাই মুগ্ধ।
কবি আলোক মণ্ডল দীর্ঘ বছর দীর্ঘায়িত সময় ধরে কাব্য চর্চা করে চলেছেন নিরলস নিষ্ঠায়। কবিতা লেখা তার কাছে শুধু মাত্র সময় বিনোদন বা বর্ণময় বহুরৈখিক ধামাকা মাত্র নয়। জীবনের প্রথম থেকেই এক লড়াকু মেজাজ নিয়ে সরাসরি প্রতিবাদী ভূমিকায় কবিতা লিখে গেছেন। সমাজ সংসার রাষ্ট্রকাঠামোর ধাষ্টামো থেকে সামাজিক সাংস্কৃতিক অবক্ষয় -সব বিষয় গুলি তার কবিতায় অন্যতম উপাদান হয়ে উঠেছে বরাবর, সাথে সাথে তিনি ভাব ভাষা শব্দ সর্বোপরি ব্যাপ্ত আছেন আধুনিকতম কবিতা নির্মাণ ও বিনির্মাণের আন্দোলন – পরীক্ষা নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষনে। তার এই মানসিকতা, কবি মনন ফুটে উঠেছে অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ গুলো তে ও।’উপলব্ধি’,
‘হাত পেতে দাঁড়িয়ে সময়’, ‘পদচ্ছাপ গুনে নেয় একটি জিরাফ’, ‘এপিটাফহীন কবিতা এবং ‘ ,’কথা স্বরলিপি ‘, ,’বকলিশহীন কবিতা ও ভেল্কিতত্ত্ব’— কাব্যগ্রন্থগুলিতে কবি বারবার নিজেকে ভেঙেছেন আবার নতুন করে গড়েছেন। ভাঙা গড়ার একেবারে লেটেস্ট আপডেটেড ভার্সনটি হলো বর্তমান এই কাব্যগ্রন্থ –’ক-বর্গের কবিতা ‘। খুব সূক্ষ্ম ভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় কবি এই কবিতা আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকার প্রবাহে কখনো কখনো অনুপ্রাণিত হয়েছেন আধুনিক কবিতা আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা কবি মলয় রায়চৌধুরী, কবি প্রভাত চৌধুরী, কবি বারীণ ঘোষাল প্রমুখ দের দ্বারা। এতোদিন চলমান কাব্যিক ধারার গালে সপাটে চড় মেরে আধুনিক কবিতা আন্দোলনের এইসব যোদ্ধারা নতুন করে আমাদের দেখাতে চেয়েছেন -লেটেষ্ট বাংলা কবিতা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নিরিখে ঠিক কতখানি কোন মানে কোন মাপকাঠিতে পৌঁছে যেতে পারে বা পৌঁছানো উচিত। এইসব চরিত্রধারাকে সামনে রেখে একথা বলা যায় – শ্রদ্ধেয় কবি আলোক মন্ডলের বর্তমান ‘ ক-বর্গের কবিতা ‘ গুলি অনেক টা ব্যতিক্রমী নতুন ধারায় আধুনিক আন্দোলনকে ঘিরে আমাদের মতো পাঠকদের দুনিয়ায় স্বাগতম স্পর্ধা দেখিয়েছে।
কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে ৪২ টি কবিতা অবস্থান করছে। পাঁচ পঙতি থেকে আট নয় দশ এগার বারো চৌদ্দ ষোলো হয়ে সাতাশ পঙতির দীর্ঘ কবিতা ও রয়েছে।
নামকরণের মধ্য দিয়ে নানা ইশারা –
সাংকেতিক ও গোলকধাঁধার মতো রহস্যাবৃত –’আ’, ‘ঋ’ ,’ঙ’ থেকে শুরু করে কখনো ডিম, কখনো মদ কখনো মন – নামকরণের সাথে ও রয়ে গেছে পিওর ইংরেজি উচ্চারণের নানা কবিতানামকরণ –অটোফেজি,হিকিকোমোরি,স্কাপ্লচার,
হোমো সেপিয়ান্স ইত্যাদি।
কবিতা শরীরের বাঁধনে শব্দ ব্যবহারের শর্তাবলী এতো সুন্দর করে বিধৃত যে সোজাসুজি ভাবের ঘরে তালা লাগানো দরজার সামনে পাঠককে দাঁড়িয়ে পড়তে হয় । – Discovering Poetry বলতে যা বোঝায় সেরকমই এক আশ্চর্য exploration এর মধ্যে না গেলে পাঠকের তৃষ্ণা ট্যানটালাস king এর অতৃপ্তি হয়ে রয়ে যায়।কটি উদাহরণ দেওয়া যাক –
(১)’পিন পড়লে শোনা যায় এমন/ নিশ্চুপ শব্দহীনতায় বেজে ওঠে নৈঃশব্দের/গান(কবিতা -বৈখরীভাষ্য)‘–
লক্ষ্যনীয় নৈঃশব্দ্যকে এমন ব্যঞ্জনাধর্মী করার প্রয়াসে কবি নিশ্চুপ শব্দহীনতাকে
বাজিয়ে আওয়াজহীন নৈঃশব্দ্যের গান
শুনিয়ে দিলেন কত আশ্চর্য উপমা দিয়ে।
(২) ‘মেঘের হাতে অনিশ্চয়তা জিম্মা রেখে বলা যায়/ মনের চেয়ে গভীর অরণ্য নেই ‘(কবিতা -মন)
মেঘের হাতে – মেঘ নামক জড় পদার্থের এই যে ব্যক্তিকরণের মানবিক আকাঙ্ক্ষাতে কবির এরকম একাত্মতা প্রকাশ – এখানে পরবর্তী ‘ মানুষের চেয়ে গভীর অরণ্য নেই ‘ এক গভীর দর্শনের কথা আমাদের সেরা প্রাপ্তি হয়ে ওঠে। কবিতাতে এরকম বাঁক, এরকম curving মোচড় – মন বিষয়ক হাজার ব্যাখ্যাপেক্ষা অনেক জরুরী আবেদন হয়ে ওঠে।
কবিতার raw material বলে এতো কাল human resource কে কাজে লাগানোর
ধুম পড়ে গেছলো অহরহ। কবি এখানে এটা সযত্নে এড়িয়ে মনুষ্যেতর প্রাণী ও প্রকৃতি নিয়ে অনায়াসে উদ্বেগহীন কবিতা লিখে গেছেন আমাদের জন্য। কবিতার মধ্যে প্রতীকি হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে গরু, ছাগল,থপথপে ব্যাঙ, টিকটিকি, মুরগি, ঘোড়া আরো কতরকম প্রাণী।ইতর চরিত্র নিয়ে কবিতার শ্লেষ,ব্যঙ্গ অতি অনিবার্যভাবে আমাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক অবক্ষয় ও ব্যাধি অবলোকনের দরজা খুলে দেয় —
প্রসঙ্গত পঙতি কিছু —-
(১) সেলোটেপ দিয়ে দেওয়ালে টাঙানো মুরগির ডিমের খোলার/ সঙ্গে টিকটিকির আপাত কোন সম্পর্ক নেই।(কবিতা -ডিম)
কবিতার শেষে লক্ষণীয় ভাবে এক তির্যক মন্তব্য কঠিন শ্লেষের মতো আমাদের সচকিত করে —-
‘অ্যাবসলিউট স্বাধীনতা ঘোড়ার ডিম/
ভেতরটা ফাঁপা,টিকটিকিকে বিভ্রান্ত করার মতোই ‘।
(২) ‘গরু
ছাগল
থপথপ ব্যাঙ জ ন তা
গরু ঘাস খায়,গাছে ওঠে
——————
জলে সাঁতার ভাসে গিরগিটির, কখন বদলাতে হবে রঙ
———-
রঙ ওড়ে বিধানসভার গেটে ।(কবিতা -মনুষ্যেতর)
লক্ষ করুন – কয়েকটি কথার আয়াস ভঙ্গিতে রচনা হলো এক প্রতিবাদী মিছিলের গান –
গরুর গাছে ওঠা, গিরগিটির রঙ বদল ও
বিধানসভার গেটে রঙ ওড়ানোর দৃশ্য – সব মিলিয়ে পাঠক ভাবনার মিতব্যয়ী প্রকাশে খুঁজে পায় এক অন্য লড়াই গল্প – প্রতিবাদের ভাষা।
কবিতার আধুনিক প্রয়োগে Space র গুরুত্ব অসীম। বিশেষতঃ ছোট কবিতার সীমায়িত পরিসরে এই space ব্যবহারে কবিতার contain অনেক বেশি Informative হয়ে ওঠে।space এক গুরুত্বপূর্ণ কবিতা অলঙ্করনের চিহ্ন। বর্তমান কাব্যগ্রন্থে কবি আলোক মন্ডলের সচেতন এই space ব্যবহার কবিতা গুলো কে অন্য মাত্রা দিয়েছে।যারা আধুনিক কবিতা আন্দোলনের শরিক হতে চান – তাদের এভাবেই ছুঁতে হবে কবিতার দুই স্তবকের মধ্যবর্তী শূণ্যতাকে -দক্ষ কবি পারেন। কবি আলোক পেরেছেন – উদ্ধৃতি দিয়ে বোঝাই —–
(১)’হাতের মুঠোয় জল। ছায়া যুক্ত,ছায়া বিযুক্ত।
দু’পারেই প্রশ্ন চিহ্ন শুয়ে।
জল কই? জল।
SPACE
জানালা বন্ধ হলে জল জলেই মিশে যায়।(কবিতা -ঘূর্ণন)
অসাধারণ কনফিডেন্স কবির। সমস্ত কবিতার ভারকে ভারকেন্দ্র করে রাখলেন
একেবারে শেষ সাত শব্দের পঙতি বন্দিতে।
(২)’সমস্ত সম্পর্ক এক সুতোর টানে বাঁধা।
SPACE
আহা, মানবিক সম্পর্ক তোমার গায়ে
এক্সপিয়ারি ডেট কিন্তু তারই সেঁটে দেওয়া’
(কবিতা -মার্কেট)
সম্পর্ক ও যে এক বিপনন দ্রব্যতুল্য এই বিপন্ন কালোবাজারি ক্ষেত্রে – কবি এই ১৩ পঙতির কবিতাতে মাত্র প্রথম পঙতি ও তেরোতম পঙতি উচ্চারণ দিয়ে বাকি অবয়বের মধ্যে একটি চমৎকার ভারসাম্য বজায় রাখলেন।
সময় ও পারিপার্শ্বিকতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় উপলব্ধি। সেই উপলব্ধিজাত চেতনাই হলো কবিতা – এমন ও ভাবনার প্রতিফলন এখানে ঘটেছে স্বাভাবিক কারণে কেননা পৃথিবীর আর্ত চিৎকার যখন অন্দরমহলের কোণে কোণে পৌঁছে যায়,কবির পক্ষে নিরলস কাব্যসাধনার মননে বসে থাকা তখন অর্থশূণ্য।তাই ক্রমাগত শিরা উপশিরার রক্ত ক্ষরণের মধ্য দিয়ে বর্তমানের বিকৃতিকে সংশোধন করে আবার আকৃতির দিকে নিয়ে আসতে হয়।সে কাজ করেন কবি। কবিতার মধ্যে থেকে যায় সেই সৃজনের পদচিহ্ন। কবি আলোক মন্ডলের কবিতার মধ্যে সেই রক্তক্ষরণ উপলব্ধ হয় সাংঘর্ষিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায়—
(১) ‘মুছেছি রাতদিন মুছচি মৃত্যুশোক’
অপার বিস্ময় মনে তীব্রতা ঘনায়
অনেক হাঁটাপথ, অনেক বিষুবরেখা
কী আছে পথের শেষ রহস্য ছায়া!’(কবিতা -প্রচ্ছায়া)
‘মুছেছি রাতদিন মুছছি মৃত্যুশোক’ এই কাব্যিক দ্যোতনা থেকে উৎসারিত কবির আত্মশুদ্ধির শ্রেষ্ঠ শপথ তাই মনের ঘৃণা ঘনীভূত হয়ে পথের শেষ দেখার ব্যাকুলতায় ডুবে যায়।
(২)
এভাবেই প্রসঙ্গান্তরে চলে আসে যুদ্ধবিধ্বস্ত প্যালেস্তাইন ইজরায়েল ইউক্রেনের রক্তমাখা দুঃসহ স্মৃতির কথা।
‘সন্ধির ব্যাকরণ’ কবিতায় কবি দ্বর্থ্যহীন ঘোষণা করেন —
‘প্যালেস্তাইন ইজরায়েল অথবা ইউক্রেন
পেট্রো ডলারে সন্ধি বিচ্ছেদ হয়ে যুদ্ধ অনিবার্য।’
এই অনিবার্য যুদ্ধ কবির কাঙ্ক্ষিত নয়। শান্তির বাতাবরণে তাই সে অনেক ললিত নরম আলোর মতো আশাবাদী।সে কথা উচ্চারিত হয় তার ‘না ফেরা ‘ কিছু আক্ষেপ নিরিখে —
‘ফেরে না ফেরে না ভোরের রাজহাঁস
ফেরে না কিশোরীর নরম দুটি হাত
ফেরে না কলমিলতা নির্জন ঘাট
ফেরে না আলপথ একাকী প্রবাস ‘(কবিতা -প্রচ্ছায়া)
কবির অনুসন্ধানের সাথে আমাদের শান্তশ্রী নষ্টালজিক মন জীবনানন্দ কবি জসীমউদ্দীন এর সেই পাড়া গাঁর স্মৃতিমেদুরতায় আচ্ছন্ন হয়।যুদ্ধমূমুর্ষু পৃথিবীর বর্তমান ভয়ঙ্করতা থেকে কবি কি পালিয়ে বাঁচতে চান – কোনো এক প্রচ্ছায়া ছায়ায় নিজেকে যেন পুনরাবিষ্কারের তটে ফিরিয়ে নেবার তাড়না।
আধুনিক কাব্য আন্দোলনের অন্যতম চিহ্ন হলো কবিতার শরীর জুড়ে কখনো কখনো আশ্চর্য রকম চিত্রকল্পবাদ (Imagism )
সমস্ত কবিতাকে বহন করে নিয়ে যায়।কবি ও এখানে একজন ভাস্কর। কবি ও হয়ে ওঠেন ভাস্কর রদ্যাঁ। হয়ে ওঠেন অবন ঠাকুর।এই কাব্যগ্রন্থ ঘিরে কখনো কখনো এমন চিত্রকল্প ভারি সুন্দর ভাবে ঝলকে ওঠে। দেখা যাক- আমরা পুনরায় দেখি এর ঝলকানি। চিত্রকল্পী কবি আলোক কে –
(১) ‘ঘুম এক আশ্চর্য সময় পরিধি।
অন্তর্বর্তী স্বপ্ন
লিরিল ফ্যানার মতো
ওয়াটার ফলসে ঝাঁপাঝাপি’।(কবিতা -মদ)
সেই লিরিল বিজ্ঞাপন চিত্র এক লহমায় আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেয় এই চিত্রকল্পে।
(২)সানবাঁধানো একটি পুকুরঘাটের এ-কারে
বাঁধা থাকে দু’একটা টাপুর টুপুর (কবিতা -আত্মহত্যা)
এখানে একই সঙ্গে উপমা এবং চিত্রকল্পের মেলবন্ধনে এক অসাধারণ সেন্স অব ইনসপিরেশন-
কবিতাটির প্রাথমিক প্রকাশে এক আশ্চর্য অহঙ্কার যেন –The transition from inspiration.
সময় থেকেই আমরা আধুনিকতা কুড়িয়ে পাই ।আপাত সংশোধন সংযোজন সংস্কার পরিমার্জন – যেভাবেই বলি না কেন কবিতা অন্যান্য আর্ট ফর্মের মতো নিজস্ব আধুনিক ফ্রেম তৈরি করে নেয় সময় থেকেই। কাল যা আধুনিক ছিল আজ ব্রাত্য হয়ে যেতেই পারে যদি না এগিয়ে চলা চলমান সময়ের সাথে তাকে আরো আধুনিক বা আধুনিকোত্তর করে না তুলি।তাই সেদিনের সেই রোমান্টিক এরার ‘Overflow of spontaneous emotions ‘ আজকের আধুনিকতার একমাত্র মাপকাঠি নয়, হতে ও পারে না। কবিতা ভাঙতে ভাঙতে এমন এক বিবর্বিত রূপে আবির্ভূত হয়েছে যেখানে নির্মাণ বিনির্মাণ কবিতা না-কবিতা তত্ত্বে আমাদের পৌঁছে যেতে হয়েছে। কবি আলোক মণ্ডলের কাব্যগ্রন্থ গুলিতে ও তার দুঃসাহসী ভাঙচুর করার এক্সপেরিমেন্ট আমাদের চোখ এড়িয়ে যায় না। সময়ের ধারাবাহিকতায় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ (উপলব্ধি) থেকে এযাবৎ পর পর প্রকাশিত কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ থেকে সেই এক্সপেরিমেন্টের গ্রাফটি একটু তুলে ধরা যাক —-
(১) ‘ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল
কেননা ও বলেছিল পৃথিবী ঘোরে সূর্যের চারিদিকে
অথচ লোকে জানতো উল্টো ‘(কবিতা -একুশের বসন্ত বিকেলে -কাব্যগ্রন্থ উপলব্ধি প্রকাশিত ১৫ই এপ্রিল ২০০০)
(২) ‘কোন প্রতিরোধ নেই,কোন প্রতিবাদ ও নেই
কেমন চিৎ হয়ে পড়ে আছে,আহা,
এই কাঠ ফাটা রোদে! (সন্ত্রাসবাদ -কাব্যগ্রন্থ ‘হাত পেতে দাঁড়িয়ে সময়’-প্রকাশকাল-সেপ্টেম্বর ২০০২)
কাব্যগ্রন্থে লিখিত হয় কবির নিজস্ব অনুভব -মানুষের পাশ দিয়ে মানুষ পালিয়ে যায়
(৩)’একটি পাখি ও ডাকে না
একটি ফুল ও ফোটে না
কিছুদিন হোল
শিশির নেই, বৃষ্টি উবে গেছে।
—————-
—————-
সত্যি বলছি রাতের আকাশে ও
এখন ধর্ষণাক্ত বিদ্যুৎ আভা!’(কবিতা -তামস, কাব্যগ্রন্থ -‘এপিটাফহীন কবিতা এবং’ -প্রকাশকাল-সেপ্টেম্বর ২০০৭)
(৪) ‘ একই পাড়াতে থাকি
তবু, দেখা হয় নি বহুদিন।
সকাল আসে, বিকেল যায়
—————
—————
আমাদের দেখা হবে
একদিন আমাদের দেখা হবে।
(কবিতা -একদিন আমাদের দেখা হবে,কাব্যগ্রন্থ-‘ধূসর ডানায়’,প্রথম প্রকাশ -আগষ্ট ২০০৯)
(৫)’আমার মৃত্যু বিষয়ক শেষ লেখাটি উড়ে গেল
শতাব্দী প্রাচীন জীর্ণ প্রাসাদের অন্ধকারে
হেরিটেজ হবে বলে যারা একদিন সোচ্চারে
পা মিলিয়েছিল পথে
পথের ধুলো তাদের ধুলোতে মিশিয়ে ধূলিময়।’(কবিতা -এপিটাফ-কাব্যগ্রন্থ ‘বগলসহীন কবিতা ও ভেল্কিতত্ত্ব’-প্রকাশ-কোলকাতা বইমেলা ২০১৯
বিগত ২০০০ থেকে ২০২৪এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়কাল ধরে কবি আলোক নিজেকে কতখানি বদলেছেন নাকি আদৌ বদলে যাননি বরং সময়ের সাথে সাথে তার নিরীক্ষণ হয়েছে আরো তীক্ষ্ণ, আরো আবেগহীন নির্মম। ভাবে কমেছে মেদ, আবেগে নেই বায়বীয় উচ্ছ্বাস বরং বাস্তব কে আরো নিষ্ঠুর আয়োজন দিয়ে পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন তথ্য, তত্ত্ব সহযোগে সংযত অথচ ভয়ঙ্কর সব উচ্চারণ যার সুসংহত প্রকাশ বর্তমান প্রতি কবিতার পরতে পরতে। দৈনন্দিন যাপনের মধ্য দিয়ে তার চোখে ধরা পড়ে বৈষম্যের ছবি,অন্যায় উৎপীড়নের একচেটিয়া রাজ, পরিবারের মধ্যে থেকে ও নিষ্প্রাণ সম্পর্কে অর্থশূণ্য জড়িয়ে থাকার অভ্যাস। ঘরে ও বাইরে এই উচাটন স্ববিরোধিতায় নষ্ট হয়ে যাওয়া পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে কবি খানিকটা বিভ্রান্ত কিন্তু নিরাশ নন। এই কাব্যগ্রন্থের দীর্ঘ কবিতা ‘ক-বর্গের কবিতা’ র অন্তরাত্মায় জেগে আছে কবির এক নিরন্তর শুভকামনা – যেখানে মধুর মোহন চন্দ্রিমা,গগণ বিহারি আলো- এসবের ভেতর আমাদের তন্ময়ী আশাবাদ ভীষণ ভাবে প্রকট হয়ে ওঠে।
আধুনিকতা মানে আন্দোলনের সাথে সংপৃক্ত ও সংশ্লিষ্ট হওয়া। আধুনিক হবার মধ্যে থাকে ভাঙচুর খেলা।বর্জন দিয়ে অর্জন করার সাধনা।তাই নতুন কে স্বাগত জানাতে গেলে প্রয়োজন সময়পৃক্ত নতুন সৃজন যা এগিয়ে দেয় আন্দোলন ধারা। তাই নানা এক্সপেরিমেন্ট করে এই সৃজনের স্রোতে আধুনিকতম ভাবনাতরী বাইতে হয়। কবি আলোক সে কাজটি খুব সুনিপুণ ভাবে এক্ষেত্রে করার চেষ্টা করেছেন এবং কতোটা পেরেছেন তা সময় একদিন বলবেই।আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের সব
কটি কবিতা আমি খুব খুঁটিয়ে পড়েছি এবং দুধরনের এক্সপেরিমেন্ট আমার কাছে অভিনব বলে মনে হয়েছে।
(১) প্রথমে বলি,কবিতার পঙক্তি হিসেবে কোন কোন যুক্তঅক্ষর(যৌগিক) শব্দ থেকে প্রথম অক্ষর কে বিযুক্ত করে এক অভিনব এক্সপ্রেসন দিয়ে বাক্যের অর্থটিকে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য করা হয়েছে। উদাহরণ দিই–
ক. ‘ক্লান্তির উ মেখে লঙ্গ জীবন (কবিতা -ঙ)
এখানে উলঙ্গ শব্দটিকে ভেঙে তৈরি হয়েছে এই অভিনব এক্সপ্রেসন –
উ——(মেখে)— লঙ্গ (জীবন)
খ. অ-ক্ষয়ের ক্ষয় রোগ ধরলে অ-চলে যায় দূরে (কবিতা -আ)
এখানে ও সেই একই টেকনিকে বিযুক্তি ঘটিয়ে সেই অভিনব এক্সপ্রেসন দেবার নিরীক্ষা লক্ষ্যণীয়।
অক্ষয়= অ—(ক্ষয়) থেকে ক্ষয় চলে গেলে বাস্তবিক পড়ে থাকে শুধু ‘অ’
এই ‘অ’ এর দূরে চলে যাবার মধ্য দিয়ে ই
কবি পোয়টিক কন্টেন্ট ম্যাজিক মোমেন্ট তৈরি করলেন।
এরকম অনেক উদাহরণ অনেক পঙতি তৈরি হয়েছে নানা কবিতায় । ‘হা’ কে পিস পিস করে কাটলেও–, এখানে কথাটা হাপিস – হাপিসকে ব্যবহার করা হলো এরকম –হা—পিস পিস —।
এরকম সাহস বোধহয় কবি আলোক মন্ডল প্রথম দেখালেন আমাদের মতো পাঠকদের কাছে। আমরা মুগ্ধ হয়ে নতুন কে স্বাগত জানালাম।
(২) দ্বিতীয় আরেকটি এক্সপেরিমেন্ট কবি কতখানি জান্তে বা অজান্তে করেছেন বলতে পারি না তবে এক্সপেরিমেন্ট টা সুন্দর ভাবে কবিতার ভেতর সিনক্রোনাইজ করে গেছে স্বাভাবিক আচরণ নিয়ে। এমনিতেই বাংলা কবিতার মধ্যে বাংলা শব্দের সাথে বিজাতীয় বা বৈদেশিক শব্দ ব্যবহারের চলন সেই রবীন্দ্র পরবর্তী যুগ থেকে প্রবহমান। কাজী নজরুল ইসলামের মতো কবি অতি মুন্সিয়ানার সাথে বাংলা শব্দের সাথে উর্দু ফারসী,সংস্কৃত শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে কবিতার প্রাণ তেজোদীপ্ত করে তুলেছিলেন ফলে উচ্চারণে অনেক বেশি জোর ও জৌলুস আমরা খুঁজে পেয়েছি। রোমান্টিক বা প্রতিবাদের কবিতা হয়ে উঠেছে আরো রোমাঞ্চকর ও প্রতিবাদী।
পরবর্তীতে অনেক কবি এই ব্যবস্থাটিকে সুন্দর ভাবে কাজে লাগিয়েছেন। কবি আলোক মণ্ডলের প্রায় সব কবিতার মধ্যে আছে বৈদেশিক তথা ইংরেজি শব্দের প্রভূত প্রয়োগ।সময় বিশেষে এই সব ব্যবহার গুলি কবিতা গুলিকে আরো স্মার্ট আরো উচ্চারণমসৃণ ভাবের উদয় ঘটিয়েছে।ল্যাম্পপোষ্ট, হেরিটেজ বিল্ডিং,অটোফেজি,হিকিকোমোরি,ক্রায়োজেনিক,ইক্যুয়েডর,প্যারাসাইট,ডিসঅর্ডার ক্রোমোজোম,সিবেশিয়াস গ্ল্যান্ড,অলগারিদম, ইউনিকোড, অ্যান্টি পোয়েম,মেড ইন মাই হার্ট, এন্টিবায়োটিক, আফটার ফুড,এক্সপায়ারি ডেট- এমন অজস্র ইং -শব্দ ছেয়ে আছে কবিতার পঙতি পরতে পরতে। কিন্তু আমার পর্যবেক্ষণ এখানে নয় —-
কবি আলোক মণ্ডল কোন কোন ক্ষেত্রে ইংরেজি শব্দের সাথে বাংলা শব্দের যুগল মিলন ঘটিয়ে এক একটি নবতর উচ্চারণদান করেছেন যেখানে বিশেষন পদ হিসেবে ইংরেজি শব্দ টি বিশেষ্য পদ হিসেবে বাংলা শব্দের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে সেই নবতর এক্সপেরিমেন্ট প্রক্রিয়ার ভাগীদার হয়েছে।যেমন—-
অলগারিদম (বিশেষণ) রতি (বিশেষ্য)
অ্যান্টিপোয়েম -রাত কাহিনী
উল্টো উদাহরণ ও আছে –
বাংলা (বিশেষণ) ইংরেজি (বিশেষ্য)
বিজ্ঞাপনী ইউনিকোড
বিষয়গুলোর বিষয়ে আমি বেশ উত্তেজনা ফিল করলাম। আমাদের কথার ভাষায় ব্যবহারের মতো কবিতার ভাষাতে ও এরকম চলের ব্যবহার খানিকটা উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচায়ক। দারুন কবি, দারুন তোমার স্পর্ধা। এরকম এক্সপ্লোরেশন ভীষণ জরুরী বাংলা কবিতা আন্দোলনে।
আমার আলোচনা অযাচিত দীর্ঘ হচ্ছে। পাঠক বিরক্ত হচ্ছেন নিশ্চয়ই। এবার সাম আপে যাওয়াই ভালো।
কবি মাত্রেই বিশেষ শব্দদূর্বল। কবি আলোক মণ্ডল ও ব্যতিক্রম নন। ঘুঙুর, শরীর,শহর, চাঁদ,জল, বৃষ্টি, শূণ্য, আকাশ -শব্দগুলি তার বর্তমান কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতার মধ্যে ঘুরে ফিরে এসেছে। হয়তো ভিন্ন অর্থে পরিভ্রমণ করেছে তবুও এদের চলন চোখে পড়ার মতো।
সর্বোপরি –
কবিতা পাঠের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া জানানোর কোনো ব্যাকরণ নেই। আমার কাছে যা ভাল তা অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে।তাই ব্যক্তি ভালো লাগা, কোনো শব্দ, পঙতি এমনকি কোন অক্ষর বিশেষের অসামান্য প্রয়োগ সেই ভালোলাগার ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় আপনা আপনি – এই ভালোলাগাকে কোন ভাবেই ব্যাকরণের তথ্য ও তত্ত্বে গেলানো সম্ভব নয়, উচিত ও নয়। আমার ভালোলাগার দৃষ্টি দিয়ে কিছু কিছু পঙতি আমাকে মুগ্ধ করেছে এবং হয়তো অর্থ না বুঝেও শব্দ ব্রহ্ম – এই জ্ঞান ও বোধে আমি নির্মল আনন্দ পেয়েছি কবিতা গুলি পাঠ করে। এখন সেই ভালোলাগার পঙতি গুলি এখানে উল্লেখ করলাম —
(১). চাঁদ তো কলঙ্ক মাখে,ক্ষয়ে যায় পূর্ণ হবে বলে (কবিতা -ঙ)
(২) নির্বাক ছবি জানে
আয়নায় কত ঋণ (সন্ধ্যাক্ষর)
(৩) বিস্ময়সূচকচিহ্ন বড় বেশি ক্রিয়েটিভ (সন্ধ্যাক্ষর)
(৪)ঘুম এক আশ্চর্য সময় পরিধি ( মদ)
(৫) হাঁটুর ভাঁজে লুকোনো রেফ চিহ্ন (আত্মহত্যা)
এরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
কবিতা শরীর জুড়ে বিজাতীয় শব্দ ব্যবহারের মতো অনেক তদ্সম তদ্ভব শব্দের ভীড় লক্ষ্য করা গেছে। চিহ্ন, বিস্ময়,বৈখরী ভাষ্য,সন্ধ্যাক্ষর, মাৎস্যন্যায়,কৃদন্ত পদ – সেরকম কিছু দেখলাম। কিছু দুর্বোধ্য শব্দের আগমন হয়েছে এখানে যদিও তা আধুনিক লক্ষণাক্রান্ত কবিতার ভূষণ হিসেবে চিহ্নিত। কবি ফুটনোট দিয়ে সেসব গূঢ় অর্থের ব্যাখ্যা ও রেখেছেন এখানে।যেমন-
অটোফেজি,হিকিকোমোরি ইত্যাদি।
ভুল বানান চোখে পড়েনি। ছাপাই সুন্দর।
কোনো কোনো বানানে কবি প্রাচীনত্ব, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নতুন সংশোধিত বানান রীতি গ্রহণ করেছেন।
উৎসর্গ পর্বটি আদ্যন্ত একটি অতি আধুনিক উচ্চারণ। ধুমবৃষ্টি, মেঘলা মাঠ, গোল্লাছুট, ভোকাট্টা, মেঘমল্লার দৌড় – নানা শব্দ চারনাতে ভাবের এক আশ্চর্য বিস্ফোরণ। কবিতার অনুভবী হৃদয় ছুঁয়ে আরো একটু অ্যাবস্ট্রাক্ট প্রচ্ছদ কাম্য ছিল আমাদের। ধন্যবাদ টেক টাচ টক। ধন্যবাদ তাদের উদ্যোগ। কবি কে ধন্যবাদ নয়- ভালোবাসা। আবার পরবর্তী কাব্যগ্রন্থের জন্য আমাদের অধীরতা, আমাদেরঅপেক্ষা।
আলোচনায়
চন্দন চৌধুরী
ধন্যবাদ জানাই আলেচক ও প্রকাশক কে।
সমৃদ্ধ আলোচনা। বইটি পড়ার আগ্রহ জাগলো।