ক্যাফে ধারাবাহিকে সুদীপ ঘোষাল (পর্ব – ৯)

ঝিঁ ঝিঁ পোকার আলো

১৩

বন্ধু আর আমি কথা বলতেই ব্যস্ত। বড়ো ভালো লাগে ট্রেনের এগিয়ে যাওয়ার গতি। তারপর স্বস্থানে ফিরতে হবে সবাইকে।

আমার চোখে ট্রেনরর কামরাটা গোটা পৃথিবী হয়ে উঠেছে। লন্ডন থেকে আসা লাল রঙের লোকটা নবদ্বীপে নেমে গেলো হরে রাম, হরে রাম ধ্বনি দিতে দিতে। তারপরই বিষ্ঞুপ্রিয়া হল্ট। আর সেখান থেকেই আধঝুড়ি আপেল নিয়ে এক বিক্রেতা উঠলেন।

তিনি হেঁকে চলেছেন, আপেল, কাশ্মীরী আপেল। এক কেজি সত্তর,পাঁচশো চল্লিশ টাকা। দেবো নাকি? ডিলিশাস, খেয়ে দেখুন।

এদিকে  শসাওয়ালা বলছেন, দেবো নাকি ছাল ছাড়িয়ে,নুন মাখিয়ে…

আপেল দেখলাম। খুব ভালো। দুজনেই নিলাম।  আর ফুল ফ্যামিলি নিয়ে যে ধনী লোকটি এতক্ষণ সব কিছু দরদাম করে কানের পোকা মারছেন,তিনি এবার ডাকলেন,এই  আপেল, এদিকে আয়।

—-যাই বাবু, আপেল…

— কই রে, কত করে

-দিলাম সত্তর করে।

—- না না ষাট টাকার বেশি দেবো না।

তারপর অনেক কথা ক্ষয় করে বাবুটি পাঁচশো আপেল নিলেন। তারপর আমরা দুজনেই দেখলাম পঞ্চাশ টাকা তার হাতে দিলেন।

স্টেশনে এবার নামতে হবে। তাড়াতাড়ির মাথায় আপেলওয়ালা একশো টাকা মনে করে পঁয়ষট্টি টাকা ফেরত দিলেন বাবুটিকে।বাবু অম্লান বদনে  নিয়ে নিলেন টাকা। আমরা দুজনেই প্রতিবাদ করলাম। আমি বললাম, আপনি তো পঞ্চাশ টাকা দিলেন। তাহলে কোন আক্কেলে আবার এতগুলো টাকা নিলেন।

বাবু বললেন, আমি একশো টাকা দিয়েছি।মুখ সামলে কথা বলবেন।

আপেলওয়ালা বললেন, আমার ভুল হয়েছে। দেখুন আপনি ভালো করে। আপনি পঞ্চাশ টাকা দিয়েছেন।

বাবুটি সমানে তর্ক করে চলেছেন।

আপেলওয়ালা বললেন, বেশ আপনাকে আমি

ভিক্ষা দিলাম।  এই বলে তিনি নেমে গেলেন।

তারপর দেখলাম বাবু বিজয় গর্বে বলছেন, এই সুযোগ কেউ ছাড়ে মশাই। একদম ফ্রিতে আপেল।  তারপর আপেলে কামড় দিয়ে বললেন, আপনাদের দেখে নেবো।পরের স্টেশনে আমি নামবো। তারপর দেখছি।

আমার বন্ধুটি বললেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভিখারি আপনি। আপনার ক্ষমতা কই?আপনি তো নিঃস্ব রিক্ত। আপনাকে দেখে আমাদের দয়া হচ্ছে।

বাবুটি ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলেন। ওনার স্ত্রী চোখের ঈশারায় চুপ করতে বললেন স্বামীকে। পরের স্টেশনে ওনারা নেমে গেলেন।

বন্ধু বললেন, ভিখারি এরেই বলে…

আমার গল্প এখানেই শেষ। এই বলে রবি সকলকে নমস্কার জানিয়ে বসে পরলো।

 করতালি দিতে ভুলে গেলো অনেকেই…

ট্রেন থেকে নেমে আমরা চলে গেলাম বাড়ি।

ছোটোবেলার মজার কথা বলতে, ভাবতে খুব ভালো লাগে।সারা রাত পুজো দেখতে গিয়ে বন্ধুদের দলের একজনের খুব টয়লেট যাবার প্রয়োজন হলো। বন্ধু পড়লে লজ্জা পাবে। নামটা নকল বলি। হেগো, হাগুর জন্য ছটফট করছে। সামনে কোনো ব্যবস্থা নেই। হেগো কাপড়ে চোপড়ে হবার আগে প্যান্টের বোতাম খুলে ফেলেছে। একটা ড্রেনে বসতে যাবে এমন সময়ে বাড়ির মালিক বলছেন, একি আমার বাড়ির সামনে,খোলা স্থানে,আরে ছি, ছি,…

হেগো বলছে, মেসোমশাই একটুখানি, এক সেকেন্ড…

—– আরে, আরে,বেয়ারা..

মেসো ততক্ষণে নাক চেপে ধরেছেন।

হেগো তখন মরিয়া। কাজ সাবাড়। মার ছুট। মেসো আমাদের বললেন, তোমরা চেনো।

আমরা বললাম, না না। ব্যাটাকে ধরতে পারলেন না।

—— কি করে ধরবো। জল নেই। তবু, শালার ঘেন্না নেই।

বন্ধু বিপদমুক্ত হলে আমাদের আনন্দ হয়েছিলো।

আবার সাঁতার শিখতে গিয়ে,ছোটোবেলার রায়পুকুরের রাধা চূড়ার ডালটা আজও আমায়  আহ্বান করে হাত বাড়িয়ে । এই ডাল ধরেই এলোপাথারি হাত পা ছুড়তে ছুড়তে সাঁতার শিখেছি আদরের পরশে । ডুবন্ত জলে যখন জল খেয়ে ফেলতাম আনাড়ি চুমুকে, দম শেষ হয়ে আসতো তখন এই ডাল তার শক্তি দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরতো অক্লেশে । হয়তো পূর্ব জন্মে আমার দিদি হয়ে যত্ন আদর করতো এই ডালটা । কোনোদিন তাকে গাছ মনে করিনি আমি ।এখনও জল ছুঁয়ে আদরের ডাক শুনতে পাই পুকুরের ধারে গেলে । রাধা নামের মায়াচাদর জড়ানো তার সবুজ অঙ্গে ।ভালো থেকো বাল্য অনুভব । চিরন্তন প্রকৃতির শিক্ষা অঙ্গনে নাম লিখে যাক নব নবীন  শিক্ষার্থী প্রবাহ ।আমি এইসব ভাবছি। এমন সময় পিছন দিক থেকে একটা বড় পাঁঠা আমাকে গুঁতিয়ে জলে ফেলে দিলো। খুব রাগ হলো কিন্তু পাঁঠার সঙ্গে লড়াই করতে লজ্জা হলো। যদি কেউ দেখে ফেলে। তারপর গাজনের রাতে স্বাধীন আমরা। সারা রাত বোলান গান শুনতাম। সারা রাত নাচতাম বাজনার তালে তালে। সবাই মনে করতো, ব্যাটারা গাঁজার ভক্ত নাকি। গাজনে একজন হনুমান সেজেছিলো। আমরা তার লেজে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলাম। পরে দেখলাম লোকটা রাগ করে নি। বলছে,লঙ্কা পুড়িয়ে ছারখার করে দেবো।

আর হনুমান লাফিয়ে শেষে জলে ঝাঁপ দিলো।

চারদিকে প্রচুর লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।

বন্ধু রবি বলছ,ঠিক বলেছিস। তোর কথা শুনলাম। রবি আর আমি বসে গল্প করছি।

এবার শোন আমার দাদুর কথা। আমার হৃদয়ের কথা। তোকে শোনাতে পারলে ভালো লাগবে।

।রাগ,হিংসা,ক্রোধের সংমিশ্রণে সংসার স্রোতে ভাসতে ভাসতে জীবন প্রবাহ এগিয়ে চলে। হয়তো এর ফলেই দাদুর শেষজীবনে সেবার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা। আমি নিয়ম করে দাদুকে গীতাপাঠ করে শোনাতাম। দাদু কত গল্প বলতেন। কোনোদিন হা পিত্যেশ করতে দেখিনি। আমার সময় কাটতো দাদুর কাছেই বেশি। পড়াশোনার ফাঁকে চলতো গীতাপাঠ। আমি জিজ্ঞেস করতাম,দাদু মরণের পরে আমরা কোথায় যাই? দাদু বলতেন,জানি না ভাই। তবে।।মরণের পরে যদি যোগাযোগ করা যায়,তাহলে আমি তোকে নিশ্চয় জানাবো। দাদু বলতেন, আমি যখন শেষ বিছানায় শোবো,তখন আমি ঈশারা করবো হাত নেড়ে। তখন তুই গীতার কর্মযোগ অধ্যায় পড়ে শোনাবি। তোর মঙ্গল হবে। আমিও শান্তিতে যেতে পারবো। হয়েছিলো তাই। কর্মযোগ পাঠ করা শেষ হতেই দাদুর হাত মাটিতে ধপাস করে পরে গেলো। দাদু ওপাড়ে চলে গেলেন হেলতে দুলতে চারজনের কাঁধে চেপে। মাথাটা দুই বাঁশের ফাঁক গলে বেরিয়ে ঝুলছিলো। আমি বলে উঠলাম, ওগো দাঁড়াও দাদুর লাগবে। মাথাটা ঠিক কর  বালিশে দি। কেঁধো বললেন,মরে গেয়েচে। ছেড়ে দে। আমি বললাম, না ঠিক করো। তারপর ঠিক করলো দাদাভাই,দাদুর মাথাটা বালিশে দিয়ে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।