ক্যাফে ধারাবাহিকে সুদীপ ঘোষাল (পর্ব – ৫)

ঝিঁ ঝিঁ পোকার আলো

স্ত্রী সোমা বললেন, বর্ধমানের এই স্বনামধন্য কবিকে শ্রদ্ধা জানাই এই জেলার অধিবাসী হিসেবে। এই জেলা তথা সমগ্র বাংলার পক্ষ থেকে অসংখ্য কুর্ণিশ তাঁর প্রতিভাকে।

এবার সিঙ্গি গ্রামে গেলাম কাশিরামদাসের জন্মস্থানে।জনৈক মাষ্টারমশাই বললেন, কাশীরাম দাস মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের কবি। তাঁর রচিত বাংলা মহাভারত সর্বাধিক জনপ্রিয়। আনুমানিক ষোলো শতকের মধ্যভাগে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার ইন্দ্রাণী পরগনার সিঙ্গি গ্রামে এক কায়স্থ পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা রমাকান্ত দাস উড়িষ্যার পুরীতে জগন্নাথ দর্শনে গিয়ে সেখানেই বসতি স্থাপন করেন। কাশীরাম মেদিনীপুরের আওয়াসগড় রাজার শাসনাধীন কোনো এক স্থানে পাঠশালা খুলে শিক্ষকতা করেন। হরহরপুরের অভিরাম মুখুটি ছিলেন কাশীরামের গুরু। তিনি তাঁরই নির্দেশে মহাভারত রচনা করেন।কাশীরামের নামে আঠারো পর্বে সমাপ্ত বিশাল মহাভারত প্রচলিত আছে। তবে তিনি আদি, সভা, বন ও বিরাট এ চার পর্ব রচনা করে মারা যান; পরে তাঁর পুত্র, ভ্রাতুষ্পুত্র ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজন মিলে কাব্যখানি সমাপ্ত করেন। এটি ১৮০১-১৮০৩-এর মধ্যে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে আংশিকভাবে প্রকাশিত হয়। তারপর ১৮৩৬ সালে জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় একই প্রেস থেকে সম্পূর্ণ আকারে মুদ্রিত হয়। পরবর্তীকালে আরও অনেকেই কাব্যটি সম্পাদনা করেন।কাশীরামের পূর্বে ও পরে আরও অনেকে পূর্ণ ও খন্ডিত আকারে মহাভারত রচনা করেছেন; কিন্তু সেগুলির মধ্যে কাশীরামের গ্রন্থই শ্রেষ্ঠ। বেদব্যাসের সংস্কৃত মহাভারত ও অন্য অনেক উৎস থেকে উপাদান নিয়ে কাশীরাম প্রায় স্বাধীনভাবে বাংলা মহাভারত রচনা করেন। বাঙালির কাছে কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও কাশীরামের মহাভারত সমান গুরুত্বপূর্ণ। উভয় কাব্য যুগ যুগ ধরে হিন্দুদের ঘরে ঘরে পঠিত হচ্ছে।মহাভারতে নানা বিষয়ের সমাহার আছে, যেমন শাস্ত্র, পুরাণ, ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি। মহাভারত ছাড়াও কাশীরামের নামে ভারতপাঁচালী, সত্যনারায়ণের পুথি, স্বপ্নপর্ব, জলপর্ব ও নলোপাখ্যান নামক গ্রন্থগুলি প্রচলিত। তাঁর অগ্রজ কৃষ্ণদাস ও অনুজ গদাধর যথাক্রমে শ্রীকৃষ্ণবিলাস ও জগন্নাথমঙ্গল কাব্য রচনা করেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, কাশীরাম পারিবারিক ঐতিহ্যসূত্রেই কবিত্বশক্তি অর্জন করেছিলেন। বর্তমানে কাটোয়ার সিঙ্গি গ্রামে প্রতিবছর কাশীরাম দাসের স্মৃতিবার্ষিকী পালিত হয়। কাশীরাম দাস রচিত অনুবাদটি কাশীদাসী মহাভারতনামে জনপ্রিয়। যদিও কবি এটির নামকরণ করেছিলেন ভারত-পাঁচালী। এই কবিকে আমাদের প্রণাম জানাই।

সোমা বলে,সবার কাছে ভালোবাসা পেতে চায় মন।একটু স্নেহ,একটু বন্ধুত্ব আর কিছু না।মন, পুরষ্কার তো দূর অস্ত জীবনে কোন প্রশংসা পায় নি। জীবনে প্রেম পায় নি। বন্ধুর প্রেমিকার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ।সে ছিল পত্রবাহক। সুন্দরী কোন মেয়ে ফিরেও তাকায় নি। সংসারে সকলের হাসির পাত্র ছিল সে। খুব মজা পেত সকলে তাকে পেলেই। হাসি ঠাট্টায় হেরে যেত তার মন। মনের কোণে ভালোবাসার জায়গা হয় নি। সে নাকি ভালবাসার যোগ্য নয়। ইন্টারভিউয়ে পাশ করেছি অনেক। কিন্তু চাকরি পাশ কাটিয়ে হয়েছে অধরা। সে শিক্ষকতা করে কিন্তু শিক্ষক নয়।তার নামের পাশে থাকে গৃহশিক্ষক । সংসারে সাহায্য করেও কোন মূল্য পায় না। তার সম্মান মেলেনি। ভালবাসার খাবার পায় নি। কেমন যেন সিঁটিয়ে গেছে সে। খোলা হাওয়ায় বুকটা হাল্কা হলেও ভারি হয়ে থাকে বাকি সময়। এক অপরাধির মত জীবন বয়ে যায় তার। জানে না কি সেই অপরাধ যা নিয়তির দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যায় আত্মীয় স্বজন। ভালবাসতে জানে। তার কথায় কেউ ব্যথা পেলে বুকে বাজে। ভালবাসা দিলেও অবজ্ঞা জোটে। লিখতে জানি না। পড়তে পড়তে বইয়ের পাতা ঝাপসা হয়। অন্ধকার নেমে আসে। পরাজিত হয়েও অন্তরে তার আলো জ্বলে ওঠে। মনে হয়, এই বুঝি ভালবেসে এল সত্যের শেষ আলো। এই আলোয় নিষিক্ত হবে দেহ মন। আর কেউ না হোক ভালবাসে অরূপরতন।
আমি মনে পড়ে, আদুরি ছোট থেকেই গ্রামেই মানুষ। তার বাবা-মা তার জন্মের পরেই মারা যায় এবং সে তার দাদা বৌদির কাছে মানুষ হয়। ছোটবেলায় মাত্র তের বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। আর দুবছর পরেই তার স্বামী মারা যায়। অর্থাৎ সে বাল্যবিধবা হয়ে জীবন কাটায়।
এখনো কুসংস্কার সমাজে এমন দানা বেঁধে আছে যে বিদ্যাসাগর মহাশয় বিধবা বিবাহ প্রচলন করলেও তার প্রয়োগ সমাজে এখনও স্বীকৃত নয়। নানাজনে নানা কথা বলে। তার ফলে অনেক বাল্য বিধবা আর বিয়ে করতে চায় না।
সুখে দুখে শোকে আদুরি আধুনিক জীবন কাটায়। এইভাবে এই মধ্য বয়সে পৌঁছে যায়
যখন তার পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স তখন তার শরীরে ধরা পড়ে, স্তন ক্যান্সার।
পাঁচবাড়ী কাজ করে আদুরির কিছু টাকা পয়সা জমেছে সেই পয়সাগুলো খরচ করে সে তার জামাইকে নিয়ে চলে আসে কলকাতা চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতালে। সেখানে জামাই মদ খেয়ে মাতলামি করে, টাকাপয়সা গুলো কেড়ে নিয়ে চুরি করে নিয়ে পালিয়ে যায় আর আদুরি পড়ে থাকে হাসপাতালের মেঝেতে।
ডাক্তারবাবু ও নার্সরা তাকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে তাকে হাসপাতালে একটা বেড করে দেয়। তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে। কিছুদিনের মধ্যেই ডাক্তারবাবু বলেন,তাহলে স্তন কেটে বাদ দিলে তুমি সেরে উঠবে।তুমি কি এই প্রস্তাবে রাজী আছো?
আদুরি বলে,আমি রাজী।
প্রায় পনের দিন পরে আদুরির স্তন অপারেশন করে বাদ দেওয়া হয়।
প্রায় দুমাস হাসপাতালে থাকার পরে সে ছাড়া পায়।
আদুরি পথে নামে।কপর্দকশূন্য আদুরির এখন পথেই জীবন,মরণ নির্ভর করছে।

ভাদু জেলে মাছ ধরে। তার আগে তার দাদুও মাছ ধরে সংসার চালাতেন। বাড়ির পাশেই কাঁদর। অনেকে বলেন ঈশানী নদী। ভাদু অত কিছু জানে না। কাঁদরে চান, কাঁদরে টান তার। একটা তালগাছের গোড়া ফাঁপা করে ডোঙা বানানো হয়েছে কাঁদর এপার ওপার করার জন্য। ডোঙার তলাটা মাঝে মাঝে রঙ করা হয়। ডোঙায় চেপে কাঁদরে জাল ফেলা শিখেছে তার দাদুর কাছে ভাদু। তারপর মাছ ধরে বাঁশের কঞ্চির তৈরি ঝাঁপিতে ভ’রে মাছ বিক্রি করত গ্রামে গ্রামে। ছেলে ভোলাকে গাঁয়ের স্কুলে ভরতি করেছিল সাত বছর বয়সে। এখন সে হাই স্কুলে পড়ে। কিন্তু মাষ্টারমশাইরা বলেন ভাদুকে, তোর ছেলেকে বাড়িতে পড়তে বলিস। খুব ফাঁকিবাজ। এবার নম্বর খুব কম পেয়েছে।
ভাদু রাতে ছেলের কাছে বসতে পারে না। সন্ধ্যা হলেই সে চলে যায় হরিনামের আখরায়। সেখানে হরিনাম হয়। ভাদু হারমনিয়াম বাজায়। বড় সুন্দর তার হাত, সবাই বলে। এদিকে ছেলে ভোলা বই গুটিয়ে অন্ধকারে বসে থাকে কাঁদরের ধারে। পড়াশোনা তার ভাল লাগে না। কাঁদরের ধারে অনিলের সঙ্গে বসে বাঁশি বাজায়। অনিল বলে, তোর বাবা শুনলে মারবে ভোলা, সাবধানে থাকিস।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।