অথ শ্রী উপন্যাস কথায় আরণ্যক বসু (পর্ব – ৩৮)

শালজঙ্গলে বারোমাস ছয়ঋতু

শুয়ে আছো কেন ,উঠে এসো,
সব অন্তরাল তুচ্ছ করে ;
দুঃসাহসের দুটো ডানায়,
চৈত্র শেষের কোনো ভোরে।

বেয়াড়া জ্বরটা অমলেন্দুকে টানা তিনদিন গৃহবন্দি করে দিলো। জ্বর থেকে নিরাময় হবার থেকেও যে দুশ্চিন্তা ওর মনে ধাক্কা মারছিলো,তা হলো– তথ্য প্রযুক্তি আর সাংবাদিকতায় ছুটির গুরুত্ব বোধহয় অনেক কমে গেছে।একজন সিনিয়র সাংবাদিক তথা জেলা করেসপন্ডেন্ট, গোটা জেলা ছাপিয়ে বেড়ানো যার প্রতিদিনের কাজ , সে যদি তিন চারদিন ঘরে বসে থাকে,তাহলে তার ল্যাপটপের তথ্যভান্ডার কালাহারি মরুভূমি হয়ে যাবে। অমলেন্দু তাই প্রাণপণে জুনিয়র সাংবাদিক বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে , তথ্য সরবরাহ করছিল তার হেড অফিসে। এ রাজ্যের প্রান্তিক জেলাগুলোতে রাজনৈতিক খবরাখবর আর পাহাড় জঙ্গলের আবহাওয়া পরিবর্তন , দুটোর সংবাদই খুব জরুরি ।‌ তার জন্য নিজের শরীর মন ও স্কুটি বা মোটর বাইকের চাকা সবসময় সচল রাখতে হয় । এইসময় , মানে তার এই অসহায় ঘরবন্দি সময়ে , রান্না করে দেওয়া দিদিটি প্রবল স্নেহ দিয়ে তাকে আগলে রাখলেন । দুবেলা রোগীর পথ্য আর জল ওষুধ একেবারে কোলের কাছে জুগিয়ে দেওয়া , ‌মাথা ধুইয়ে, তোয়ালে দিয়ে গা স্পঞ্জ করা — তেমন লেখাপড়া না জানা মানুষটি যেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল হয়ে উঠলেন। রুটি রুজির কথা ভুলে পাগলা বিন্দাস ডাক্তার আর ওষুধের ব্যবস্থা করলো। টুকটাক বাজার হাট করে দিলো। এমনি সময় বোঝা না গেলেও , অসুস্থতার এই কদিন গ্রামের বেশ কয়েকজন নানা বয়সের মানুষ সকাল সন্ধ্যায় তার খোঁজ খবর নিয়ে গেলো । গ্যাস জ্বেলে চা করে দেওয়ার দায়িত্বটা বিন্দাস নিজের হাতেই নিয়ে নিয়েছিলো। অমলেন্দুর মুখে রুচি ছিল না। কিন্তু সাংবাদিকদের কঠোর জীবনে মুড়ি জল খেয়ে কাটানোর অভ্যেসও তার আছে।তবু জ্বর নেমে গেলে ওর খুব ইচ্ছে করছিল ,পাতলা খাস্তা পরোটা আর ঝালঝাল মাখামাখা আলুর দম খেতে। কিন্তু, মুখ ফুটে মনের কথা বলে উঠতে পারলো কি ? অকাজের এই সময়টুকুতে তার মনের আকাশে ভিড় করে এলো , দুধের গন্ধলাগা শৈশব থেকে বাস্তবের আঘাতে ছিন্নভিন্ন মধ্য যৌবন পর্যন্ত সারি সারি কত মুখ ,কত স্মৃতি ! স্মৃতি সততই সুখের না দুঃখের,তার বিচার এবারেও অমীমাংসিত থেকে গেলো , কেননা জ্বর ছেড়ে গেলে ঘটমান বর্তমান যাদুমন্ত্রে অতীতকে ভুলিয়ে দেয় ; এটাই বাস্তব।
আর তার কবিতার নারী উন্মনা — সে কি করলো এই কদিন ? না , তেমন কিছুই করেনি । ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কষ্টের কান্না বা কোথাও দেবতার থানে মানত করা– কোনোটাই উন্মনার পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে সে কি করলো ? আধুনিক ফোনের স্ক্রিনে , ছোট্ট ছোট্ট অনুরোধে, পাগলা বিন্দাসের কাছে তার সব আকুলতা পৌঁছে দিলো।সে জানতো , এই সময় বেশি কথা বললে তার কবিমন আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে ।কারণ তার পরিপূর্ণ বিশ্রাম দরকার। সে আর কি করলো ? শুভ ,তিথি ,প্রলয় বাদলদের প্রতিদিনের তথ্য সরবরাহ করলো । আর, সারাদিন সারারাত নিঃশব্দে, যেন অধরা মাধুরী হয়ে তার কবিমনের চারপাশে দশভূজা হয়ে জেগে থাকলো — থার্মোমিটার হয়ে , জিরো পাওয়ারের আলো হয়ে , খোলা জানালার সুবাতাস হয়ে , সারারাতের ফিসফিস ফ্যানের আওয়াজ হয়ে , কেটে রাখা টাটকা ফলের সুগন্ধ হয়ে , রোগীর পথ্যের পাশে সামান্য নুন- মরিচ মাখানো শশার টুকরো হয়ে থেকে গেলো । অমলেন্দু জানতেও পারলো না , স্বপ্নে কখন এসে উন্মনা তার দুচোখের পাতায় চুমু দিয়ে গেলো । ছেড়ে যাওয়া জ্বরের স্বেদবিন্দু মুছিয়ে দিয়ে , ট্যালকম পাউডার আর হালকা পারফিউম ছড়িয়ে দিয়ে গেলো । রুম ফ্রেসনারের হালকা সুগন্ধ হয়ে থেকে গেলো জানলার পর্দার ভাঁজে ভাঁজে। দুর্বল অমলেন্দু‌ , শুধু মাঝে মাঝে ফোনের ও‌প্রান্ত থেকে উন্মনার শান্ত স্বর শুনতে পেলো — বেশি ওঠাউঠি কোরো না‌, রেস্ট নাও,একদম চাপ নিও না। আমরা সবাই তোমার চারদিকে ঘিরে আছি। ঘুমিয়ে পড়ো কবিমন। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি–ব্যস,ওইটুকুই । দিনে বার তিনেক।তার বেশি নয়। কিন্তু লন্ডন থেকে তার প্রিয় বন্ধু মেঘলার নিঃশব্দ ও উৎকন্ঠিত ফোন আসতেই , অমলেন্দু বুঝে নিলো ,এই নেটওয়ার্কের যাদুকর তার কবিতার নারী উন্মনা।
‌ ‌চতুর্থ দিন সকাল নটায় উন্মনার একটা মেসেজ এলো — আমরা সবাই অনুষ্টানের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ও আমার কবিমন , তুমি নিশ্চিন্ত থাকো । আজ রাত নটা নাগাদ আমাদের কনফারেন্স কলে যোগ দিতে পারবে ? জানি, এত রাতে ধকল নেওয়া এখনও তোমার পক্ষে সম্ভব নয় । তবু আমাদের মধ্যে , কেউ চাকরি , কেউ টিউশন করে ‌। তার আগে সবাই সময় দিতে পারবে না। বিন্দাসকে বলে দিয়েছি , ও সাড়ে আটটায় তোমাকে ডিনারটা রেডি করে দেবে , আর কনফারেন্স কলের শেষে, তোমাকে দিনের শেষ ওষুধটা খাইয়ে বাড়ি ফিরবে। তোমার অসুবিধে হবে না তো কবিমন ? সবাই যে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। তাদের ঠেকিয়ে রাখবো কিভাবে ? উত্তরে , অমলেন্দুর অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছে করলেও, শুধু দু একটা কথা লিখতে পারলো — রাতের খাওয়া শেষ করে আমি অপেক্ষা করবো। তুমি কিচ্ছু চিন্তা কোরো না।আমি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছি।
সেদিন রাতের কনফারেন্স কলে , সবার প্রথমে স্পীকার অন করে অমলেন্দু সবাইকে শোনালো বিন্দাসের গান। আশ্চর্য এই আধপাগলা লোকটার অনুভূতি ! সে দুলে দুলে শোনালো রবিঠাকুরের গান । যেন সাতসকালে ঝাপটের ঢাল স্টেশন পেরিয়ে, বোলপুরের দিকে বয়ে যাওয়া লোকাল ট্রেনের কামরায় , একতারা হাতে কোনো কিশোর বাউল গাইছে — তুমি খুশি থাক ,আমার পানে চেয়ে চেয়ে খুশি থাক, তোমার আঙিনাতে বেড়াই যখন গেয়ে গেয়ে……
ভাগ্যিস কনফারেন্স কলে কারোর নিঃশব্দ কান্না দেখা যায় না ,তাই পাশে বসা পাগলা বিন্দাস ছাড়া কেউ দেখতে পেলো না , অমলেন্দু কাঁদছে ।
‌ দিলখোলা মিটিং এর প্রাণখোলা আলোচনায় অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিয়ে দুচার কথা বলা ছাড়া , উন্মনা আগাগোড়া চুপচাপ থাকলো।বাদল মেঘ সবার কাছে ক্ষমা চাইলো তার অনভিপ্রেত আচরণের জন্য। ঠিক হলো ,উন্মনার গ্রামের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েরা , জনা পঞ্চাশেক মানুষের জন্য সকালের জলখাবার ,দুপুরের খাওয়া দাওয়া এবং বিকেলের বিদায়ী চা পর্যন্ত রান্নাবান্না করবে‌ । বাদল আর তিথি প্রায় একসঙ্গেই ঘোষনা করলো — তাদের টিউশনের রোজগার থেকে হাজার তিনেক টাকা এদিনের অনুষ্ঠানের জন্য তারা দিতে চায় । অমলেন্দুর মৃদু আপত্তি ধোপে টিকলো না । উন্মনা তার দায়িত্ব বুঝে নিয়ে‌ ,মুদুস্বরে আবেদন করলো — আমার মা সেদিন আপনাদের সবাইকে একটা গান শোনাতে চায়। কিন্তু, বিন্দাসদার গানের পাশে সে গান কি আপনাদের ভালো লাগবে ? স্বয়ং বিন্দাসই অমলেন্দুর ফোনে চিৎকার করে উঠলো — মায়ের গানই শ্রেষ্ঠ গান ,মায়ের দানই শ্রেষ্ঠ দান। তারপর গ্রামীন রাতের স্তব্ধতা খান খান করে, যেন স্বদেশী যাত্রার আসরে অপ্রতিরোধ্য মুকুন্দদাস হয়ে গেয়ে উঠলো — মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই ,দীন দুখিনী মা যে তোদের ,এর বেশি আর সাধ্য নাই।
‌‌কনফারেন্স কলে কোন সুদূর থেকে ভেসে এলো উন্মনার আর্তি — বিন্দাসদা ,তুমি গান শুনিয়ে এমন পাগল করে দিতে পারো কি করে গো ? যন্ত্রণা থেকে উপশমে,আবার উপশম থেকে নতুন কোনো বেদনায় কেমন করে নিয়ে যাও গো ? তুমি যেন রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে উঠে এসেছো আজকের দুনিয়ায়।দুবেলা দুমুঠো মাধুকরীর বাইরে তোমার সমস্ত চিন্তাভাবনা যেন গানের গভীরে বাসা বেঁধেছে । তিথি বললো — তুমি নিজেই গান বাঁধো না কেন গো বিন্দাসদা ? লালন ফকিরের মতো ? তোমার কথা , তোমার বেদনা তুমি নিজেই ফুটিয়ে তোলো। ঠিক সেই মুহূর্তে, আধশোয়া অসুস্থ অমলেন্দুর বুকে মুখ গুঁজে বাস্তব দুনিয়ার কাছে আপাত অপ্রয়োজনীয় গানের বিন্দাস, প্রাণের বিন্দাস কাঁদছিলো অথবা কান্না লুকোচ্ছিলো।আর তার জীবনের ধ্রুবতারা তাকে ভালোবাসার শেষ বিন্দু দিয়ে জড়িয়ে রেখেছিলো । অনুভবের কবি প্রলয় বোধহয় কিছু বুঝতে পেরেই বললো — আমি প্রতিজ্ঞা করছি , আমাদের কবিতার বাড়িতে তুমি নিজের হাতে , নিজস্ব ভাষায় গানের কথা লিখবে । তারপর সুর ঢেলে দেবে সেই প্রাণের কথাতে । বয়সে ছোটো শুভ আরও উৎসাহিত হয়ে বললো — বিন্দাসদা, তোমার কাছ থেকে আমি গান লেখা শিখবো । ছোটোবেলা থেকে আমার সখ ,আমি আকাশবাণীর গীতিকার হব । আরেক অনুভবী কবি বাদল মেঘ মৃদু স্বরে উচ্চারণ করলো রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির কবিতা–
ধুলায় লুটানো নীরব আমার বীণা , বেজে উঠেছিল অনাহত কী আঘাতে …
শুনতে শুনতে অমলেন্দু কিছু বলবার চেষ্টা করতেই , সবকিছু ছাপিয়ে বেজে উঠলো তিথির রিনরিনে কন্ঠস্বর। যেন গীতবিতানের পৃষ্ঠা থেকে, শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলায় মোহরদি গেয়ে চলেছেন–
শূন্য করিয়া রাখ তোর বাঁশি,
বাজাবার যিনি বাজাবেন আসি….
‌ এমন গানের শেষে স্তব্ধতা যেন রূপসী বাংলা হয়ে উঠে আসে। তবু আগামী অনুষ্ঠানের বাকি কথাগুলো দ্রুত সেরে ফেলার শেষে , কবিতার অমলেন্দুর ক্লান্ত কন্ঠস্বরকে ছুটি দিতে চায় না তার কবিতার নারী উন্মনা। সবাইকে শুভ রাত্রি জানাতে গিয়ে , তার পাগলী মন প্রিয় কবিমনের কাছে যেন কিছু শুনতে চায় । না , কথায় নয় — যেন অনুভবের ইথার তরঙ্গে । ক্লান্ত চোখে ঘুম নেমে আসা অমলেন্দু বিন্দাসকে কোমলভাবে জড়িয়ে ধরে উচ্চারণ করে — কল্লোল যুগের কবি , বাংলা ভাষার চিরদিনের কবি , ফেরারী ফৌজ , নীলকন্ঠ আর বেনামী বন্দরের কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের অসাধারণ কবিতা “নিরর্থক”এর কয়েকটি লাইন —
দরজা জানলা ভেজাও যত না
আকাশই তোমায় খুঁজবে।
পাল্লা,সার্সি,ফাটলে, ফুটোয়,
কত কাঁথা কানি গুঁজবে !
উঁকি দেবে , দেবে, দেবেই ,
যতই ভাবো না কিছু নেই ,
একদিন ঠিক শিরায় শোণিতে
ছটফটে ছোঁয়া বুঝবে !

কনফারেন্স কলের শেষে , পাগলা বিন্দাসকে বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে দিতে,ওর কাঁধে হাত রেখে অমলেন্দু নিশ্চিতভাবে জানালো — আর পারছি না রে বিন্দাস– কত কাজ পড়ে রয়েছে । কাল থেকে আমি কাজে বেরোবোই। তুই প্লিজ অনুমতি দে বন্ধু।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।