সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মৌসুমী নন্দী (যাপন চিত্র – ৪০)

যাপনচিত্র-৪০
রম্যরচনা – সিঙ্গেল

স্কুল ফেরৎ ভাড়া-বাড়ির উঠোনে পা দিয়েই চমকে উঠলেন শরৎবাবু, গোটা বাড়ি জুড়ে কেমন যেন একটা থমথমে পরিবেশ! রাস্তার পাশে বেশ কয়েকটা বাইক, সাইকেল আর দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে৷ পাশাপাশি বাড়ির যে দরজা জানালা গুলো জীবনে খুলতে দেখেননি, রাস্তার ধুলো পড়ে পড়ে কাঠের পাল্লাগুলো লাল মাটির ঘোলা জলের রঙ ধরেছে, সেই দরজা জানালাগুলোও হাট করে খোলা৷ শুধু খোলা নয়, বেশ কয়েকটা মাথা জানালার সাথে সেঁটে আছে আর যতগুলো মাথা তত জোড়া চোখ তাঁর ঘরের দিকে শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে৷ প্রমাদ গুনলেন, এত কৌতুহল তো কোন আনন্দের কারণে হতে পারে না৷ মনের মধ্যে কেমন যেন একটা তোলপাড় শুরু হল, বাইক থেকে নেমে কোনরকমে উঠোনে পা দিলেন, আর প্রথম ধাক্কাটা ধেয়ে এল ঠিক তখনই৷

রান্নার মাসি কাপড়ের খুঁটে চোখের জল মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, উঠানে শরৎবাবুকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন! শুধু তাই নয়, যে ভদ্রমহিলা জীবনে কোনদিন তার মুখোমুখি দাঁড়ানো তো দুরের কথা, কথা পর্যন্ত বলেননি, যা কিছু কথা বার্তা মাইনে বোনাস সব তার স্ত্রীর সাথে হয়, সেই ভদ্রমহিলাই শরৎবাবুর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালেন৷ দুচোখে অগ্নি বর্ষণ করে বললেন,—’ছিঃ দাদাবাবু ছিঃ, আমি আপনাকে কত শ্রদ্ধা করতাম! সেই আপনিও, ছিঃ! আমি তো ভাবতেই পারছি না, আপনি না শিক্ষক?? বিষ্ময়ে হতবাক শরৎবাবু নিজের কানকেই বিশ্বাস করে উঠতে পারলেন না, কি হল ব্যাপারটা? ওদিকে কিছু বোধগম্য হওয়ার আগেই মনে হল যেন একটা ঘুর্ণি ঝড় বয়ে গেল গোটা উঠোন ঘিরে! টেনশন বাড়লো, বাইকটা সাইডে স্ট্যান্ড করে উঠোন পিছনে রেখে ঘরের দিকে পা বাড়ালেন, চোখাচোখি হল রণর সাথে৷ রণ পাড়ার প্রতিটি ঘরে ঘরে দুধ ডেলিভারি করে৷ আগামীকাল জন্মাষ্টমীর ভোর তাই আজ রাত্রেই গোপালের জন্য ক্ষীর বানানো হবে, সেই জন্যই রণকে এক্সট্রা দু প্যাকেট দুধের অর্ডার দিয়েছিলেন৷ শরৎবাবু দ্বিতীয়বার ধাক্কা খেলেন যখন দেখলেন রণ ওনাকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় হালকা চোখ মিটকে ঠোঁটের কোনে একটা ফচকে হাসি ছুঁড়ে দিয়ে গেল, মনে হল যেন হালকা গলা ঝাড়ার একটা আওয়াজও হল!! হ্যাঁ, স্পষ্ট গলা ঝাড়ার শব্দ, চমকে উঠলেন! রণ তো জীবনে এমন আচরন করেনি, যথেষ্ট ভদ্র ছেলের মতই ব্যবহার করে এসেছে এতদিন, শরৎবাবুকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে এসেছে যে, আজ সেই ছেলেই ইয়ার দোস্তের মত মুচকি হেসে চোখ মারছে!! শরীরটা কেমন যেন খারাপ বোধ হতে লাগলো, ঘরের সদর দরজায় পা রাখলেন৷

সামনেই হলঘর, তারপর বামদিকে রান্নাঘর, ডানদিকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, পাশাপাশি দুটো রুম, গোটাটা জুড়ে আজ যেন চাঁদের হাট৷ কে নেই সেখানে, বড় পিসি আর পিসেমশাই বসে সিঁড়ির ধাপে৷ মামা আর মামীমা, দিদিমা সবাই হলের মেঝেতে৷ শ্বশুর মশাই শাশুড়িমা রান্নাঘরের দরজায়৷ পাশের ঘরের রমেশ কাকা কাকিমা সমেত একটা ঘরে৷ আর আরেকটা ঘরে জয়িতা, শরৎবাবুর একমাত্র স্ত্রী বিছানায় শয্যাশায়ী প্রায়! তাকে ঘিরে চক্রবর্তীবাড়র বড় গিন্নীমা৷
কি হল জয়িতার, এত লোক কেন ঘরে, সবাই চুপচাপ কেন? এত সব প্রশ্নের মাঝে বড় মাসি বলে উঠলেন,
—’হ্যাঁরে শরৎ, এটা তুই কি করলি!! তুই করতে পারলি!!’বড়মেসো মাসির কাছ থেকে উঠে এসে শরৎবাবুর কানে ফিসফিস করে বললেন,
—’কদ্দিন হচ্চে!! ঘরে জানাজানি হল কিকরে!!’
ওদিকে শাশুড়ি মা কিছু একটা বলতে চাইছেন, কিন্তু কান্নার দমকে শুধু ‘বাবা জেবন’ ছাড়া আর কিছু বেরোতে পারছে না ঠোঁটের ফাঁক গলে, পাশে বসে শ্বশুর মশাই দেশলাইয়ে কাঠি দিয়ে সাদা মেঝেতে কাল্পনিক আল্পনা এঁকে চলেছেন, কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে শাশুড়িমা পাশে বসে থাকলে উনি বরাবর এটাই করেন৷ মামা উঠে এসে কাঁধে হাত রাখলেন, তারপর আফশোষ সুচক ভঙ্গীতে মুখে চুক চুক শব্দ করে, আড়াইবার ঘাড় নেড়ে এগিয়ে গেলেন বাথরুমের দিকে৷ মামার একটু ঐ ইয়ের প্রবলেম, মানে টেনশন হলেই বাথরুম পায় আর কি!! কিন্তু মামার কিসের টেনশন? মামিমা কোন এক অজানা কারণে অস্পষ্ট ভাবে গজগজ করে চলেছেন, ‘ওলাউঠো, অনামুখো, ইয়ে কোথাকার, সংসারটা গেল’ এরকম আরও হাজারও শব্দ মামীমার মুখ দিয়ে অস্পষ্ট ভাবে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে! মিলনখুড়ো বিড়িতে মোক্ষম এক টান দিয়ে বললেন, ‘কত ছোট থেকে দেখি ছেলেটাকে, এমনটা ত ছিল না কখনও! কত ভাল ছেলে ছিল, যখন ছোট ছিল তখনও প্রতিদিন সকাল হলেই স্কুলে যেত আবার স্কুল থেকে সোজা ঘর! বড় হয়েও তাই, ইস্কুলটি আর ঘরটি ছাড়া আর কিছু জানতো না! না, এতদিন কোন টাল বেটাল নেই! কি যে হল!!’ কাকিমা বিরাট মাপের দীর্ঘশ্বাস শুন্যে ভাসিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ইস্কুলগুলান বন্ধ করে দিয়েই যত গন্ডগোল হয়েছে! যদ্দিন ইস্কুল ছিল বাবু যা হচ্ছিল ইস্কুলেই হচ্ছিল! ইস্কুল বন্ধ হতেই ইস্কুলের জিনিস ঘরে ঢুকে পড়েছে!! সব সরকারের দোষ!’ দিদিমা পাশ থেকে সন্দেহের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কার কথা বলছো! কেন্দ্র , না রাজ্য’? ওদিকে জয়িতা, মাঝেমধ্যেই গুমরে গুমরে উঠছেন, চক্রবর্তী গিন্নীমা গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছেন, ‘সহ্য কর মা সহ্য কর! কপাল পুড়লে আর কি করবি? তোর দাদুও তো….’ ফুঁপিয়ে উঠে চোখে আঁচল দিলেন গিন্নীমা৷
শরমৎবাবুর এখনো মাথার উপর দিয়ে জল বইছে, এখনও পর্যন্ত কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি৷ প্রবলেমটা কার, প্রবলেমটা আসলে কি?? ঘরে ঢুকে ভাবলেন হয়ত জয়িতারর শরীর খারাপ, কদিন ধরেই মাথাটা হালকা ব্যথা ব্যথা করছে বলছিল৷ হাত রাখলেন স্ত্রীর কপালে, মুহুর্তের মধ্যে ‘…তবু আমার মন পাবি না’ স্টাইলে শরৎবাবুর হাত ছুঁড়ে ফেললেন এক ধাক্কায়৷ একের পর এক ইয়েতে জেরবার শরৎবাবু চক্রবর্তী গিন্নীমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন, গিন্নীমা বললেন,
—’এই বয়েসে এসে এমনটা কেউ করে শরৎ!! তোমাকে আমরা কত ছোট থেকে কোলে পিঠে মানুষ করেছি, তোমার দাদু বলে জীবনের মত ছেলে আর হয় না! সেই তুমিই কিনা? না ঠিক আছে, ভুল হতেই পারে৷ সে যতক্ষন বাইরে আছো, নাহয় হল! পুরুষ মানুষের একটু আধটু ভুল হতেই পারে, তোমার দাদুও তো…’
গিন্নীমা আবার চোখে আঁচল দিলেন৷ শরৎবাবু বললেন,—’কি হয়েছে বলুন তো!! কি করেছি আমি? ব্যাপারটা কি!! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না?’
গিন্নীমা বললেন,—’মেয়েটি কি তোমাদেরই ইস্কুলের ম্যাডাম হয় নাকি!!’—’কোন মেয়েটি! কার কথা বলছেন??’—’ঐ যে, যে মেয়েটিকে ফোনে বলো যে ‘আমার বিয়ে হয়নি, আমি ফাঁকা আছি’?’
শরৎবাবুর দুই চোয়ালের মধ্যে দুরত্ব ক্রমশ বাড়ছে,
—’আমি ফোন করি, ম্যাডামকে ফোন করে এসব বলেছি?? আমাদের স্কুলে তো কোন ম্যাডামই নেই!!’
জয়িতা , অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন,—পৃথিবীতে আর কোন ম্যাডাম নাই নাকি? আর ‘ফোন করি কাকে’, সাধু সাজা হচ্ছে!! তাও যদি আমি নিজের কানে না শুনতাম! ছিঃ ছিঃ ছিঃ, একদিন নয় আধদিন নয়, আজ এতদিন ধরে তাও আবার ঘরে বসেই, আমার সামনেই!!’শরৎবাবুর একমাত্র স্ত্রী আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লেন! বামুন গিন্নীমা বললেন,—’তুমি নাকি কেস টেসের দিকেও এগাচ্ছো, বৌমা ডিভোর্স না দিলে কি একেবারে কেসই করে দেবে!!’
জয়িতারদেবীর কান্নার আওয়াজ বৃদ্ধি পেল, শরৎবাবু মেঝেতে ভূপতিত হয়ে বললেন,—’কিসের ডিভোর্স! কিসের কেস!! আর আমি কখন কাকে বলেছি যে আমার বিয়ে হয়নি, ফাঁকা আছি বলে??’
কান্না থামিয়ে স্ত্রী বলে উঠলেন,—’আবার ন্যাকামি করা হচ্ছে! সব কি ভেঙে ফুটে বলতে হয় নাকি, না আমি কিছু বুঝিনি৷ সারা দিনে আটবার দশবার করে ফোন! যখনই কথা বলে তখনই ‘সিঙ্গেল টিচার, সিঙ্গেল টিচার’ ! তারপরে আবার বলে, ‘বলব ছেড়ে দিতে, না দিলে সোজা কেস করব’! এত সহজে ছাড়বনি আমি বলে দিলাম, সে কেসই কর আর যাই কর! ও গো আমি দুটো ছেলে নিয়ে কোথা যাবো গো…’
কান্নায় ভেঙে পড়লেন জয়িতা দেবী, ততোধিক উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলেন শরৎবাবু, মোবাইলের স্ক্রীনে ‘RECOMMENDATION LETTER CANNOT BE ISSUED SINCE THERE IS ONLY SINGLE_TEACHER IN THE CONCERNED SUBJECT.ঠিক এমন সময় দরজার বাইরে ঠক ঠক আওয়াজ৷ কমল জ্যাঠা, দুই বগলে ক্রাচ নিয়ে শম্বুক গতিতে এগিয়ে আসছেন, জ্যাঠা মাস তিনেক আগে ভয়ঙ্কর বাইক দুর্ঘটনায় পড়ে কোমরের বেশ কিছু হাড়গোড় হারিয়ে প্রায় কোমায় চলে গিয়েছিলেন, ডাক্তার অপারেশন সেরে বলেছিলেন ‘অন্তত বছর দেড়েক বিছানা ছেড়ে উঠবেন না, ফুল বেড রেস্ট’! সেই জ্যাঠাকেই ক্রাচ বগলে উঠোনে এসে দাঁড়াতে দেখে সকলেই বিষ্ময়ে হতবাক, জ্যাঠার মুখে বিশ্বজয়ের হাসি,কি রে শরৎ, লোতন বউ কুথা?’
সবাই একসাথে কেঁদে উঠলো.. শরৎ বাবুর এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্হা উনি ভাবছেন এর চেয়ে একা স্কুল চালানো অনেক ভালো –জুতা টা আবার গলিয়ে নিয়ে স্কুলের দিকে ছুটলেন —

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।