সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে রীতা পাল (পর্ব – ২)

যাও পাখি দূরে

“ত্রিশ দিন রাখলাম মাকে ত্রিশ সলতা জ্বেলেগা
আর রাখতে পারলাম না যে মকর আইচে লিতে গো।
এসেছো মকর বেশ করেছ টুসু রাখবো যতনে। আবার মোরা লিতে যাব পৌষ মাসের প্রথমে।”

গানের সুর ধরে নদীর পাড় ধরে হাঁটছিলো দু’জনে। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিল। নদীর ঘাটে এসে ওরা দাঁড়ালন। মেয়েরা টুসু ভাসান দিচ্ছে আর গান গাইছে। সে এক অপরূপ দৃশ্য। সবিতা দেবী আগে কখনো দেখেননি। ননদের বাড়ি এসে দেখলেন। মূর্তিগুলি ভাসান দিতে মন চায় না তবু দিতে হয়। মাস্টার মশাই বলে উঠলেন,“ রাঢ় বাংলার প্রাচীন লোক সংস্কৃতি উৎসব টুসু। পুরো পৌষ মাস ধরে টুসুকে আরাধনার পর পৌষ সংক্রান্তিতে টুসুকে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় বাংলার ঐতিহ্যময় এই উৎসব। ” স্বামীর কথা মন দিয়ে শুনছিলেন সবিতা দেবী। টুসুকে নিয়ে পরম যত্নে বয়ে যাওয়া কুমারী নদীকে বড় আপন মনে হয়েছিল। তাইতো যখন মেয়ে হয়,নাম রাখেন কুমারী। কিন্তু আজ কেন এমন হচ্ছে? অনেক চেষ্টা করেও নদীটার কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। টুসু দেবীর মূর্তিগুলি কেমন তার পানে চেয়ে আছে। কারা যেন সব মূর্তিগুলোকে ফেলে রেখে গেছে। সবিতা দেবী একটার পর একটা টুসু কুড়িয়ে যাচ্ছেন কিন্তু নদী কই?
কাচের গ্লাস ভাঙ্গার শব্দে সবিতা দেবীর ঘুম ভেঙে গেল। কুমারী বিছানার পাশে রাখা টেবিলটা থেকে জলের গ্লাস নিতে গিয়ে গ্লাসটা পড়ে গেছে। অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সবিতা দেবী আরেকটা গ্লাসে জল নিয়ে এসে বললেন,“ এটা খা। আমি সব পরিস্কার করে দিচ্ছি।”

সকালে ডাক্তার বাবু এসে কুমারীকে চেকআপ করলেন। সবিতা দেবীকে ডেকে বললেন,“ এবার ওকে আস্তে আস্তে হাঁটাবেন। ওর সাথে বেশিক্ষণ সময় কাটাবেন। ওর বন্ধু-বান্ধবদের খবর দিন। ওদের দেখে ও আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা,এই অ্যাক্সিডেন্টে দুইজন মারা গেছে,ও কি সেটা জানে?”
“ জানি না। যে ছেলেটা গাড়ি চালাচ্ছিল ও আর একটি মেয়ে মারা গেছে। বাকিদের চোট লেগেছে কিন্তু বেঁচে গেছে। মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আমি কারোর সাথে যোগাযোগ করতে পারি নি। ”
“ ও ঠিক আছে। ওর ইউরিন টেস্টের রিপোর্ট টা পেলে জানাবেন। আজ আসি।”
“ কি বললেন স্যার,ইউরিন টেস্ট?”
“ সব টেস্ট করা হয়েছে। কারণ ওর পায়ে প্লেট বসানোর পর আরও দু’বার অপারেশন করা হয়েছে। মাথার অপারেশনটা তো প্রথমেই হয়েছে। শুধু একবার ওই টেস্টটা করিয়ে নিন। আচ্ছা,চলি।”
সবিতা দেবীর শিড়দাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। গলাটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আর কোন কথা বের হচ্ছে না। ডাক্তারবাবু চলে যেতেই দরজা বন্ধ করে ড্রইং রুমের সোফাতে বসে পড়লেন।
দিন গড়িয়ে রাত নামল। কুমারীর বমি বন্ধ হল না।

মুঠোফোনটা বেজেই চলেছে। সুখেন বাবুর ফোন। সবিতা দেবী ইচ্ছে করেই ফোনটা ধরছেন না। বারবার রিং হচ্ছে। সবিতা দেবী জানেন কেন সুখেন বাবু স্কুল থেকে বারবার ফোন করছেন? কি বলবেন তিনি। কি করে বলবেন মেয়ের রিপোর্ট কি?

ক্রমশঃ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।