|| গুস্তাভ রবার্ট কির্চহফ: জন্মদিনে স্মরণলেখ || মৃদুল শ্রীমানী

গুস্তাভ রবার্ট কির্চহফ: জন্মদিনে স্মরণলেখ
আজ বারো মার্চ পদার্থবিজ্ঞানী গুস্তাভ রবার্ট কির্চহফ এর জন্মদিন। আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ তারিখে পূর্ব প্রাশিয়ার কোনিগসবার্গে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এখন আমরা কোনিগসবার্গকে কালিনিনগ্রাদ বলে চিনি। এটি হাল আমলের রাশিয়ার একটি উল্লেখযোগ্য শহর।
তড়িৎ বর্তনী বা ইলেকট্রিক্যাল সার্কিট, বর্ণালী বীক্ষণ বা স্পেকট্রোস্কোপি, এবং বিকিরণ বা রেডিয়েশনের নির্গমন নিঃসরণ এবং শোষণ বিষয়ে গুস্তাভ কির্চহফ উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা গড়ে ওঠার ভিত্তিমূলে কির্চহফের গবেষণা গভীর ভূমিকা পালন করেছে।
১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে স্থানীয় কোনিগসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কির্চহফ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি বার্লিনে চলে যান। সেখানে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতার কাজ পান। ১৮৫০ অবধি কির্চহফ বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। এরপর কির্চহফ অধ্যাপনার দায়িত্ব পেয়ে ব্রেসলাউ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এখন ওই বিশ্ববিদ্যালয় পোল্যাণ্ডের রোকলাও বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত।
ব্রেসলাউতে গুস্তাভ রবার্ট কির্চহফ যখন অধ্যাপনা করছেন, তখন সেখানে অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছিলেন সমসময়ের আরেকজন বিশ্ববরেণ্য রসায়ন বিজ্ঞানী, আরেক রবার্ট। রবার্ট উইলহেলম বুনসেন ( ৩১ মার্চ ১৮১১ – ১৬ আগস্ট ১৮৯৯)। রসায়নবিদ বুনসেন এর সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানী কির্চহফের আলাপ বিজ্ঞান জগতে এক অসামান্য ঘটনা। বয়সে বুনসেন বছর তেরোর বড় হলেও দুজনের মধ্যে গভীর সখ্যতা গড়ে ওঠে। পরে এই সখ্য পদার্থবিদ্যার জগতে নব নবোন্মেষশালিনী জ্ঞানের সিংহদুয়ার উন্মোচন করে দেয়। রবার্ট উইলহেলম বুনসেন ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার দায়িত্ব নিয়ে চলে যান। হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় জার্মানির প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। এই প্রতিষ্ঠান গোটা ইউরোপের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির অন্যতম। ও বিশেষ সম্মানিত। বুনসেন হাইডেলবার্গে গিয়ে পরম স্নেহভাজন কির্চহফকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে চাইছিলেন। সেকাজে সফলতা এলে ১৮৫৪ নাগাদ কির্চহফ হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করলেন। এখানেই বুনসেন ও কির্চহফ যুগলবন্দী অসাধারণ এক একটি আবিষ্কার করতে থাকেন। বুনসেন ওখানে রসায়ন বিভাগে তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে কোনো ধাতুর বিশুদ্ধ নমুনা সংগ্রহ করার কাজে ব্যাপৃত ছিলেন। কির্চহফের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি স্পেকট্রোস্কোপ উদ্ভাবন করেছেন।
ওঁরা একযোগে কাজ করতে করতে স্পেকট্রোস্কোপির মাধ্যমে কোনো রাসায়নিক যৌগিক পদার্থের গঠনমূলক উপাদানগুলি চিহ্নিত করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ওঁরা লক্ষ করেন যে নির্দিষ্ট মৌলিক পদার্থের বিশুদ্ধ নমুনার বর্ণালী বিন্যাস নির্দিষ্ট রকম হয়ে থাকে। অর্থাৎ বর্ণালী বিন্যাসের দ্বারা কোনো মৌলিক পদার্থকে সনাক্ত করা সম্ভব।
অধ্যাপক বুনসেন লক্ষ করেছিলেন যে, নানাবিধ রাসায়নিক পদার্থ আগুনের শিখায় উত্তপ্ত করলে তা বিভিন্ন রঙের আলো নিঃসরণ করে। কোন্ পদার্থের শিখা কোন্ রঙের আলো নির্গত হয়, তা নিয়ে নিবিড়ভাবে গবেষণা করছিলেন বুনসেন। কোনো পদার্থ উত্তপ্ত করলে যে আলো বেরোয়, প্রিজমের মাধ্যমে তার বর্ণালী তৈরি করে আলোর পটিগুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ওই নির্দিষ্ট রাসায়নিক যৌগের মৌল উপাদান গুলি চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেন বুনসেন। সোডিয়াম, লিথিয়াম আর পটাশিয়ামের স্পেকট্রোস্কোপি লক্ষ করে তাদেরকে চিহ্নিত করা গেল।
১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে কির্চহফ লক্ষ করলেন যে, সূর্যের বর্ণালীতে যে কালো অংশগুলি দেখা যায়, কোনো সোডিয়াম যৌগ বুনসেন শিখায় উত্তপ্ত করতে থাকা অবস্থায় সূর্যের রশ্মি তার মধ্য দিয়ে চালনা করলে সেই কালো অংশগুলির কৃষ্ণত্বের গাঢ়তা বৃদ্ধি পায়। এই থেকে বিভিন্ন নক্ষত্রের অভ্যন্তরে কী কী উপাদান ক্রিয়াশীল রয়েছে, তা চিহ্নিত করার পথ তৈরি হয়ে গেল। ওই ১৮৫৯ সালেই কির্চহফ উত্তপ্ত পদার্থ থেকে কেমন বিকিরণ নিঃসৃত হয় তা লক্ষ করছিলেন। ওই সঙ্গে আরো নজর করছিলেন কোন্ পদার্থ কি মাত্রায় তাপ শোষণ করে। এই বিষয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে করতে কির্চহফ একটি তত্ত্ব দাঁড় করান। আজ আমরা ওকে কির্চহফের থার্মাল রেডিয়েশন নিয়ম বলে জানি। এই নিয়মটিতে কির্চহফ বললেন, তাপীয় অবস্থার ভারসাম্য বা ইকুইলিব্রিয়াম থাকলে একটি বস্তু যে পরিমাণ বিকিরণ নিঃসরণ করে, তা ওই বস্তুটির দ্বারা শোষিত বিকিরণের সমান। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে বুনসেন এবং কির্চহফ যৌথ উদ্যোগে বিভিন্ন ধাতুর বর্ণালীর বৈশিষ্ট্যগুলি নির্ধারণ করেন। সৌর বিকিরণের বর্ণালী বিশ্লেষণের মাধ্যমে সূর্যের ভিতর ক্রিয়াশীল উপাদানগুলির রাসায়নিক পরিচয় নির্ধারণের কাজ করতে করতে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা সিজিয়াম এবং ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে রুবিডিয়াম নামে দু দুটি মৌলিক পদার্থ আবিষ্কার করেছেন।
১৮৬২ তে কির্চহফ পদার্থবিদ্যার জগতে ব্ল্যাক বডির ধারণা আনলেন। তিনি বললেন, ব্ল্যাক বডি হল এমন একটা বস্তু যা কিনা তাপীয় বিকিরণের নিঃসরণ ও শোষণের ক্ষেত্রে নিখুঁত ভূমিকা পালন করে থাকে। পরে আমরা দেখব, এই ব্ল্যাক বডি রেডিয়েশন কোয়ান্টাম তত্ত্বের উদ্ভাবন ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কাছে পড়তে এসেছিলেন পরবর্তীকালের বিখ্যাত বিজ্ঞানী দিমিত্রি মেণ্ডেলিভ ( ১৮৩৪ – ১৯০৭)।
১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে কির্চহফ বার্লিনে ফ্রিডরিশ উইলহেলমস বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান শাখায় অধ্যাপনার দায়িত্ব নেন। এখানেই ১৮৭৭ এ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয় নওজওয়ান বৈজ্ঞানিক ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ( ২৩ এপ্রিল ১৮৫৮ – ৪ অক্টোবর ১৯৪৭) এর। প্ল্যাঙ্ক কির্চহফের ছাত্র ছিলেন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে প্ল্যাঙ্ক তাঁর ডক্টরাল থিসিস অন দি সেকেন্ড প্রিন্সিপলস অফ মেকানিক্যাল হিট পেশ করেন। ১৮৮৯ এ প্ল্যাঙ্ক তাঁর শিক্ষক কির্চহফের স্থলাভিষিক্ত হন। ১৮৯৪ থেকে প্ল্যাঙ্ক ব্ল্যাক বডি রেডিয়েশন নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ১৯ অক্টোবর তারিখে প্ল্যাঙ্ক ব্ল্যাক বডি বিকিরণের কির্চহফকৃত নিয়মের ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা অপনোদন করে তাকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করেন। ১৯১৮ তে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক এনার্জি কোয়ান্টা নিয়ে গবেষণার স্বীকৃতি হিসাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
কির্চহফ আলোকবিজ্ঞান নিয়েও গবেষণা করেছেন। ওয়েভ ইকুয়েশন নিয়ে চর্চা করে তিনি ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস এর তত্ত্বটিকে একটি বলিষ্ঠ ভিত্তির উপরে দাঁড় করিয়ে দেন। ১৮৮৭ সালের ১৭ অক্টোবর তারিখে কির্চহফের জীবনাবসান হয়।
আজ জন্মদিন উপলক্ষে কির্চহফের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি।