কর্ণফুলির গল্প বলায় রবীন জাকারিয়া

হাবিব মানেই বন্ধু নয়-গল্প
প্রথম অধ্যায়
আমাদের স্কুলটা ছিল বেশ বড়৷ বিরাট খেলার মাঠ৷ বড় বড় ক্লাশ রুম৷ চারিদিকে ফলের গাছ আর একদিকে একটা বিশাল পাইকর গাছ৷ এতবড় যে প্রায় পুরো মাঠটাকেই যেন ছায়ায় আচ্ছাদিত করেছে৷ কোন সীমানা প্রাচীর নেই৷ সরকারী বাদে এতদাঞ্চলে যেহেতু বেসরকারী উচ্চ বিদ্যালয় আর নেই তাই বহু দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থিরা পড়তে আসে৷ আমার বাসাটা স্কুল সংলগ্ন এবং সত্যি কি আমার আর্থিক ও সামাজিক অবস্থাও অনেক সমৃদ্ধ৷ তাই কোন সমস্যা হয়নি৷ কিন্ত ঐসব ছাত্রদের বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা ছাত্রদের কষ্টটা বেশ চোখে পড়ে৷ সেই সকালে কিছু খেয়ে পায়ে হেঁটে স্কুলে আসা৷ বিকেল অবধি না খেয়ে আবার বাড়ি ফেরা চাট্টিখানি কথা নয়৷ শিক্ষার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ ছাড়া এটা অসম্ভব৷
তখনো শিক্ষার্থি তথা শিশুদের মধ্যে সামাজিক-আর্থিক বিভাজন রচিত হয়নি বলেই হয়তো আমাদের মতো সমাজের সুবিধাভোগী শিক্ষার্থিরা একই স্কুলে এবং একই সাথে পাঠগ্রহণ করেছি৷
তবে যতই সাম্যর কথা বলিনা কেন! পরিবার, পোষাক-পরিচ্ছদ, জীবনাচার এমনিতেই বিভাজন টেনে দেয় কিংবা বলা যায় শিক্ষকরাই ইনিয়ে বিনিয়ে তা অন্যদের বুঝিয়ে দেয়, “এরা তোদের প্রভু আর তোরা এদের ভৃত্য”৷
আমি খুব ডানপিটে আর মিশুক ছিলাম৷ তাই আমার বন্ধুও ছিলো বেশি৷ অবশ্য ছাত্র হিসেবেও ভালো ছিলাম৷ তবে একজন ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু৷ ওর নাম হাবিব৷ যদিও হাবিব অর্থ বন্ধু৷
হাবিবের সাথে আমার বন্ধুত্বটা কিন্ত শত্রুতা দিয়ে শুরু৷ সেদিন স্কুলের পাশের বাড়ির গাছ থেকে আম চুরির প্ল্যান করছিলাম৷ চুরির সময় কে কী দায়িত্ব পালন করবে সেটা বোঝাচ্ছিলাম৷ সকলে রাজী৷ কিন্ত হাবিব বাঁধা দিলো৷ অন্যদেরকেও নিষেধ করলো যেনো এ সমস্ত অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকে৷ ওর কথা শুনে প্রচন্ড রেগে গেলাম৷ আজ পর্যন্ত কেউ আমার কথার অবাধ্য হয়নি৷ যা বলেছি তাই শুনতে বাধ্য হয়েছে৷ আমি হলাম দলনেতা৷ অথচ এই মলিন পোষাকে আচ্ছাদিত এক গেঁয়ো ছেলে আমাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ছে? নিজের সামন্তবাদী কুৎসিত চেহারা বেরিয়ে পড়লো৷ রাগে-অপমানে অন্ধ হয়ে ওকে ভীষণভাবে মারলাম৷ ওর নাক ফেটে রক্ত ঝরছে৷ এটা দেখে ভয় পেয়ে গেলাম৷ তাড়াতাড়ি “ফার্স্ট এইড” বক্স নিয়ে এসে সকলে মিলে সেবা-শুশ্রুষা করলাম৷ সেদিন টিফিন পিরিয়ডটা এভাবেই কেটে গেল৷ আমার একদিকে প্রচন্ড ভয় আর অন্যদিকে অপরাধবোধ জাগ্রত হলো৷
দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম ক্লাশেই শ্রেণি শিক্ষক হাবিবকে প্রশ্ন কলেন কী করে হলো? সে বললো টিউবয়েলের হ্যান্ডেল লেগে ব্যাথা পেয়েছে৷ ওর উত্তরে আমি নীরবেই কেঁদে ফেললাম৷ ছুটির পর ওকে জরিয়ে ধরে বললাম “সরি”৷
এরপর থেকে ওর প্রতি একটা আলাদা ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা কাজ করতো৷ ক্রমে ক্রমে তা ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে রূপ নেয়৷
টিফিন পিরিয়ডে আমি বাড়িতে ভাত খেয়ে আসি৷ ওকে বহুবার চেষ্টা করেও খাওয়াতে পারিনি৷ কেননা ওর আত্মমর্যাদা ছিলো প্রখর৷ নিজের সীমাবদ্ধতাকে সে মিথ্যার চাঁদরে না ঢেকে বরং বীরের মতো গ্রহণ করেছে৷
এর কিছুদিন পর অষ্টম শ্রেণির রেজাল্ট প্রকাশ হলো৷ সবাইকে ডিঙিয়ে হাবিব প্রথম হলো আর আমি দ্বিতীয়৷ এই প্রথমবার আমি ক্লাশ পরীক্ষায় প্রথম হতে পারলাম না৷ নবম শ্রেণিতে যথারীতি বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম৷ হাবিবও তাই৷ বাহিরে যতই গভীর বন্ধুত্ব থাকনা কেন ভেতরে ভেতরে চলতে থাকলো ওর সাথে আমার তীব্র প্রতিযোগীতা৷ কে কাকে ছেড়ে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করে৷ আমাদের স্কুলের বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরীগুলো ছিলো খুবই সমৃদ্ধ এবং বিশাল৷ তাই সেখানে গবেষণা করতে সমস্যা হতো না৷ মনে পরে বায়োলজির স্যার ব্যাঙের এনাটমি করার পর যখন আবার ব্যাঙের পেট সেলাই করে ছেড়ে দিত৷ তখন নিজেকে ডাক্তার ডাক্তার মনে হতো৷ অবসরে নিজে একাই ল্যাবরেটরীতে ব্যাঙের বক্ষচ্ছেদ করতাম৷ এত প্রাচূর্য, বিলাসিতা, সুবিধা পাওয়ার পরও সত্য বলতে কি আমি কখনোই হাবিবকে টপকাতে পারিনি৷ দ্বিতীয় হয়েই থাকতে হয়েছে৷
মেট্রিক পরীক্ষায় হাবিব পাঁচটি বিষয়ে লেটার মার্কসসহ বোর্ডে ষষ্ঠ স্টান্ড করেছিলো আর আমি চারটি বিষয়ে লেটার মার্কসসহ অষ্টম৷
এরপর দু’জনে ভিন্ন ভিন্ন কলেজে ভর্তি হই৷ সম্ভবত এখানেই সূচণা হয় বিত্ত্ব দিয়ে মানুষে মানুষে বিভাজন৷ এরপর ধীরে ধীরে হাবিবের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়৷ তখনতো মুঠোফোন ছিলোনা!
দ্বিতীয় অধ্যায়
বায়োগ্রাফি:-
বায়োগ্রাফি আমার পরিবার: আমার পিতা কলেজ ছাত্রাবস্থায় আওয়ামী ছাত্রলীগ করতেন৷ তাই ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন৷ ৭০’র নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের সকল স্বাধীনতাকামী মানুষের মতো আওয়ামী লীগের পক্ষে, স্বাধীকারের পক্ষে কাজ করেন৷ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর নিজেকে যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত করেন এবং গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন৷ প্রশিক্ষণের সার্টিফিকেট পাবার পর তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য তৈরি হন৷ এমতাবস্থায় আমার দাদা তাঁর পরিবারের সকলকে নিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন৷ যুদ্ধ শেষ হলে তাঁরা পুনরায় দেশে ফিরে আসেন৷
স্বাধীন দেশে নতুন কাঠামো, নতুন স্বপ্ন আর জীবন-জীবিকাকে নব উদ্যমে ঢেলে সাজাবার অবিরাম যাত্রা—বন্ধুর পথ—যেতে হবে বহুদূর৷ পাশাপাশি দেশের বীর সন্তানদের—যাঁদের আত্মত্যাগে আজ এই স্বাধীনতা৷ তাঁদেরকে দেয়া হলো বীরত্বের সনদ৷ বাবার যেহেতু প্রশিক্ষণের সনদ ছিলো৷ তাই তিনি পেয়ে গেলেন “বীর মুক্তিযোদ্ধার সনদ”৷
এই একটি সনদ একটি পরিবারকে কীভাবে সম্মানিত করে৷ কীভাবে বদলিয়ে দিতে জীবন-জীবিকা৷ তা শুধু আমরাই জানি৷ এই সনদের জন্য বাবা সরকারী চাকুরি পেলেন৷ আমরা কোটা পেলাম৷ সেই কোটায় ভালো স্কুল/কলেজ পেলাম৷ সরকারী চাকুরি পেলাম৷ মাসিক মাসোহারাসহ বিশেষ উৎসব ভাতা পেলাম৷ আমাদের সন্তানেরা দাদার সনদের দাপটে ভালো স্কুল/কলেজ পেলো৷ সরকারী চাকুরিতে কোটা পেলো৷ আমার মা আমৃত্যু মাসোহারা পাচ্ছেন৷ আরো কত কী!
বায়োগ্রাফি হাবিবের পরিবার: হাবিবের বাবা বামপন্থি রাজনীতিক ছিলেন৷ ডাকসাইটে না হলেও নিবেদিত কর্মি ছিলেন৷ তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের জীবনকে পণ্য হিসেবে গণ্য করে পুঁজিবাদের এই নোংরা খেলা একদিন শেষ হবে৷ ভোগবাদী আর বিলাসী জীবনের মোহ ত্যাগ করে মানুষ একদিন ঠিকই উপলদ্ধি করবে শ্বাসত সত্য৷ বিশেষ করে প্রলেতারিয়েত বা মজদুর শ্রেণি৷ একদিন যখন দেখবে তাদের হাড্ডিচর্মসার দেহটা বাদে আর অবশিষ্ট নেই কিছুই৷ সেদিন বিপ্লব অবস্যাম্ভাবী৷ মানুষ নিশ্চয়ই রচিত করবে এক সাম্যবাদ সমাজ৷
তিনি জানেন পাকিস্তানের দুই অংশের এ লড়াই হলো পুঁজিবাদের নোংরা কৌশল৷ মানুষের মর্যাদা, সমাজ, সম্পদ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সাধারণ মানুষের কোন প্রবেশাধিকার না থাকা৷ তথা চাপিয়ে দেয়া এক অসম যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মাধ্যমে জনগণের অধিকার কেড়ে নেয়ার বিরুদ্ধে জনতার বিপ্লব৷
তাই তিনি বসে থাকেননি৷ শুধু নিজে একাই নয় বরং সমমনা ব্যক্তিদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছেন৷ জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছেন৷ তিনি কোন সেক্টর কমান্ডারস কী বলেছেন এটা না জেনে বরং “হয় স্বাধীনতা আনবো কিংবা জীবন দেবো” এই মন্ত্রে দীক্ষা লাভ করে যুদ্ধ করেছেন৷ দেশ স্বাধীন হলে তিনি নিজের সংসার, আয়-রোজগার এসব বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেন৷ কোন সনদ পাবেন এমন চিন্তাই তাঁর ছিলোনা৷ বরং তাঁর রাজনৈতিক জীবনে পৈতৃকভাবে প্রাপ্ত সম্পদ জনকল্যাণমূলক কাজে দান করেন৷
তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ছিলেন জাসদের আব্দুল জলিল৷ ১৯৮১ সালে যখন উনি সমাজতন্ত্রিক দর্শন ছেড়ে ইসলামী দর্শনে বিশ্বাসী হন৷ তিনিও ইসলামী মূল্যবোধে আকৃষ্ট হন এবং আরো বেশি বেশি জনহিতকর কাজ করতে থাকেন৷ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ইয়াতীমখানা ইত্যাদি৷ এমনিভাবে একদিন তাঁর নিজের সম্পদ প্রায় শেষ হয়ে গেল৷ উপায়ান্তর না পেয়ে ঐ মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে আমৃত্যু চাকরি করেন৷ সেই সামান্য রোজগারে সন্তানদের মানুষ করেন৷ আর হাবিবদের হার না মানার জীবন সংগ্রাম শিখিয়ে দেন৷
তৃতীয় অধ্যায়
আমি সচিবালয়ে কর্মরত আছি৷ ঢাকাতেই সেটলড৷ বাবা মারা গেছেন৷ মা আমার সাথে থাকেন না৷ তবে ঢাকাতেই থাকেন৷ আলাদা ফ্ল্যাটে৷ মুক্তিযোদ্ধার কোটায় মা একটা ফ্ল্যাট পেয়েছেন৷ বাবার মাসোহারীটা মা তোলেন৷ বেশ ভালই আছেন৷ তাছাড়া এখনকার বৌমারা শাশুরীর যে যত্ন নেয় তারচেয়ে সামর্থ থাকলে আলাদা থাকাই ভালো৷ অবশ্য মাসে মাসে আমি টাকা পাঠাই৷ ঢাকায় বর্তমানে আমার ১৪টি বাসা আছে৷ বিভিন্ন শপিং মলে গোটা দশেক দোকান আছে৷ এছাড়া আমাদের এক ছেলে৷ সে স্বস্ত্রীক থাকে আমেরিকায়৷ আর মেয়ে স্বামীসহ থাকে কানাডায়৷ মারশাআল্লাহ্ ওখানেও দুটি করে চারটি বাড়ি করেছি৷ রিটায়ারমেন্টের আর বছর তিনেক বাকি৷ ভাবছি অবসরের পর প্রবাসেই বাকী জীবন কাটাবো৷
হয়তো মন সায় দেবেনা৷ তবুও এদেশে কি আর থাকা যায়? মানুষ এত সহিংস আর অসৎ হয়ে গেছে ভাবতেই খারাপ লাগে!
পেপার খুললেই খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, দুর্নীতি ভাল্লাগে? ক’দিন আগে দেখলাম ওয়াসার এমডি’র নাকি বিদেশে ১৪টি বাড়ি৷ ভাবা যায়! এত অসৎ হয় কী করে মানুষ? আরে বাবা চুরিরওতো একটা লিমিট আছে!
আজ ব্যক্তিগত বিশেষ একটা কাজে রংপুরে যাচ্ছি৷ ঢাকা এয়ারপোর্টে বসে আছি তো আছি! বিমান লেট৷ ভমেস্টিক বিমান৷ ৫০ মিনিটের পথ৷ তোর আবার কীসের লেট? রাবিশ! দেশটা শেষ করে দিলো কিছু অসভ্যরা৷ এদের না আছে কমিটমেন্ট, না আছে দেশপ্রেম৷
অবশেষে দু’ঘন্টা পর সৈয়দপুরে নামলাম৷ গেট পেরিয়ে সামনে ট্যাক্সি, উবার খোঁজ করেও ব্যর্থ হলাম৷ গাড়ি না আনতে বলাটা ভুলই করেছি৷ একটা মাইক্রো পেলাম৷ এসি নেই৷ গাদাগাদি মানুষ৷ ১২জন না হলে ছাড়বেনা৷ জনপ্রতি ৫০০/- টাকা৷ আরে ব্যাটা এই খোঁয়াড়ে ১২জন বসবে কোথায়? নাহ্ দেশটা শেষ হয়ে গেল৷ সবাই ধান্ধাবাজ!
ঠিক করলাম এভাবে যেতে পারবোনা৷ তারচেয়ে একটা অটোরিক্সা রিজার্ভ করলেতো হাওয়া খেতে খেতে যাওয়া যায়! এয়ারপোর্ট এলাকা থেকে বেড়িয়ে একটা টিস্টলে এককাপ চা আর সিগারেট খেতে খেতে অটোরিক্সা রিজার্ভ করে রওয়ানা দিলাম৷ লাগেজ তেমন কিছু নেই একটা একটা ট্রলি ব্যাগ আর এটাচি৷ মাঝবয়সি অটোচালক যাত্রা শুরু করলো৷ চারিদিক থেকে হাওয়া যেন ক্লান্ত শরীর মনকে শীতল করে দিলো৷ ঘুম ঘুম ভাব আসছে৷ দূর করার জন্য চালকের সাথে গল্প করতে চেষ্টা করলাম৷ কিন্ত চালক বেশ স্মার্ট উত্তরে আমাকে আশাহত করলো৷ সে বললো আমরা হাইওয়ে পথ চলছি তাই কথা বলে আমার এটেইনশন নষ্ট করবেন না দয়া করে৷ অগত্যা চুপ করে গেলাম৷
এক-দেড় ঘন্টা পর আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছে অটো বিদায় দিলাম৷ প্রচন্ড ক্লান্তির কারনে রুমে ঢুকে ফ্রেস হয়ে একটা লম্বা ঘুম দিলাম৷
ঘুম ভাঙলো বিকেলে৷ সতেজ শরীরে এক কাপ ব্ল্যাক কফি আর একটা লেক্সাস বিস্কুট বিকেলের নাস্তা সারলাম৷ ঠোঁটে একটা সিগারেট লাগিয়ে ডেস্কে বসে পরলাম৷ যেজন্য আসা এখন সেই কাজটা শেষ করতে হবে৷ বেডের পাশে গেলাম এটাচীটা আনতে৷ কিন্ত একী! এটাচী কোথায়? মাথা ঘুরতে লাগলো! ভয়ানক বিপদ৷ সর্বনাশ হয়ে যাবে! নিজের চাকরির৷ ক্যারিয়ারের৷ এ টাকা দিতে হবে মন্ত্রীর শ্যালককে৷ বিশাল এমাউন্টের একটি ঠিকাদারী কাজের ৩%৷ অর্থাৎ কয়েক কোটি টাকা৷ যা ঐ এটাচীতে আছে৷ এখন কী হবে? ঐ হারামজাদা অটোচালক চুরি করেছে৷ ওকে এখন কোথায় পাবো? তাছাড়া এটা পুলিশকে জানানো যাবেনা৷ এটা অবৈধ টাকা৷ মাথা আউলায় যাচ্ছে! বমি বমি লাগছে! আচ্ছা আমার কি হার্ট এটাক করছে? আমি কি মরে যাচ্ছি? হায় আল্লাহ্ আমি এত অসৎ কাজ, অপরাধ করে শেষে জাহান্নামী হয়ে মরছি! এত সম্পদ, এত টাকা কিছুইতো কাজে লাগবেনা৷ হে আল্লাহ্ তুমি মাফ করো৷ সেই ছেলেবেলায় শেখা দু’চারটি সুরা যেগুলো এখনো মুখস্থ আছে কাঁদতে কাঁদতে সেগুলোই পড়তে থাকলাম৷
দরজায় কলিং বেলের অনবরত কর্কশ শব্দে সম্বিত ফিরে পেলাম৷ দরজা খুললাম৷ দেখলাম এক মলিন অথচ দৃঢ়চেতা অপরিচিত ব্যক্তি দাঁড়িয়ে৷ কর্কশ গলায় বললাম কী চাই? সাহায্য-টাহায্য হবেনা যান৷ ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি দিয়ে বললো’
আপনি কি আকবর সাহেব?
আপনি কি আজ সৈয়দপুর থেকে এসেছেন? আপনি কি কোন কিছু হারিয়ে ফেলেছেন?
সম্মতি সূচক মাথা নাড়া দেখে বললো, তাহলে এই নিন বলে এটাচীটা আমার হাতে তুলে দিলো৷ আমি স্থম্ভিত! মুখ দিয়ে কিছু বেরুচ্ছিলোনা৷ অবশেষে সম্বিত ফিরে পেয়ে বললাম, তুমি কি জানো এতে কী আছে?
সে বললো জানার ইচ্ছে না থাকার পরও শুধু ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে দেখেছি “প্রচুর টাকা” আর জীবন বৃত্তান্ত৷
এতো টাকা নিলেনা কেন?
উত্তরে বললো’ কিছু মানুষের জন্ম হয়েছে শুধু নেয়ার জন্য আর কিছু মানুষের দেবার জন্য, আমি দ্বিতীয় দলের”৷
কিছু মনে কোরোনা তুমি কি একটু ভেতরে আসবে? সে ঢুকলে তাকে জোর করে বসালাম৷ তার ব্যক্তিত্ব, দৃঢ়চেতা আর সততার জন্য নিজে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়েও এই প্রথম একজন অতি সাধারণ মানুষ যে কিনা একটা সামান্য অটোচালক তাকে অনেকটা অনুনয়ের সুরে বললাম, তোমার সততার জন্য আমি পুরষ্কৃত করতে চাই৷ তুমি নিলে খুব খুশি হবো৷ তাছাড়া তোমার পরিবার, ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য কাজে লাগবে৷ সে প্রচন্ডভাবে রেগে গেলো৷ তারপর যা বললো তার জন্য মোটেও প্রস্ত্তত ছিলামনা৷
শুনুন মি. আকবর শিক্ষা আপনাদের আলোকিত না করে বরং নির্লজ্জ বানিয়েছে৷ আপনারা মানুষকে আন্ডারমাইন্ড করেন৷
আপনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার যোগ্যতা পরিমাপ না করে তাকে ভিক্ষুক মনে করছেন? আমার অটোটা আপনার বাবা কিনে দেয়নি যে তাকে তুমি সম্মোধন করবেন৷
দেশটা আপনার বাবার তালুক নয় আপনারা ইচ্ছেমতো বেঁচে দেবেন৷ আর পরিবারের এবং সন্তানের কথা বললেন না? আপনার জ্ঞাতার্থে বলছি আমাদের ছেলে বুয়েট থেকে পাশ করে এখন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার৷ আমাদের মেয়ে সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার৷ আর আপনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি বোটানিতে মাস্টার্স করে আপনাদের মত ঘুষখোর লোকদের চাহিদা মেটাতে পারেনি বলে চাকরি পায়নি৷
আমার বাবা দেশের জন্য যুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনেছিল৷ অথচ তাকে মরতে হয়েছে কীভাবে জানেন? তাঁকে জঙ্গী বানিয়ে হত্যা করে গুম করা হয়েছে৷ কী আজব তাই না? এখানে কার্ল মার্কসের নামে রাজনীতি করা যায়৷ এখানে মাও সেতুং, আব্রাহাম লিংকন, মুজীব, জিয়া, এরশাদ এমনকি মওদুদীর আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করা যাবে৷ যাবে না শুধু মুহাম্মদের নামে৷ আমার বাবা যখন সমাজতন্ত্র করেছে তা করেছে তৎকালীন তার বিশ্বাস থেকে৷ আবার যখন ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য সাংবিধানিক অধিকার বলে ইসলামী দল করেছে তখন পরিপূর্ণ ইসলামী মূল্যবোধ থেকেই৷ অথচ যে কিনা জঙ্গীবাদ কিংবা রাজাকারদের ঘৃণা করতো তাকেই মরতে হলো জঙ্গীর তকমা নিয়ে৷ একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সনদ৷
আমি বললা যদি সত্যিই তোমার সন্তানেরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে থাকে তাহলে তুমি এখনো অটো চালাও কেন?
এতে তোমার সন্তান ডিগনিটি নষ্ট হচ্ছেনা?
সে উত্তরে বললো, না আমাদের সন্তানদের আমরা সেভাবেই তৈরি করেছি৷ তারা প্রথমে মানুষ হয়েছে৷ তারপর ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার৷ ওরা ওদের কলিগসহ মিডিয়াতেও দৃঢ়ভাবে বলতে পারে আমাদের বাবা অটোচালক৷ কেননা এটা আমার আইডেনটিটি৷ আপনারা ইউরোপ-আমেরিকার সমাজের কথা বলেন না! তারা তাদের আইডেনটিটি অস্বীকার করেনা৷ যাহোক আপনি ভালো থাকুন৷ ধন্যবাদ৷ বলে লোকটি চলে যাচ্ছিলো৷ হঠাৎ কী মনে করে গেটের কাছে একটু দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে রহস্যভরা হাসি দিয়ে বললো আকবর তুমি জীবনে কোনদিনই আমাকে টপকাতে পারলেনা৷ না ছাত্র হিসেবে আর না-তো মানুষ হিসেবে৷ আমি হাবিব৷ গুড বাই৷
আমি দৌড়ে গিয়ে ওকে জরিয়ে ধরে বলতে চাচ্ছিলাম হাবিব আমার শৈশবের হাবিব৷ আমার প্রিয় বন্ধু৷
ও হাতটা তুলে আমাকে থামিয়ে দিলো৷ বললো যারা শিক্ষিত হয়ে নিজের সততা নষ্ট করে, যারা সেবা প্রদানকারীর দায়িত্ব পেয়ে গণমানুষের অধিকার লুন্ঠন করে, যারা এত রক্তের বিনিময়ের অর্জিত স্বাধীনতার চেতনা বিকিয়ে দেয় ক’আনা পয়সায় তারা কখনোই কারো বন্ধু হতে না৷
আর মনে রাখবেন হাবিব মানেই বন্ধু নয়৷