গুলজারের কবিতা – অনুবাদে অর্ঘ্য দত্ত (একত্রে – ১৩)

(ভূমিকা – অর্ঘ্যর সৌভাগ্য হয়েছিল কিছুদিন গুলজারের সান্নিধ্যে থেকে তাঁকে একটি অনুবাদে সাহায্য করার। গুলজারের দীর্ঘ সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন একটি নিউজ পোর্টালের জন্য। তাঁর কবিতা বাংলায় অনুবাদের ইচ্ছা প্রকাশ করাতে তিনি অর্ঘ্যর হাতে নিজে তুলে দিয়েছিলেন তাঁর কবিতার সংকলন, ‘রাত পশমীনে কী’। সেই সংকলন থেকেই এখানে এক ডজন নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ।
অর্ঘ্য চেষ্টা করেছেন যতটা সম্ভব মূলানুগ থাকতে। গুলজার নিজে যেখানে প্রচলিত ইংরাজি শব্দ ব্যবহার করেছেন, অনুবাদেও তা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এমনকি কবিতার পংক্তি বিভাজন, পংক্তির দৈর্ঘ্য ও যতিচিহ্নও রাখা হয়েছে মূলানুসারী। অর্থাৎ, বইয়ের পাতায় ছাপা কবিতাটির ভিস্যুয়াল যেন একই থাকে সেদিকেও মনোযোগ দিয়েছেন অর্ঘ্য। কবিতা বেছে নেওয়ার সময় খেয়াল করেছেন যাতে গুলজারের কবিতার বিষয় বৈচিত্র্যটি ধরা পড়ে।
– মুখ্য সম্পাদক)
১.
জিন্দানামা
এক রাতে লাহৌরের অলিগলি পেরিয়ে এসে চাঁদ
জেলের উঁচু পাঁচিলের ওপর চড়ে
ঠিক যেন ‘কমাণ্ডো’-র মতো লাফ দিয়ে ‘সেল’-এ ঢুকেছিল
এতটুকু শব্দ হয়নি পায়ের,
পাহারাদারেরা টেরও পায়নি!
শুনেছি নাকি ‘ফৈজ’-এর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল
‘ফৈজ’-কে বলতে গিয়েছিল, একটা কবিতা বলো
সময়ের নাড়ি থমকে আছে!
কিছু বলো,
যাতে সময়ের স্পন্দন ফিরে আসে!!
( ‘ফৈজ’ হলেন কবি ফৈজ আহমেদ ফৈজ, যাকে আমরা অনেকে ফয়েজ বলি। বামপন্থী এই কবি কারারূদ্ধ
ছিলেন।
‘জিন্দানামা’- ১৯৫৬-য় প্রকাশিত ফৈজ আহমেদ ফৈজ-এর একটি কাব্য সংগ্রহ। )
২.
সংশয়
একটা আক্ষেপ রয়ে গেছে
সংশয় আর কিছু অতৃপ্তিও…
এসো না আরেকবার ঝগড়া ক’রে দেখি
হয়ত এর থেকে ভালো কোনও
অন্য কারণ পেয়ে যাবো
আবার আলাদা হয়ে যাওয়ার।
৩.
পোশাক
আমার দেরাজে ঝোলে খুশিরঙ তোমার পোশাক
প্রতিবার ঘরে ধুই আমি,
আর শোকানোর পরে ফের,
নিজে হাতে ইস্ত্রি করি, কিন্তু,
ইস্ত্রিতেও যায় না কুঁচকে থাকা মিহি ভাঁজ,
বাসি অভিযোগের গোল দাগ ধুলেও মোছে না!
এ জীবন কতটা সহজ হয়ে যেত
যদি সম্পর্কও হতো আমাদের পোশাক–
আর কামিজের মতোই তাকে বদলে নেওয়া যেত!
৪.
অমলতাস
পেছনের জানালাটা খুললেই নজরে আসতো
দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা অমলতাস গাছ
নিঃসঙ্গ, একা।
পাখনার মতো মেলে দেওয়া তার শাখা
যেন সে নিজেই এক পাখি।
পাখিরাই রোজ এসে ওকে প্ররোচনা দিত
যখন কানে কানে শোনাতো উড়ানের কথা
দেখাতো ওদের ওড়াউড়ি
নানা কেরামতি করে।
মেঘ ছুঁয়ে বলে যেত ঠান্ডা হাওয়ার কত মজা!
ঝড়ের হাত ধরেই বোধহয়
কাল ও নিজেই ওড়ার চেষ্টা করেছিল
রাস্তার মধ্যে এসে পড়ে আছে মুখ থুবড়ে।
৫.
স্কেচ
মনে আছে একদিন…
আমার টেবিলে বসে বসে
সিগারেট প্যাকেটের ওপর তুমি
ছোট্ট গাছের চারার
এক স্কেচ করেছিলে…!
এসে দেখো
সে চারায় কেমন মুকুল ধরেছে!
৬.
একটি কবিতা
এ’পথ সহজ নয় মোটে
যে পথে আমার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে
একা একাই বেড়িয়ে পড়েছ তুমি
পাছে পথ ভুল করো এই ভয়ে
প্রতিটি মোড়ে কবিতা দাঁড় করিয়ে রেখেছি!
যদি ক্লান্ত হও …
অথবা তোমার কোনো প্রয়োজন পড়ে
একটা কবিতার আঙ্গুল ধরে ফিরে এসো!
৭.
মেঘ-১
রাতে ফের মেঘ এসে
ভেজা ভেজা হাতে যখন দরজা খটখটালো
আমি উঠে সটান বিছানায় বসে ছিলাম
প্রায়ই নিচে এসে ও এই কাঁচা বস্তির
লোকেদের হম্বিতম্বি করে
বেচারারা দেওয়ালে আলকাতরা লাগিয়ে
উপরের ঘুলঘুলি সব বন্ধ করে দেয়
যাতে মেঘ ঘরের ভেতরে উঁকি না দিতে পারে…
কিন্তু, তাও…
গরজানো, তড়পানো মেঘ
প্রায়ই এমন ভাবে বস্তি লুট করে যায়
যেন ঠাকুরদের পাঠানো কোন গুন্ডা
মস্তানি করে গেছে এই বস্তি জুড়ে!
৮.
মহাবিশ্ব-১
ব্যাস, কয়েক কোটি বছরের মধ্যে
সূর্যের আগুন যেই নিভে যাবে
সূর্য থেকে উড়বে শুধু ছাই
যখন কোনো চাঁদ আর ডুববে না
উঠে আসবে না কোনও পৃথিবী
তখন নিভে যাওয়া ঠাণ্ডা এক কয়লার
টুকরোর মতো এই ধরিত্রী ঘুরতে থাকবে
লক্ষ্যহীন, অকারণ
মৃদু ছাইরঙা এক আলোর ভেতর!
আমি ভাবি, ঐ সময়ে যদি
কাগজে লেখা কোনো কবিতা উড়তে উড়তে
সূর্যে গিয়ে পড়ে
সূর্য ঠিক আবার জ্বলে উঠবে!!
৯.
মহাবিশ্ব-৪
রাতে যখনই আমার ঘুম ভেঙে যায়
খালি পায়েই বেরিয়ে পড়ি
আকাশ ডিঙিয়ে আরও দূরে
ছায়াপথ ছুঁয়ে যে পাকদণ্ডী চলে গেছে
তার খিড়কি-বাগানের ‘কমলা’ নক্ষত্রের দিকে
আকাশগঙ্গায় পা রেখে রেখে
এই ভেবে চলতে থাকি
জেগে থাকা কোনো তারা যদি জুটে যায়
আর পড়শির মতো ডেকে বলে
আজকের রাতটা এখানেই থেকে যাও
তুমি পৃথিবীতে একা
আমি নিঃসঙ্গ এখানে
১০.
মুম্বাই
রাত যখন মুম্বাইয়ের সড়কের ওপর
নিজের হাত দুটো পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে
কালো বিড়ালের মতো শুয়ে থাকে
চোখের পলক কখনও না ফেলে–
তখন ওর ভারী দীর্ঘনিঃশ্বাস গুলো
শুকনো সাগর তটে উড়ে উড়ে বেড়ায়!
১১.
পড়োশি
কিছুদিন ধরে পড়োশির
ঘরে খাঁ খাঁ নীরবতা
না রেডিও চলে
না ওই রাতের উঠোনে
বাসনের ঝনৎকার।
ও বাড়ির পোষা কুকুরটি
সারাদিন দুটো খাবারের জন্য
আমার ঘরের সামনে বসে থাকে
রাত হলে ফের ওই বাড়ির
চৌকাঠে মাথা রেখে
চুপ করে শুয়ে থাকে!
১২.
রেপ
এমন তো কিছুই ছিল না, যা হামেশা সিনেমায় দেখায়!
না ছিল বৃষ্টি, না ঝোড়ো হাওয়া, না জঙ্গলের
কোনো মোহিনী দৃশ্য,
আকাশেও ছিল না কোনো মায়াবিনী চাঁদ যা উন্মাদ করে তুলবে।
না কোনো ঝর্ণা, না নদীর উথলে ওঠা
যৌবন তরঙ্গ
আবহে ছিল না এমন কোনও গান
যা অনুভূতিকে কামনায় আচ্ছন্ন করবে
না ওই ভেজা বৃষ্টিতে ছিল কোনো উচ্ছল যুবতী
কেবল নারী, এই ছিল তার কমজোরি
চারটে পুরুষ, শুধু পুরুষ ছিল বলে
দেওয়ালের পেছনে ওকে রেপ করল!!