গল্পেরা জোনাকি তে রীতা পাল (ছোট গল্প সিরিজ)

সেই রাত

কলকাতার চেম্বার সেরে উকিলবাবুর বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। সেদিন এক মক্কেলের সাথে আলোচনায় এতটাই ব্যস্ত হয়ে গেলেন যে লাস্ট ট্রেনের টাইম প্রায় ভুলতেই বসেছিলেন। অটো থেকে নেমে দৌঁড়ে কোনরকমে ট্রেনে উঠলেন। দেখলেন ভেন্ডারে উঠেছেন। একদম ফাঁকা। ছানার জলের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠলো। ট্রেনের গতি বাড়ায় নামার উপায় নেই। জানালার ধারে বসতে গিয়ে খেয়াল করলেন আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে একজন শুয়ে আছেন। এই গরমে কম্বল মুড়ি দেওয়া দেখে উকিলবাবুর অস্বস্তি বেড়ে গেল। গেটের সামনে এসে দাঁড়ালেন। পূর্ণিমার রাত, আকাশে পূর্ণশশী। ট্রেন পেরিয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা বৈশাখের মাঠ। পরের স্টেশন আসতেই তিনি নেমে জেনারেল কামরাতে উঠলেন। সেখানে কয়েকজন ঝিমোচ্ছে। তিনি একটা সিটে বসলেন। আগামী কালের মামলার রায় বেরানোর বিষয়ে চিন্তা করতে করতে পৌঁছে গেলেন তার গন্তব্য স্টেশনে। নামার সময় পেছনের সিটটায় চোখ পড়তেই চমকে উঠলেন! দেখলেন একটা লোক কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। চোখের সামনে দিয়ে ট্রেনটা হুইসেল বাজিয়ে বেরিয়ে গেল। তিনি চোখের ভুল ভেবে আস্তে আস্তে রিক্সা স্ট্যান্ডের দিকে এগোলেন। দেখলেন তাকে নিয়ে যাওয়ার সেই চেনা রিক্সাওয়ালাটা আজ আর নেই। স্টেশন থেকে তার বাড়ি প্রায় ১৫ মিনিটের হাঁটা পথ। মনে মনে ভাবলেন, রফিক তো কোনদিন না বলে কামাই করে না।কলকাতার চেম্বার থেকে না ফেরা পর্যন্ত সে অপেক্ষা করে। এর জন্য মাসকাবারি একটা টাকা পায় ঠিক কিন্তু আগে থেকে না বলে কোনদিন আসেনি এমন তো হয় নি।
শুনশান স্টেশন। চায়ের দোকান-টোকান সব বন্ধ। অগ্যতা হাঁটা শুরু করলেন। ঠিক তখনই এক রিকশাওয়ালা এসে উপস্থিত। উকিলবাবুর সামনের গাড়িটা ঘুরিয়ে দাঁড় করিয়ে বলল,“বাবু উঠুন।” উকিলবাবুর গলাটা অচেনা লাগলো। এখানে তাদের পূর্বপুরুষের ভিটে। মোটামুটি সবাইকে চেনেন। এ তল্লাটে রাতে রিকশাওয়ালাদেরও ভালো করে চেনেন। কিন্তু একে চেনা লাগলো না। মুখটা দেখার চেষ্টা করলেন অন্ধকারে কিচ্ছু দেখতে পেলেন না। যাইহোক হাঁটার চেয়ে তো ভালো। এই ভেবে জিজ্ঞাসা করলেন,“কত নেবে?”
“উঠুন না!”
“না না,আগে ঝামেলা ভালো পরে ভালো না।” “আপনার যা ইচ্ছা দেবেন।”
“আমি রফিককে যা দিই তোমাকেও তাই দেবো।”
“আচ্ছা,”
“বলতে পারো রফিক কোথায়? আজ সকালেও আমাকে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। তখনো কিছু বলেনি যে রাতে আসবে না নিতে। যাই হোক, চলো।”
রিক্সায় উঠে সেই একই চিন্তা মাথায় কিলবিল করে উঠলো। কিন্তু মাথার ওপরে পূর্ণিমার চাঁদ দেখে পুরনো আড্ডার কথা মনে পড়ে গেল। কতদিন পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা হয়নি। জীবনটা একেবারে যন্ত্রের মতন হয়ে গেছে। নাহ এবার কিছুদিন কোথাও গিয়ে ঘুরে আসতে হবে। বনানীও খুশি হবে। একটা ঠান্ডা হাওয়া যেন তাকে ছুঁয়ে গেল। অনেকদিন পর নাকে এলো স্বর্ণচাঁপার গন্ধ। চারিদিকটা গন্ধে ম ম করছে। ঠিক তখনই মনে হলো। আরে! ওকে তো আমার বাড়ির ঠিকানা বলা হয়নি। রাস্তার দিকে চেয়ে দেখলেন ঠিক রাস্তাতেই যাচ্ছে। উকিল বাবু ইচ্ছে করে আর কিছু বললেন না।
উকিলবাবুর বাড়ির পথে একটা পুরনো কবর খানা পরে। বাঁকটা পেরোতেই দেখলেন আধো অন্ধকারে কারা যেন একটা মৃতদেহ নিয়ে গোরস্হানের দিকে আসছে। পাস দিয়ে যাবার সময় লাসটার দিকে তাকিয়েই চোখ বন্ধ করে ফেললেন। দেহটা কম্বলে মোড়া। একেবারে হুবহু রেলের কামরায় দেখা আগন্তুক এর মত।
একটা জোরে ঝাঁকুনি হতেই তিনি রিক্সা দিয়ে পড়ে যেতে যেতে বেঁচে গেলেন। কিছু বলতে যাবেন, এমন সময় দেখলেন একটা কালো বিড়াল রাস্তা পেরোচ্ছে। তিনি কিছু না বলে পিছন দিকে তাকালেন,দেখলেন পাড়ার নেড়িটা চিৎকার করে রিক্সার পেছনে ছুটছে। হঠাৎ কুকুরটার কি হল কে জানে। সে প্রানপন পিছনের দিকে ছুট লাগাল। উনি সামনের দিকে তাকাতেই মনে হল রিক্সাওলা ঘাড়টা ঘুরিয়ে নিল। উনি চশমা খুলে ভালো করে মুছলেন। কি যে হচ্ছে আজ। বারবার মনে হচ্ছে উনি পেছনে ঘাড় ঘোরাতেই রিক্সাওলার ঘাড়টা একেবারে ঘুরে গেছিল। মনে মনে রফিক এর ওপর রাগ হচ্ছিল। নতুন বাহক যে ভাবে ব্রেকটা কষে ছিল। বেসামাল হলে কি কান্ডটাই না ঘটত। আবহাওয়াটা কেমন গুমোট হয়ে উঠছে। পূর্ণিমার চাঁদটা ধীরে ধীরে কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। অসাবধানে ব্রিফকেসটা পাদানিতে পড়ে গেল। ওটা নীচু হয়ে তুলতেই উকিল বাবুর চক্ষু চড়ক গাছ। বনবন করে পাডেল ঘুরছে,রিক্সা চালকের পা নেই।
উকিল বাবু থামো থামো বলতেই পুরো মুন্ডুটা সামনের দিকে ঘুরে গেল। উকিল বাবু চমকে উঠলেন! “কি রে রফিক! তোর গলাটা এমন লাগছে কেন? তোর পা কই?”রফিক,“লাশ কাটা ঘরে।”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।