ধারাবাহিক প্রবন্ধে তপশ্রী পাল (পর্ব – ৪৩)

আলাপ

কত্থক নৃত্যের পর আরেকটি অন্যতম বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলী ওড়িশি নাচের কথা বলবো। ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য, কলা, স্থাপত্য এবং বিভিন্ন কলা বিষয়ক ইতিহাসের বিখ্যাত পন্ডিত শ্রদ্ধেয়া কপিলা বাৎসায়নের মত অনুযায়ী ভারতের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন নৃত্যশৈলী হলো ওড়িশি। অন্যান্য শাস্ত্রীয় নৃত্যের মতোই ওড়িশি নৃত্যের উৎসও খুঁজে পাওয়া যায় কপিল মুনীর নাট্যশাস্ত্রে। নাট্যশাস্ত্রে চারটি বৃত্তি বা কলা সংক্রান্ত অভিব্যাক্তি প্রকাশ করার ধরণের কথা বলা হয়েছে, বিভিন্ন ভারতীয় ভৌগোলিক অঞ্চল অনুযায়ী। সেগুলি হলো অবন্তী, দাক্ষিণাত্য, পাঞ্চালী এবং অদ্র-মাগধী। এর মধ্যে অদ্র হলো উড়িষ্যা বা ওড়িশা অঞ্চল। প্রত্নতত্ত্ববিদরা ওড়িশার উদয়গিরিতে রানী গুম্ফা নামক পাহাড়ী গুহায় পাথর কেটে বানানো কিছু স্থাপত্য খুঁজে পান, যাতে সম্পূর্ণ বাদ্যসহযোগে নৃত্যরত মানব মূর্তি খোদিত ছিলো। সেই নৃত্যমুদ্রা ছিলো ওড়িশি নৃত্যের। এই গুহার মূর্তিগুলি খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের বলে মনে করা হয়।
এরপর উড়িষ্যার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক খননে বিভিন্ন গুহাতে, যেমন হাতিগুম্ফায় আরো মূর্তি পাওয়া যায়। সেখানে একটি শিলালিপিতে পাওয়া যায় যে তৎকালীন রাজা, গন্ধর্ববিদ্যায়(সঙ্গীতে) পারদর্শী ছিলেন এবং বিভিন্ন উৎসবে রাজধানীর মানুষের জন্য নৃত্য, গীত ও বাদ্যের আয়োজন করতেন। শিলালিপিটি খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতকের। ভুবনেশ্বর, পুরী ও কোণারকের মন্দিরগাত্রেও এই ধরণের মূর্তি খোদিত আছে। ওড়িশার সঙ্গীতের ইতিহাসও অতি প্রাচীন। আনুগুলের কাছে শকরগঞ্জে কুড়িটি চাবিযুক্ত একটি পালিশ করা ব্যাসাল্টের লিথোফোন জাতীয় বাদ্যযন্ত্র পাওয়া যায় যেটি খ্রীষ্টিয় প্রথম শতাব্দীর।
ওড়িশার হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলগুলিতে বিভিন্ন শিলালিপি, পাথরে খোদিত নর্তকমূর্তি এবং হারুকা, বজ্রবরাহী এবং মারিচী ইত্যাদি ওড়িশি মুদ্রায় নৃত্যরত দেবদেবী মূর্তি ইত্যাদি পাওয়া যায় যেগুলি খ্রীষ্টিয় ষষ্ঠ থেকে নবম শতকের। এই অঞ্চলগুলি হল উদয়গিরি, ললিতগিরি, রত্নগিরি ও আলতগিরি। ঐতিহাসিক অ্যালেকজান্ডার কার্টারের মতে খ্রীষ্টিয় নবম শতকে ওড়িশি মাহারি (মন্দির-নর্তক) এবং নাট-মন্দির দেখা যায় বিভিন্ন গুহা ও মন্দিরের গাত্রে। কপিলা বাৎসায়ন বলেছেন গুজরাটের জৈন কল্পসূত্রে বিভিন্ন শাস্ত্রীয় নৃত্যভঙ্গিমা দেখা যায় যেগুলি ওড়িশি নাচের সম্পদা, ত্রিভঙ্গী ও চৌকার মতো। এতে প্রমাণিত হয়, যে শুধু ওড়িশার মন্দিরে নয়, এই নৃত্য তখন বাইরেও সমান জনপ্রিয় ছিলো এবং সুদূর গুজরাটেও গিয়ে পৌঁছেছিলো। অভিনয়-চন্দ্রিকা ও অভিনয় দর্পণ ইত্যাদি হিন্দু গ্রন্থে ওড়িশি নৃত্যে হাত, পা ও দেহের বিভিন্ন ভঙ্গী কেমন হবে তা বিশদে বর্ণিত আছে।
দশম থেকে চতুর্দশ শতাব্দীতে তৈরী পুরীর জগন্নাথ মন্দির, ভুবনেশ্বরে লিঙ্গরাজ মন্দির ও কোণারকের সূর্যমন্দিরে ওড়িশি নাচের ভঙ্গীতে প্রচুর মূর্তি দেখা যায়। ওড়িশি নাচে মূলতঃ বৈষ্ণবীয় রীতির প্রভাব দেখা যায়। তবে শৈব এবং শাক্ত প্রভাবও চোখে পড়ে। জয়দেবের গীতগোবিন্দেও এই নাচের উল্লেখা আছে।
মন্দিরগুলিতে মাহারিরা এই নৃত্য প্রদর্শন করতেন ভগবানের উদ্দেশ্যে। এই মাহারিরা সাধারণতঃ নারী যাঁদের খুব ছোট বয়সেই পরিবার থেকে নিয়ে এসে তাঁদের মন্দিরেই পালন পোষণ ও নৃত্যশিক্ষা দেওয়া হতো, যাতে বড়ো হয়ে তাঁরা ভগবানের মূর্তির সামনে নৃত্য প্রদর্শন করতে পারেন। এঁদের দেবদাসীও বলা হত। এই দেবদাসীদের বিবাহ করার নিয়ম ছিলো না। বলা হতো যে তাঁরা ঈশ্বরের সঙ্গে বিবাহিত। কিন্তু ক্রমে দেবদাসীদের দিয়ে বেশ্যাবৃত্তি করানো শুরু হয় ও শেষ পর্যন্ত ইংরেজ আমলে দেবদাসী প্রথা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়। তখন পুরুষ নর্তকরাই মন্দিরে মাহারি নৃত্য করে দেবতার বন্দনা করতেন। এ ছাড়া এক ধরণের ওড়িশী নাচ দলগত ভাবে ছোট ছেলেরা মহিলা সেজে পরিবেশন করতেন, তাকে বলা হত গোটিপুয়া নৃত্য।
ভারতবর্ষে মুসলিম শাসণের সময় সুলতানী আমল থেকেই মুঘল আমল পর্যন্ত উড়িষ্যা বারবার আক্রমণের সম্মুখীন হয় এবং জগন্নাথ মন্দির, কোনারক মন্দির সহ বহু মন্দির লুঠ এবং ধ্বংস করা হয়। এর ফলস্বরূপ ওড়িশি নাচও তার গৌরব হারায় ও কালের কোলে বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ইংরেজ আমলেও এর বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। খ্রীষ্টান মিশনারিরা ছিলেন নৃত্য বিরোধী। তাই সব ধরণের ভারতীয় নৃত্যই প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। মন্দিরে নাচ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
স্বাধীনতার পর সরকারের উদ্যোগে আবার এই নৃত্যশৈলীগুলিকে নতুন করে তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং মন্দিরের পরিবর্তে বিভিন্ন মঞ্চে ও সমারোহে নৃত্য প্রদর্শন আবার নতুন করে শুরু হয়।
কত্থকের মতোই ওড়িশি নাচেও মূলতঃ কয়েকটি ভাগ – নৃত্ত, নৃত্য, নাট্যম ও মোক্ষ।
নৃত্ত – এই ভাগটিতে কোন গল্প বলা হয় না। কোন সঙ্গীতাংশ থাকে না। এখানে তালের সঙ্গে দ্রুত লয় ও ছন্দে, খোল ও পাখোয়াজের সঙ্গে নাচ প্রদর্শন করা হয়।
নৃত্য – এখানে লয় অপেক্ষাকৃত ধীর। নানা দেহভঙ্গী ও মুখভঙ্গীর মাধ্যমে কিছু বলা হয়। কোন হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অথবা দেবদেবীর বন্দনা সঙ্গীতের সঙ্গে পরিবেশিত হয়।
নাট্যম – দলগত ভাবে বা একক ভাবে একটি নাটক প্রদর্শন করা হয়। এক একটি চরিত্রের বৈশিষ্ট এক একটি দেহভঙ্গিমায় তুলে ধরা হয়। নাট্যমে সাধারণতঃ “নৃত্য” শৈলীই ব্যবহার করা হয়।
মোক্ষ – মোক্ষ এক বিশুদ্ধ ওড়িশি নাচ যেখানে নাচের মধ্য দিয়ে দেহাত্মার মুক্তি বা মোক্ষ দেখানো হয়।

ওড়িশি নাচে পরপর একটি ক্রম অনুযায়ী এই ভাগগুলি পরিবেশিত হয়।
প্রথমেই ‘মঙ্গলাচরণ’, যেখানে একটি শ্লোকের মাধ্যমে ভগবানের বন্দনা করে ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করে নাচ শুরু করা হয়। ওড়িশি নাচে সাধারণতঃ জগন্নাথ বিষ্ণুর বন্দনার মাধ্যমে নাচ শুরু হয়। “জগন্নাথস্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে” এই বন্দনা গানটি পিছনে গাওয়া হয়। মঙ্গলাচরণের পর জগন্নাথের মূর্তি, যেটি সাধারণতঃ সামনে রাখা হয়, তাতে ‘পুষ্পাঞ্জলী’ দেন নর্তক এবং সবশেষে ‘ভূমি প্রণাম’ অর্থাৎ সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করেন। এর সঙ্গে ত্রিখন্ডী প্রণামও করা হয় – প্রথমে দেব প্রণাম, তারপর গুরুপ্রণাম ও সবশেষে সম্মুখে উপস্থিত দর্শক বা রসিকদের প্রণাম করে মঙ্গলাচরণ শেষ করা হয়।
এরপর ‘বটুনৃত্য’ পরিবেশিত হয়। ‘বটুনৃত্য’ শিবকে উৎসর্গ করা হয়। বটুনৃত্য বা বটু নাচে কোন সঙ্গীতাংশ থাকে না। শুধু তবলা ও মৃদঙ্গের সঙ্গে বোল পাঠ ও সেই সঙ্গে দ্রুত নৃত্য প্রদর্শন করা হয়। বটু নৃত্যেরই পরবর্তী অংশ হলো ‘পল্লবী’, যেখানে চোখ, ঘাড়, দেহের মধ্যাংশ বা ধড় ও পায়ের অপেক্ষাকৃত ধীর সুললিত ভঙ্গী ও সাংগীতিক ছন্দে নাচ এগিয়ে চলে এবং ক্রমশঃ লয় বৃদ্ধি পেয়ে এক শিখরে পৌঁছয়!
এরপর আসে অভিনয় অংশ, যেখানে গান বা সঙ্গীতাংশের সঙ্গে বিভিন্ন হস্ত‘মুদ্রা’ ও ‘ভাব’ ব্যবহার করে একটি কাহিনী বলা হয়। এই সঙ্গীতাংশটি সাধারণতঃ সংস্কৃত বা ওড়িশি ভাষায় গাওয়া হয়। এর মধ্যে থাকে দশাবতার স্তোত্রম, অর্ধনারীশ্বর স্তোত্রম, নভরস স্তোত্রম ইত্যাদি। এ ছাড়া এই অংশে জয়দেবের গীতগোবিন্দের স্তোত্রগুলিও ব্যবহৃত হয়। অনেক সময়েই রাধা কৃষ্ণের প্রেম ও জীবনের নানা কাহিনী বর্ণিত হয় নাচের মাধ্যমে। এই অংশে নাচ হয় সংবেদনশীল, ভাবময়, অনায়াস!
সবশেষে মোক্ষ অংশে সঙ্গীত ও বাদ্য ও নৃত্য একসাথে ব্যবহার হয় এবং বিভিন্ন ভাব ভঙ্গী ও নৃত্যের মাধ্যমে মুক্তি, পরমার্থ বা মোক্ষের সন্ধান দেন নর্তক।
তিনটি প্রধাণ নৃত্য ভঙ্গিমা হলো –
সমভঙ্গ – চতুঃষ্কৌণিক দেহভঙ্গী। দেহের ওজন সমান ভাবে দুটি পায়ে বিভক্ত থাকে। মেরুদন্ড থাকে সোজা, হাতদুটি উর্ধে উত্থিত এবং কনুই বাঁকানো।
অভঙ্গ – পা গভীর ভাবে বাঁকানোর ফলে, দেহের ওজন এক পা থেকে অন্য পায়ে সরে যায় ক্রমাগতঃ। পায়ের পাতা ও হাঁটু বাইরের দিকে এবং পশ্চাদ্দেশ একদিকে বক্র অবস্থায় থাকে।
ত্রিভঙ্গ – দেহ ‘S’ অক্ষরের মতো তিনভাগে বাঁকানো থাকে। দেহের মধ্যাংশ একদিকে এবং মাথা ও পশ্চাদ্দেশ বীপরীত দিকে । হাত এবং পা এমন ভাবে বাঁকানো হয় যে তা দেহকে দুটি চতুষ্কোণের সমাহারে পরিণত করে। এটি খুবই শৈল্পিক এক ভঙ্গিমা। বিভিন্ন প্রাচীন মন্দির গাত্রের মূর্তিগুলিকে এই ভঙ্গিমায় দেখা যায় এবং এটি ওড়িশি নাচের একটি প্রধাণ বৈশিষ্ট।
ওড়িশি নাচের বিভিন্ন হস্তমুদ্রাগুলিকেও কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়।
অসংযুক্ত হস্ত (এক হাতের মুদ্রা) – মোট আঠাশটি মুদ্রা (অভিবাদন, প্রার্থনা, আলিঙ্গন, শক্তি, বন্ধন, দোলা, বহন, শঙ্খ, তীর, ধারণ, চক্র ইত্যাদি)
সংযুক্ত হস্ত (দুই হাত জোড় করে মুদ্রা) – চব্বিশটি (পতাকা, ফুল, পাখী বা পশু, চাঁদ, গ্রহণ করা ইত্যাদি)
নৃত্য হস্ত – আটটি বিশুদ্ধ নৃত্য মুদ্রা
ওড়িশি নাচে নারীরা সাধারণতঃ বর্ণাঢ্য পোশাক বা ওড়িশী সম্বলপুরী বা ইক্কত শাড়ি পরেন। শাড়ির সামনের একটি বড়ো কুঁচি অংশ থাকে যেটি পা ছড়ালে ময়ূরের পাখার মতো ছড়িয়ে যায়। সাধারণতঃ রূপোলী বা রূপোর গয়না ব্যবহার হয়। মাথায় থাকে একটি রূপোর চূড়া বা মুকুট, সিঁথি, কাপা বা কানের গয়না, হাতে বাজুবন্ধ, বাহিচুড়ি, গলায় সীতাহার ও কোমরে ভারী কোমরবন্ধ এবং পায়ে ঘুঙ্গুর। বড়ো করে কাজল পরে চোখের সাজ, কপালে টিপ ও তাকে ঘিরে চন্দন পরা হয়, ঠোঁটে রঙ ব্যবহৃত হয়। পুরুষের পোশাক ধুতি ও উত্তরীয়, যেটি কোমরবন্ধে আটকানো থাকে। পুরুষরাও গলায়, ঊর্ধবাহুতে ও কব্জিতে মোটা রূপোর খাড়ু জাতীয় গয়না ও কপালে চন্দনের তিলক পরেন।
ওড়িশী নাচের সঙ্গে সঙ্গীতাংশে উত্তরভারতীয় ও ওড়িশি শাস্ত্রীয় রাগ রাগিনী ব্যবহার হয়, যেমন কল্যান, বড়ারী, শ্রী গোড়া, কর্ণাটী, শোকবড়ারী, ধনাশ্রী, ভৈরবী ইত্যাদি। যন্ত্রের মধ্যে তবলা, মৃদঙ্গ ও বাঁশী অবশ্যই ব্যবহার হয়। এ ছাড়া হারমোনিয়াম, সেতার ইত্যাদিও ব্যবহার হয়।
মন্দিরে ওড়িশি নাচ করতেন মাহারি বা মহা নারীগণ বা দেবদাসীরা। ক্রমে দেবদাসীর সংখ্যা কমে এলে পুরুষেরাই মাহারি হতেন। এ ছাড়া বাচ্চা ছেলেদের গোটিপুয়া বানানো হতো। এরা মাহারিদের কাছেই নাচ শিখতেন এবং গোটিপুয়া নাচে পুরুষেরা মহিলার সাজে নৃত্য করতেন। গোটিপুয়া নৃত্যে অনেক সময়েই নানা ধরণের মার্শাল আর্ট, আথলেটিক্স ও আক্রোব্যাটিক্স ব্যবহার হতো বিশুদ্ধ নৃত্যের সঙ্গে।
এ ছাড়াও নর্তকীরা রাজার সভায় ওড়িশি নাচতেন। তবে ব্রিটিশ আমলে এই নাচ বন্ধ হয়ে যায়।
ভারতে অন্যতম জনপ্রিয় নৃত্য ওড়িশি এবং বহু নামকরা শিল্পী আছেন। আলাপের সীমিত পরিসরে সকলের কথা তুলে ধরা সম্ভব নয়। তাই বিখ্যাত গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র ও তাঁর বিখ্যাত দুই ছাত্রী সংযুক্তা পাণিগ্রাহী ও সোনাল মান সিং এর কথা তুলে ধরবো।
আমার, গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের নাচ দেখার সৌভাগ্য হয় কলকাতা দূরদর্শনে এবং তারপর ডোভার লেন মিউসিক ফেসটিভ্যালে। প্রথম দেখায় সত্যি অবিশ্বাস্য লাগে, যখন ধুতি পরিহিত, খালি গায়ে পৈতে জড়ানো শ্যামবর্ণ টাক মাথা এক বৃদ্ধ রাধা রূপে স্টেজে অবতীর্ণ হন! তারপর যত তাঁর নৃত্য অগ্রসর হয়, তত বিস্ময় বাধা মানে না! দেহের প্রতিটি সুললিত ভঙ্গীতে, চোখ ও ভ্রুর প্রতিটি ভাষায়, ঈষৎ লাস্যযুক্ত মৃদু হাসিতে এবং অপূর্ব হস্ত ও পদমুদ্রার সমাহারে তিনি যেন তখন মূর্তিমতী রাধা! তাঁর জাগতিক রূপকে সহজেই ভুলে যেতে হয়, তাঁর কলাময় নৃত্য দর্শনে!
এক বিখ্যাত সংস্কৃত কবি, গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র সম্বন্ধে বলেছিলেন “সাঙ্গ-পাঙ্গ-সুভঙ্গী-লাস্য-মধুরম-সমতীর্ণ-নৃত্যর্ণভম” অর্থাৎ তাঁর নৃত্যরত দেহের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, বিস্ময়কর নানা ভঙ্গিমার যাদুতে এক অসাধারণ মাধুর্য্য তৈরী করে! কিন্তু কী করে তিনি আয়ত্ত করলেন এমন মাধুর্য্যমন্ডিত নৃত্য? সে কথা জানতে গেলে ফিরে যেতে হয় তাঁর শৈশবে।
পুরীর কাছে রঘুরাজপুরে ১৯২৬ সালে কেলুচরণের জন্ম হয়। তাঁর পিতা চিন্তামণি মহাপাত্র ছিলেন পুরুষাণুক্রমে এক বিখ্যাত পটচিত্রশিল্পী পরিবারের বংশধর, যাঁরা কাপড়ের ওপর নানা পৌরাণিক ও ধর্মীয় ঘটনার চিত্র আঁকতেন, তারপর সেই চিত্রগুলি পরপর দেখিয়ে একটি গল্প বলে মানুষের মনোরঞ্জন করতেন। তাঁর পিতার খুব নাচ গানের শখ ছিল। বিভিন্ন মন্দিরে উৎসবের সময় তিনি ঢোল, মৃদঙ্গ বাজিয়ে নাচ করতেন এবং কেলুচরণ অবাক বিস্ময়ে শিশুকাল থেকে সেগুলি দেখতেন। তাঁদের গ্রামে মোহন মহারাণার একটি যাত্রাদল ও বলভদ্র সাহুর দুটি গোটিপুয়া নৃত্যদল ছিলো। তাঁদের নাচও কেলুচরণ সারা বছর দেখতেন। স্কুলে ভর্তি হলেও, এতো নৃত্যগীতের মাঝে তাঁর পড়ায় মন বসতো না। তিনি সারা বিকাল বলভদ্র সাহুর বাড়িতে গিয়ে গোটিপুয়া দলের নৃত্য, যেখানে ছেলেরা মেয়ে সেজে নেচে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গুণগান করেন, তা দেখতেন। তাঁর এই উৎসাহ দেখে বলভদ্র সাহু একদিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন যে তিনি নাচ শিখতে চান কি না। তিনি আনন্দে কেঁদে ফেলে রাজী হন। তাঁর মা জানতেন যে ছেলে নৃত্যপাগল এবং তাঁকে নাচ শেখার অনুমতি দেন। কিন্তু পিতা গোটিপুয়া নৃত্যের ঘোর বিপক্ষে ছিলেন। তাঁর ধারণা ছিলো যে এটি কোন বিশুদ্ধ নৃত্য নয়। তিনি নৃত্যগীত শিক্ষার বিপক্ষে ছিলেন না। তাঁর বড়ো দুই ছেলেকে মোহনসুন্দর দেবগোস্বামীর রাসলীলা দলে শিখতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু গোটিপুয়া নাচ তাঁর পছন্দ ছিলো না। বাবার আড়ালেই কেলুচরণ তিন বছর গোটিপুয়া নৃত্য শিক্ষা করতে লাগলেন। অবশেষে দেবীপূজার শুভদিনে বলভদ্র সাহু তাঁকে বললেন যে সেদিন তাঁর শিষ্য হিসাবে হবে কেলুচরণের আত্মপ্রকাশের দিন! স্টেজে নাচতে হবে তাঁকে! কিন্তু বাবাকে না জানিয়ে তো তা সম্ভব নয়! পিতা চিন্তামণি মহাপাত্র যখন শুনলেন তাঁর মতের বিরূদ্ধে এতো দীর্ঘদিন কেলুচরণ গোটিপুয়া শিখেছেন, তিনি প্রবল রেগে গিয়ে তাঁকে দুই দাদার সঙ্গে রাসলীলা শিখতে পাঠিয়ে দিলেন এবং দুই দাদাকে কিছুদিন পর বাড়িতে ডেকে নিলেন।
মোহনসুন্দর দেবগোস্বামীর দলে প্রথম দিন থেকেই তিনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন নৃত্য প্রদর্শন করে। বালক কৃষ্ণ, রাধা, ললিতা সব পার্ট তাঁকে দেওয়া হতে লাগলো। তিনি এই দলে বারো বছর ছিলেন। ক্রমে বড় হয়ে তিনি যুবক কৃষ্ণ সাজতে লাগলেন। তবে নৃত্য ছাড়াও তিনি এখানে নিজের উৎসাহে এবং ভালোবেসে তবলা ও পাখোয়াজ শিক্ষা করতে লাগলেন এবং দলের সঙ্গে বাজাতে লাগলেন। কিন্তু কোন নিয়মিত টাকা তিনি পেতেন না। শুধু যখন তাঁর বাবা দলের সঙ্গে দেখা করতেন তখন মোহন্সুন্দর দেবগোস্বামী কিছু টাকা তাঁর হাতে দিতেন। যখন কোথাও অনুষ্ঠান থাকতো না, কেলুচরণ গ্রামে ফিরে আসতেন। একবার এরকমই তিনি গ্রামে ফিরলেন, ধুতির খুঁটে কিছু বেঁধে নিয়ে। তাঁর বাবা দেখতে চাইলেন সেটি কী? দেখা গেলো কেলুচরণ একটি তাসের বান্ডিল নিয়ে ঘুরছেন! দেখে তাঁর ভাবলেন যে তিনি নিশ্চই জুয়া খেলতে শিখেছেন! তখন তিনি সেগুলি কেড়ে নিলেন এবং মারধোর করে তাঁকে বাড়ি থেকে বেরোতে বারণ করলেন! অত্যন্ত আহত হয়ে কেলুচরণ রাতের অন্ধকারে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন এবং তাঁর বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন আর ফেরেননি। তিনি মোহনসুন্দরের দলে ছেলের মতো দীর্ঘদিন ছিলেন। সেটি ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। নাচগানের পালা সেই সময় প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দলের ছেলেরা কর্মহীণ হয়ে বসেছিল। এমন সময় গ্রামে “কঙ্গন” বলে একটি সিনেমা আসে। সবাই সেটি দেখতে খুব আগ্রহী হয়, কিন্তু মোহনসুন্দর ছেলেদের সিনেমা দেখা একেবারে পছন্দ করতেন না। কেউ ভয়ে না গেলেও কেলুচরণ একাই গেলেন এবং রাত একটার সময় লুকিয়ে যখন ফিরছেন তখন মোহনসুন্দর তাঁকে দেখে ফেলেন। তিনি যখন শুনলেন কেলুচরণ কোথায় গেছিলেন তাঁকে যারপরনাই বকাঝকা করলেন। কিন্তু কেলুচরণের মনে হলো তিনি অন্যায় কিছু করেননি। পরের দিন গুরুর পায়ে প্রণাম করে তিনি দল ছেড়ে চলে গেলেন।
গ্রামে ফিরে তাঁর করার কিছুই ছিলো না। গোটিপুয়া নাচের তুলনায় তখন তিনি অনেক বড় হয়ে গেছেন এবং যাত্রাদলে পার্ট করতেও তাঁর ভাল লাগল না। অথচ তিনি পটচিত্র আঁকতেও শেখেননি, পড়াশুনাও নয়। সুতরাং গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য পানের বরজে কাজ শুরু করলেন। বহুদূর থেকে বালতিতে জল ভরে নিয়ে বরজে গিয়ে পান গাছে জল দিতেন, পানপাতা তুলতেন ও গোছা করতেন। দিনে আয় ছিলো পাঁচ আনা। এক বছর এই কাজ করলেন। কিন্তু নাচ ও বাজনায় তাঁর উৎসাহ গেল না। তিনি বিকালে বলভদ্র সাহুর বাড়ি গিয়ে গোটিপুয়া নাচ দেখতেন এবং গুরুর সঙ্গে কথা বলতেন।
এমন সময় একদিন শুনলেন কটকে এক জমিদার এক অষ্টপ্রহরীর আয়োজন করেছেন। এক মাস একদিন অষ্টপ্রহর পাখোয়াজ মৃদঙ্গ ও তবলার সঙ্গে ভগবানের নামগান হবে। তিনি সেখানে যোগ দেবেন স্থির করলেন। তাঁর বাজনার অসম্ভব নাম হল এবং অষ্টপ্রহরীর শেষে জমিদার তাঁকে প্রচুর পুরস্কারে ভূষিত করলেন। তাঁকে কালিচরণ প্রামাণিকের কাছে পাঠান হল। তিনি তখন ওড়িশা থিয়েটার চালাতেন। সেখানে তিনি ততক্ষণাৎ বাজিয়ে হিসাবে সুযোগ পেয়ে গেলেন। সেখানে নৃত্যগুরু ছিলেন দুর্লভ চন্দ্র সিং, যিনি বাজনাতেও ওস্তাদ ছিলেন। আর ছিলেন দুর্লভ রাউত, যিনি বাজনা বাজাতেন। এই দুজনের সাহচর্যে তিনি লয়কারীর জ্ঞান এবং সূক্ষ্মতা ও কারুকার্য শিখলেন।
একদিন কেলুচরণের প্রবল জ্বর ছিলো। তিনি অনুষ্ঠানের শেষ অবধি বাজাতে পারলেন না। তিনি শুয়েছিলেন, কিন্তু মনে করা হলো যে তিনি নিশ্চই নেশা করেছেন। তাঁকে বকাঝকা করা হলো এবং আবার সহ্য না হওয়ায় তিনি ওড়িশা থিয়েটার ছেড়ে সেদিনই চলে গেলেন। এরপর নিজের গ্রামে ও কটকে বিভিন্ন রাসলীলা দলের সঙ্গে তিনি অভিনয়, নৃত্য ও বাদ্য প্রদর্শন করতে লাগলেন, কিন্তু কোথাওই বেশীদিন স্থায়ী হতে পারছিলেন না। এই সময় অন্নপূর্ণা বি গ্রুপ বলে কটকে একটি নাচের দল তৈরী হয় এবং তিনি সহজেই সেখানে সুযোগ পান। ওড়িশী নাচে এবং শিক্ষায় অনেক বড় ভূমিকা পালনের জন্য তাঁর জন্ম এবং ক্রমে তিনি সেখানে এই নাচের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন। তিনি তাঁর নৃত্য-সঙ্গিনী লক্ষ্মীপ্রিয়াকে বিবাহ করলেন এবং তাঁদের দুই সন্তান হল, মেয়ে চিন্ময়ী এবং ছেলে রতিকান্ত। ছেলে রতিকান্তই কেলুচরণের নৃত্যের ঐতিহ্য পরবর্তীকালে বয়ে নিয়ে চলেছেন। ক্রমে বিভিন্ন মঞ্চে নৃত্য প্রদর্শণ শুরু করেন কেলুচরণ এবং তাঁর নৃত্য মুগ্ধ করে সবাইকে। তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশে বিদেশে নৃত্য পরিবেশনের জন্য ডাক পড়তে থাকে তাঁর। তবে নৃত্য পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে নৃত্য শিক্ষাদানেই বেশী মনোনিবেশ করেন গুরু কেলুচরণ। তিনি শিক্ষক হিসাবেও ছিলেন অসাধারণ! ক্রমে নৃত্যশিক্ষার জন্য তিনি তাঁর গৃহে ‘সৃজন’ বলে একটি শিক্ষালয় খোলেন। গুরু শিষ্যপরম্পরায় বেশীরভাগ ছাত্রছাত্রী তাঁর গৃহেই থাকতেন। আবার কেউ কেউ দূর থেকে শিক্ষালাভের জন্য আসতেন। গুরু হিসাবে তিনি খুব কড়া এবং অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ ছিলেন। তিনি ছাত্রদের বলতেন একটি নাচ শিখে অন্ততঃ এক বছর সেটি চর্চা করতে এবং তা পুরোপুরি আত্মীকরণ করে তবেই নতুন কিছু শিখতে। ছাত্রদের একটি নাচের পদচারণ বা মুদ্রা শিখিয়ে তিনি তাঁদের তা অনুশীলন করতে বলে কোন গৃহকাজে যেতেন এবং বলে যেতেন যে যতক্ষণ তা আয়ত্ব না হচ্ছে ততক্ষণ তাঁরা খেতে পাবেন না এবং গুরুও খাবেন না। তাঁর স্ত্রী ছাত্রদের খাওয়া থাকার দিকে পুরোপুরি নজর দিতেন। কেলুচরণ সকালে শেখাতে শুরু করে বেলা দুটো পর্যন্ত শেখাতেন আবার বেলা পাঁচটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত শেখাতেন। তখন তাঁর স্ত্রী বেরিয়ে বলতেন যে সব ছাত্রছাত্রী দূর থেকে এসেছেন তাঁদের ছেড়ে দিতে। যারা তাঁর কাছেই থাকতেন তাঁদের মধ্যরাত পর্যন্ত শেখাতেন। যারা চলে যেতেন তাঁদের পরদিন ভোরে এসে যেটুকু তাঁরা শিখতে পারেননি সেটি তুলে নিতে হতো! এই ভাবে কঠিন অনুশীলনের মধ্য দিয়ে তৈরী হতো এক একটি নাচ!
তাঁর ঐতিহ্য ও নাচ আরো বিখ্যাত হয় এবং তাঁর নাম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর বিখ্যাত ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমে! তাঁদের মধ্যে আছেন সংযুক্তা পাণিগ্রাহী, কুমকুম, প্রতিমা বেদী, সোনাল মান সিং, মাধবী মুদ্গল, অলকা কানুনগো, ইলিয়ানা সিতারিস্তি। এঁরা প্রত্যেকেই পৃথিবীবিখ্যাত নৃত্যশিল্পী! গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র পদ্মভূষণ সহ আরো বহু পুরস্কারে ভূষিত হন।
গুরু কেলুচরণের ছাত্রীদের মধ্যে স্বল্প পরিসরে বলবো শুধু সংযুক্তা পাণিগ্রাহী ও সোনাল মান সিং এর কথা। সংযুক্তা পাণিগ্রাহী গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের একেবারে প্রথম ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একজন। তাঁর স্বামী রঘুনাথ পাণিগ্রাহী ছিলেন বিখ্যাত ওড়িশী গায়ক। তাঁরা দুজনে গুরু কেলুচরণের ওড়িশী নৃত্যশৈলী এবং নাচ প্রথম দূরদর্শণ এবং বিভিন্ন ডান্স ফেসটিভ্যালগুলির মাধ্যমে বিখ্যাত করেন। তাই তাঁর কথা বলতেই হয়। সোনাল মান সিং-এর কথা তুলে ধরব তাঁর নাচের বৈচিত্রের জন্য। তিনি ওড়িশী এবং ভারতনাট্যম দুই ধরণের নাচ পরপর এবং কখনো বা একসঙ্গে করতেন। নৃত্য নিয়ে নানা গবেষণাধর্মী কাজ, নানা নূতনত্ব নিয়ে আসা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তাঁর
কথা উল্লেখ করতেই হবে।

১৯৪৪ সালে উড়িষ্যার গঞ্জাম জেলার বেরহামপুরে সংযুক্তা পাণিগ্রাহীর জন্ম হয়। খুব ছোটবেলা থেকেই তাঁর চলাফেরার মধ্যে একটি ছন্দ ছিলো। সাধারণ বাড়িতে রান্নার কাঠ কাটার শব্দ কিংবা তরকারী নাড়ার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে নেচে উঠতো ছোট্ট সংযুক্তা। তাঁর মায়ের পরিবারে ছৌ নাচের চর্চা ছিলো। তিনি সহজেই মেয়ের প্রতিভা বুঝতে পারেন এবং তাঁকে নাচ শেখাতে আগ্রহী হন। কিন্তু তাঁর বাবা আপত্তি করেন, কারণ সেই সময় মন্দিরের বাইরে সাধারণ রঙ্গালয়ে বা মঞ্চে মেয়েরা নাচতো না। মন্দিরে এই নাচ করতেন মাহারী নামে মহিলারা যারা দেবদাসী বলে কথিত ছিলেন অথবা গোটিপুয়ারা যেখানে ছেলেরা দলবদ্ধভাবে মেয়ে হিসাবে নাচতেন। দেবদাসী প্রথা বিলোপের পর মাহারী নৃত্যও ছেলেরা করতেন। কিন্তু সংযুক্তার প্রবল আগ্রহ দেখে শেষ পর্যন্ত তাঁকে কেলুচরণ মহাপাত্রের কাছে শিক্ষালাভের জন্য নিয়ে যান তাঁর মা। সেখানে গুরুজী সহজেই তাঁর প্রতিভা বুঝতে পারেন এবং তাঁকে সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রী হিসাবে তাঁর সবকিছু উজাড় করে দেন। পরপর তিন বছর শিশুশিল্পী হিসাবে ‘বিষুব মিলন’ নৃত্য সমারোহে শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পীর পুরস্কার পান সংযুক্তা। নৃত্য পরিবেশন করতে করতে তিনি এমন মেতে যেতেন যে নাচ থামাতেই ভুলে যেতেন। তাঁর মাকে তাঁকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে স্টেজ থেকে নামাতে হতো। মাত্র নয় বছর বয়সে কলকাতায় সি এল টি তে তিনি শিশুশিল্পী হিসাবে অসাধারণ নৃত্য পরিবেশন করেন। ১৯৫২ সালে শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে নাচের জন্য শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পীর পুরস্কার পান। খুব ছোট বয়সে দীর্ঘদিন শিক্ষায় ওড়িশী নাচ সম্পূর্ণ আয়ত্ত করে তিনি মায়ের উৎসাহে রুক্মিনী দেবী অরুন্ডেলের কাছে কলাক্ষেত্রে ভারতনাট্যম শিক্ষা করতে যান। সেখানে ছয় বছরে ভারতনাট্যম এবং কথাকলিতে তিনি ‘নৃত্যপ্রবীণ’ ডিপ্লোমা শেষ করেন। এরপর কলাক্ষেত্র দলের সঙ্গে দেশে বিদেশে নৃত্য প্রদর্শন করেন। কলাক্ষেত্রেই তাঁর ভবিষ্যত স্বামী অসাধারণ পদগায়ক রঘুনাথ পাণিগ্রাহীর সঙ্গে তাঁর পরিচয়, প্রেম ও বিবাহ। এরপর তিনি উড়িষ্যার ফিরে এলে উড়িষ্যা সরকার তাঁকে একটি স্কলারশিপ দেন কত্থক শেখার জন্য, কারণ উড়িষ্যায় তখন কত্থক নাচ একেবারে প্রচলিত ছিল না। গুরু হাজারিলালের কাছে ভারতীয় কলাভবন বম্বেতে শিখতে শুরু করেন সংযুক্তা। কিন্তু মাঝপথেই সেই শিক্ষা অসম্পূর্ণ রেখে তিনি ফিরে আসেন।
তাঁর মনে হয় যে ওড়িশী নাচেই তাঁর আরো মন দেওয়া উচিত। তিনি আবার গুরু কেলুচরণের পায়ে আত্মসমর্পণ করেন। এই সময় গুরুজী সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমী পুরস্কার পান এবং সেই উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ওড়িশী নৃত্য প্রদর্শন করেন সংযুক্তা! তাঁর নাচ দেখে সমবেত শ্রোতারা বিস্ময়মুগ্ধ হয়ে যান। এরপর তিনি সর্বভারতীয় স্তরে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে নৃত্য প্রদর্শন করতে লাগলেন। তিনি গুরু কেলুচরণের স্টাইল এমনভাবে আয়ত্ত করেছিলেন যে দুজনের নাচ আলাদা করা যেতো না। সংযুক্তাই গুরু কেলুচরণের শ্রেষ্ঠ ছাত্রী হিসাবে পরিগণিত হন।
তাঁর নাচের সর্বশ্রেষ্ঠ অংশ ছিল নৃত্ত অংশ অর্থাৎ বিশুদ্ধ নাচ যেখানে পাখোয়াজের বোলের সঙ্গে মুখ ও গ্রীবা ভঙ্গিমা এবং হস্তপদ মুদ্রার সাহায্যে নাচ ফুটিয়ে তোলা হবে। রিদম বা লয় ও ছন্দই এই অংশে প্রধাণ! তুলনামূলক ‘নৃত্য’ অংশে তাঁর অভিনয় অনেক সময় ছিলো অতিনাটকীয় বা খানিকটা যাত্রার মত। তাঁর আর একটি বড় সুবিধা ছিল তাঁর স্বামীর অসাধারণ গায়কী, যা তাঁর নাচকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেত। দুজনে যুগ্মভাবে ওড়িশী নাচ, যা মন্দির নৃত্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছিল তা ভারতবর্ষের শাস্ত্রীয় নৃত্যে প্রধাণ স্থান লাভ করে ও অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। তাঁরা জয়দেবের গীতগোবিন্দের পদগুলি, সুরদাসের পদাবলী, তুলসীদাসের রামচরিতমানসের চৌপাই, বিদ্যাপতি ও রবীন্দ্রনাথের গান সবই ওড়িশী নৃত্যশৈলীর সঙ্গে পরিবেশন করেন, যার ফলে ভারতের সমস্ত রাজ্যেই এই নাচ গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। তাঁরা যুগ্ম-দন্ড বলে একটি নাচও করতেন, যেটি নৃত্যাঙ্গনা এবং গায়কের মধ্যে বাগেশ্রী রাগে এক ধরণের যুগলবন্দী, যেটি পন্ডিত রঘুনাথ পাণিগ্রাহী রচনা করেছিলেন। সবশেষে তাঁরা ‘মোক্ষমঙ্গলম’ পরিবেশন করতেন যা নৃত্যকে এক স্বর্গীয় সুষমামন্ডিত করতো। এটিই তাঁর নাচের একটি বৈশিষ্টে পরিণত হয়। তিনি সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমী পুরস্কার থেকে শুরু করে আরো বহু পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁর মৃত্যুর পর রঘুনাথ পাণিগ্রাহী তাঁর নামে একটি ট্রাস্ট তৈরী করেন এবং প্রতি বছর ওড়িশী নাচে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য এই ট্রাস্ট তাঁর নামে একটি পুরস্কার প্রদান করে।
সংযুক্তা পাণিগ্রাহী বলেছিলেন রুক্মিনী দেবী তাঁকে নাচের কৃতকৌশলে জোর দিতে বলতেন আর গুরু কেলুচরণ এ সব ভুলে শুধু বিশুদ্ধ নৃত্য এবং ভাবে ডুবে যেতে বলতেন। তিনি এই বিপরীতধর্মী উপদেশে দ্বিধায় পড়ে যেতেন। কিন্তু অনেক পরে তিনি বুঝতে পারেন যে বিশুদ্ধ নৃত্যে ও ভাবে নিজেকে সমর্পণ করলে কৌশল এবং শৈলী আপনিই আয়ত্ব হয়।
এবার বলি সোনাল মানসিং এর কথা। সম্ভবতঃ সেটি ছিল ১৯৯৮ সাল। সেবার মধ্যপ্রদেশে বিখ্যাত খাজুরাহো ডান্স ফেস্টিভ্যাল দেখার সৌভাগ্য হয় আমার। সারাদিন খাজুরাহোর বিখ্যাত প্রাচীন কারুকার্য সম্বলিত অসাধারণ মন্দিরগুলি দর্শন এবং সন্ধ্যায় মন্দিরকে পিছনে রেখে ঠিক মন্দিরের সামনে তৈরী মঞ্চে সারা ভারতের বিখ্যাত শাস্ত্রীয় নর্তক নর্তকীদের নৃত্য দেখা। সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। তার আগে দূরদর্শনে দেখলেও সেইবারই প্রথমে সচক্ষে দেখি সোনাল মানসিং এর নাচ! সর্বপ্রথমেই নজর কাড়ে তাঁর মঞ্চ-উপস্থিতি! অত্যন্ত শোভাময় হলুদ-গোলাপী সম্বলপুরী সিল্ক শাড়ি পরিহিতা দীর্ঘাঙ্গী নৃত্যাঙ্গনা সোনাল মানসিং-এর মঙ্গলাচরণের সঙ্গে মঞ্চপ্রবেশ ছিল দেখার মত। তাঁর নৃত্যে মুখ ও বিশাল দীঘল দুই চোখের কাজ, গ্রীবা ভঙ্গিমা সর্বাপেক্ষা দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নৃত্য অংশে পায়ের কাজ, নানা মন্দির ভাস্কর্যের যক্ষিনীদের মতো বিভঙ্গে স্থির হয়ে দাঁড়ানো যেন কোন সুদূর ইতিহাসের পাতায় নিয়ে যাচ্ছিল! অভিনয় অংশে ‘দশাবতার’-এ বিভিন্ন অবতারের রূপ প্রকাশে তাঁর মুখভঙ্গী গায়ের রোম খাড়া করে দেওয়ার মত! পিছনের বিমূর্ত আলো যেন আরো স্বর্গীয় করে তুলছিল সেই নাচ! খোল ও পাখোয়াজের সঙ্গে মৃদঙ্গ ও ঘটমের ব্যবহারে, ভারতনাট্যমের সঙ্গে ওড়িশী হস্তমুদ্রার মিলনে এবং পদসঞ্চারেও দুইধরণের নাচের ঝলক এনে নাচকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন।

১৯৪৪ সালেই সোনাল মানসিং এর জন্ম হয় মুম্বইতে। ছোটবেলায় তিনি মণিপুরী নৃত্য শিখতেন এবং পরে সাত বছর বয়সে ভারতনাট্যম শিখতে শুরু করেন পান্ডুনাল্লুর স্কুলের বিভিন্ন গুরু, যেমন কুমার জয়াকরের কাছে। তিনি ভারতীয় বিদ্যাভবন থেকে সংস্কৃতে “প্রবীণ” ও “কোবিদ” ডিগ্রি পান। এ ছাড়া জার্মান ভাষায় বি এ ডিগ্রি পান মুম্বইয়ের এনফিনস্টোন কলেজ থেকে। এরপর আঠেরো বছর বয়সে তিনি ব্যাঙ্গালোর গিয়ে ভারতনাট্যম শিক্ষা শুরু করেন ইউ এস কৃষ্ণরাও ও চন্দ্রভাগা দেবীর কাছে এবং অভিনয় শিক্ষা মায়লাপুরের গৌরী আম্মার কাছে। ১৯৬৫ সালে তিনি কেলুচরণ মহাপাত্রের কাছে ওড়িশী শিক্ষা শুরু করেন। ডিপ্লোম্যাট ললিত মানসিং এর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। তাঁর শ্বশুর মায়াধর মানসিংই গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেয়।
১৯৬২ সালে মুম্বইতে তাঁর আরঙ্গেত্রম অর্থাৎ স্টেজে জনসমক্ষে ন্রিত্যপ্রদর্শণ শুরু হয়। প্রায় দুই দশক দেশে ও বিদেশে বহু মঞ্চে নৃত্য পরিবেশন করে তিনি ১৯৭৭ সালে সেন্টার ফর ইন্ডিয়ান ক্লাসিকাল ডান্স তৈরী করেন দিল্লীতে।
সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমী ছাড়াও তিনি পদ্মবিভূষণ পুরস্কার পান। বালাসরস্বতীর পর তিনিই দ্বিতীয় মহিলা নৃত্যাঙ্গনা হিসাবে এই পুরস্কার পান। এ ছাড়া মধ্যপ্রদেশ সরকারের কালিদাস সম্মান ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডকটরেট পান সোনাল মানসিং। তাঁর জীবন ও নাচ নিয়ে ২০০২ সালে প্রকাশ ঝা একটি ডকুমেন্টারি তৈরী করেন, যেটি জাতীয় পুরস্কার পায়।
তাঁর জীবনী “এ লাইফ লাইক নো আদার” এর জীবনীকার তাঁর মনের অসীম শক্তির কথা বলতে গিয়ে একটি ঘটনা বা দুর্ঘটনার কথা বলেছেন। ১৯৭৪ সালে সোনাল মানসিং একটি জীবনহরণকারী মোটর দুর্ঘটনায় নিজের মেরুদন্ড এবং দুটি পা হারাতে বসেছিলেন! বেশ কয়েকটি মেজর অপারেশনের পর তিনি বেশ কিছুদিন কোমর থেকে পঙ্গু হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে যান। অসম্ভব যন্ত্রনা তাঁকে তত কষ্ট দিচ্ছিল না, যত কষ্ট তিনি পান যখন তিনি একজন ডাক্তারের গলা শোনেন, যে অন্তত কয়েক মাসের ফিজিওথেরাপিতে তিনি হয়তো দাঁড়াতে পারবেন, কিন্তু নাচে এ জীবনে আর ফেরা সম্ভব হবে না। তিনি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না! তাঁর সারাজীবনের স্টেজ পরিবেশনের নানা অপূর্ব ছবি তাঁর চোখে ভেসে উঠতে লাগল! মনে হল এগুলো বুঝি শুধুই স্বপ্ন ছিল! ভারতের নানা প্রান্ত থেকে চিঠি আসতে শুরু করে যারা তাঁর নাচকে বিদায় জানিয়ে তাঁকে নানা ভাষায় সান্ত্বনা দিতে শুরু করে। এমন সময় তিনি তৎকালীন প্রধাণমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চিঠি পান, যাতে তিনি লিখেছেন “কিপ ইয়োর মর‍্যাল অ্যান্ড হেড হাই!” তিনি মনে এক অসম্ভব জোর পান। এমন সময় আর এক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পিয়ারে, তাঁর এক্স-রে গুলি পরীক্ষা করে খুব গম্ভীর মুখে বলে ওঠেন “আই অ্যাম অ্যাফ্রেড…” তিনি যখন সর্বাপেক্ষা বেদনাদায়ক সংবাদ শোনার জন্য প্রস্তুত, তখন তিনি বলে ওঠেন “…দ্যাট ইউ উড বি এবল টু ডান্স এগেন!” তাঁর চোখ মূহূর্তে জলে ভরে ওঠে! ডাক্তার বলেন যে অত্যন্ত কঠিন যোগা এবং ফিজিওথেরাপি রুটিন তাঁর কথামত একেবারে নিয়মমত করলে তবেই তা সম্ভব! সোনাল বলেন যে ডাক্তার যদি বলেন তিনি সারাদিন মাথা নীচে পা ওপরে করেও থাকতে পারেন! এমনই অদম্য আগ্রহ ছিল তাঁর নাচে ফেরার! এই সব গুণের জন্যই এঁরা বিশ্ববিখ্যাত হন!
পরের দিন আসব আরেকটি বিখ্যাত নৃত্যশৈলী ভারতনাট্যমের কথা নিয়ে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।