ধীরে ধীরে যখন চোখ মেলে চাইলুম, তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে নদীর বুকে চাপ বাঁধা অন্ধকার বাসা বেঁধেছে। গভীর নিস্তব্ধতার সাথে আঁধার মিশেছে। নদীর পাশের রাস্তা জনমানবহীন। ক্রমে স্মৃতিরা এসে বাসা বাঁধছে।
মনে পড়ে গেলো, গেলোবার অনেকটা এরকম ঘটনাই প্রত্যক্ষ করেছিলাম। সেবার ছিলো এক আশ্চর্য জ্যোতির্বলয় ঘিরে বাউলানির নগ্ন শরীর। আর সেই শরীর ভূমিস্থিত হয়ে পরিণতি পেয়েছিলো আশ্চর্য পদ্মফুলের সমাহারে। তাহলে কি আমার মনের গহনে পাপ লুকিয়ে আছে? কৃষ্ণভামার শরীর ভোগের তীব্র আকাঙ্খাই কি বারবার আমায় মোহাবিষ্ট করে চলেছে? নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিচ্ছি, তীব্র পাপবোধ ঘিরে ধরছে আমাকে। ছিঃ, ওরা যদি ঘুণাক্ষরেও আমার এই…
–” একটা কতা কইবো ঠাকুর? ”
আমি নীরবে চাইলাম নদীর দিকে।
— ” তুমি কি নিজেকে মানুষের উধ্যে কিচু মনে করো? ”
খুব অস্ফুটে জিজ্ঞাসা করলাম –” কেন? ”
— ” তোমার মুকে একটা অনুশোচনার কালো ছায়া ছইড়ে আচে কেনে? তোমার কি অপরাদ হয়েচে বলো দিকিনি? জানিনা তুমি কী দেকেচো, তবে আমি যা ভেবেচি যদি সেটাই সত্যি হয়, তাহলে তো তুমি গিয়ে কারো শরীরে আচ্ছয় নিতে যাও নি কো, সেই না বরং তোমাকে.. ”
নদী ভেবেছে! যদি সত্যি সেটাই হয়, তাহলে কি মারাত্মকভাবে মিলে যায় এদের ভাবনা! তাহলে যে একটু আগেই ও বলেছিলো যে, সে সত্যিই কিছু জানেনা ? ওর মনে হয়েছিলো যেন আমি ভাবসমাধিতে বসেছি ! সে কথা কি তাহলে শুধু…
–” তোমাকে কীভাবে বিশ্বাস করাবো বলো দেকি ঠাকুর যে আমি সত্যিই কিছু দেকিনি। আমি শুদু ভেবেচি গো, এ মুহূত্তে কী হতে পারে। তোমার মুকে অনুশোচনার ছায়া দেকলুম কেনে। আমি যা বললুম, সে সবই আমার দারণা গো ঠাকুর। “
এবার কেন জানি আমার প্রচন্ড হাসি পেলো। কেন জানি না হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলাম আমি, সে হাসির দমকে বাতাস বন্ধ হয়ে গেলো, গাছের পাতারা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। নদীর চলা বন্ধ হলো। আর গাছের ঘন ডালপাতার ভেতর থেকে এক বিশালাকার পাখি ডানা ঝটপট করে উড়ে গেলো।
কারো একটা ভীত গলার স্বর ভেসে এলো। বুঝলুম সে স্বর নদীর, আমার হাসির দমক ওকে অনেক দূরে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে।
–” আমার কি কিচু অন্যায় হলো গো ঠাকুর? আমি কি ভুল কিচু বলে ফেললাম? ”
সত্যি বলতে কি, আমি নিজেই হঠাৎ করে এমনভাবে হেসে ওঠায় চমকে গেছি। কেন হাসলাম সে কথা তোলপাড় তুলছে মনের ভেতর।
–” কী জানি, এ আমি কোন জগতে এসে পড়েছি, সেটাই তো বুঝে উঠতে পারছি না গো, এখানে হাওয়া কথা কয়, নদী মনস্তাত্ত্বিক কথা বলে, জাগরণের মধ্যে স্বপ্নের মায়াবী জাল বিছানো থাকে ! ভাববাদী জগত বলে একটা জগত আছে শুনেছি, কিন্তু সে জগত যে এতোটাই মায়াবী সেটা যে আমার ধারণাতেও ছিলো না গো। আমি বুঝবোই বা কীভাবে যে কোনটা তোমার ধারণা আর কোনটা তোমার দর্শনের ফল? “
উচ্ছল নদীর যে চপলতা আমি দেখেছি, সেটা নিমেষে অন্তর্হিত হলো। দশমীর চাঁদ উঠেছে আকাশে। গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে সে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে নদীর বুকে নাইতে। কিন্তু…
–” তুমি নিজেকেই নিজে চেনোনি একনও, যদি চিনতে তালে পরে এই ভাবের মুলুকে দ্বিতীয়বার পা রাকতে না গো ঠাকুর। আসলে তুমি যেগুলো দেকছো বলে মনে করচো, যেগুলো শুনচো বলে ভাবচো, সে সবই তোমার আপন অন্তরের ভাবের ঘরের ছায়া গো, সবকিচুই মায়ার পতিফলন। কিন্তুক তাই বলে আমার সইয়ের বালোবাসায় কোনো ছল নেই গো, যেমন কপটতা নেই তোমার বালোবাসায়। ”
তাহলে যে কথাগুলো নদীর মুখে শুনছি সে আদপেই নদীর কথা নয়? আমারই অন্তরের ভাব আমায় সে কথাদের নদীর মুখে বসিয়ে শোনাচ্ছে? তাহলে এই যে চেতাবনি এইমাত্র সে আমায় শোনালো, এও…
আমি তখন আর সত্যিই আমার মধ্যে নেই। নিজেকে বস্তুবাদী বলে যে ভয়ংকর গর্ব ছিলো আমার সে অহংকারের তাহলে কোনোরকম বাস্তবতা নেই ? কিন্তু চূড়ান্ত ভাববাদী চেতনার মধ্যেও আমি এনাদের মধ্যে যে প্রকৃত বস্তুবাদের প্রকাশ দেখেছি, সেসবও কি তাহলে ভাবেরই বস্তুগত ছায়ার প্রতিফলন?
–” তোমার মনে যে কতাগুলোর দোলা দুলচে, সেটাই পকিত যুক্তি গো ঠাকুর। আমরা আমাদের নিজেদের মতের অবস্তানকে নিজেদের সুবিদেমতো ভেবে নি। ভাবের গোড়ায় বস্তুর জলসিঞ্চনেই দুনিয়া রূপ পায়। ”
আমি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। শরীরটা যেন খানিক দুর্বল লাগছে। এতোক্ষণে মনে হলো বেশ শীতল হাওয়া বইছে। কানাইদারা গেছেন সে অনেকক্ষণ হলো।
–” একটা শেষ কতা কইবো ঠাকুর? কারণ এরপর আর কোনোদিনও আমাদের কতা হপে না। তুমি আমার সইয়ের নাগর, সে অত্থে আমারও.. ”
–” তোমারও কী নদী! তোমারও… ”
–” আমারও সাতজন্মের সকা গো। যাই হোক গে, তুমি একন এসো, সে পোড়াকপালি তোমার পত চেয়ে ঠাঁয় দাঁইড়ে আচে গো। তবে একটাই কতা, তুমি যেন পতমে তার সাতে কোনো কতা বলো না। মানিনীর মান বাঙাতে যেও না, তোমার সইয়ের এ কতাটুকু রেকো গো ঠাকুর। ”
তারপর কী জানি কী হলো, একটা প্রচন্ড কলোচ্ছ্বাসের শব্দ। হঠাৎ করে হাওয়া তীব্র হলো, আর মনে হলো একটা নূপুরধ্বনি তীব্র বেগে ছুটে চলে গেলো দূরে… বহুদূরে।
আমি কানাই বাউলের আখড়ার দিকে চলা শুরু করলাম। দূরে গাঁয়ের ভেতর থেকে অস্পষ্ট উচ্চারণে গান ভেসে এলো —
—” এই তো ভাবের খেলা
সাগরে মিশিলে নদীর মরণ নাহি হয়,
সেই সাগর থিক্যাই হয় রে বন্ধু ম্যাঘেরই উদয়
মন রে তুই মুখ্যু বড়, তুয়ার বিচার ক্যামনতর,
সেই ম্যাঘ থিক্যাই বৃষ্টি ঝরে, পাহাড় তারে বুকে ধরে,
সেই জলেরই ঝর্ণা আবার নদী হইয়া বয়,
চোক্ষে যারে মরণ ভাবি, সে তো মরণ লয়
পিত্তিমে ডুবাইলে শূন্য হয় কি দ্যাবালয় ! “
গানটা আমার প্রিয় গান। কিন্তু গানটা যেন নতুনভাবে ধরা দিলো আমার কাছে। তাহলে কি সত্যিই ভাববাদ, বস্তুবাদ এসব কিছুই নেই ! প্রতিমার ভাসান দিয়ে দিলেও মন্দির শূন্য হয়ে যায় না, সেখানে তখনও ঈশ্বর বিরাজ করেন, সেটা দেবালয়ই থাকে গোয়ালঘর হয়ে যায় না।