গল্পেরা জোনাকি তে ধ্রুবজ্যোতি মিশ্র

অপরাজেয়
দৃশ্য ১
রাহুলের হাতে ক্যামেরার ফোকাসটা স্থির করে ধরা
চৈত্রের পড়ন্ত বিকেলে শহরের ব্যস্ত কালো রাস্তার উপর দিয়ে একটি মেয়ে ছুটছে ছুটছে আজ অনেকদিন পর তার মুখে হাসির রেখা….. এক হাতে খাবারের প্যাকেট অন্য হাতে একটা নতুন জামা। পিছনে একটি ট্রাম আসছে খটাং খটাং আওয়াজ করে।
পরিচালক ভৌমিক বাবু হঠাৎই কাট কাট বলে চিৎকার করে ওঠে। রাহুল মুখ সরিয়ে নেয় ক্যামেরার লেন্স থেকে।
আশেপাশে লোকে লোকারণ্য, বস্তির মানুষেরা অবাক নয়নে চেয়ে দেখছে শুট্যিং,কত বড় বড় গাড়ি,কত আলো, ছোট্ট রাখি পথের মাঝেই বসে হাঁপাতে থাকে আর অস্ফুট স্বরে বলে কি হলো এবারো হলোনা?
ভৌমিক বাবু এগিয়ে যায় গুটিগুটি পায়ে হাতে জলের বোতল, সাথে গ্লুকোজের প্যাকেট, বসে পড়ে রাখির পাশে জলের বোতলটা এগিয়ে দেয় রাখির দিকে , জলটা পেয়েই হাসি মুখে রাখি তৃষ্ণার্ত পথিকের মত ঢকঢক করে জল খায়,কিছুটা চোখে মুখেও দেয়। ভৌমিক বাবু এবার রাখি কে বোঝাতে শুরু করে, রাখি মুখের অভিব্যক্তিটা আরো ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করো,ভাবো তুমি আবার কতদিন পর খাবার ও একটা নতুন জামা পেয়েছো। রাখি মাথা নেড়ে বলে ঠিক আছে। শুরু হয় আবার সেই দৌড় নীলয়ের হাতের ক্যামেরায় শুরু হয় রেকর্ডিং।
এবার কিন্তু আর কাট কাট না বলে রেকর্ডিং শেষে ভৌমিক বাবু ওয়ান্ডারফুল বলে ছুটে এসে রাখিকে জড়িয়ে ধরে। হাতের ইশারায় সবাইকে প্যাক-আপ করতে বলে।
রাখি সহ ভৌমিক বাবু এগিয়ে যায় সিটিং বেঞ্চের দিকে।ভৌমিকবাবু এবার অন্যান্য সকলকে বলে আগামীকাল কিন্তুৎ আউটডোর! ভোরে বেরোতে হবে পুরুলিয়া, সবাই তৈরি হয়ে থেকো।এক এক করে সকলে বেরিয়ে যায়।
দৃশ্য ২
রাহুলের ক্যামেরার ফোকাসটা এবার এক হাড়কঙ্কালসাড় বয়সের ভাড়ে নুয়ে পড়া শরীরের দিকে,
বৃদ্ধের সামনে সুন্দর করে সাজানো খাবারের থালা, আজ অনেকদিন পর সামনে খাবারের থালা দেখে চোখের কোনায় জলের রেখা দেখা দিয়েছে সেটাও নিখুত ভাবে ধরা পড়ছে ক্যামেরার লেন্সে,
এরপরেই গল্প অনুযায়ী ক্যামেরার ফোকাস ঘুরতে থাকে গ্রামের প্রকৃতির দিকে, আশেপাশেই উলঙ্গ শিশুদের করুণমুখ ,শতছিন্ন কাপড়পড়া মেয়েরা নিজেদের লজ্জা ঢাকতে ব্যস্ত, এবার ভৌমিক বাবুর ঈশারায় রাহুল রেকর্ড করতে থাকে এই প্রতন্ত গ্রামের এর নীল আকাশেও ভোটের আগে বড় বড় সারিসারি হোর্ডিং আর হাজারো প্রতিশ্রুতি ভরা পোষ্টারের রংবেরঙের ছবি গুলিকে। শুটিং শেষে নীলাঞ্জনা প্রোডাকশান হাউসের প্রধান নন্দিতা দি গ্রামের উন্নয়নের জন্য পাঁচ লাখ টাকার একটা চেক তুলে দেয় গ্রামপ্রধান এর হাতে,এক বৃদ্ধ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে “আবার কবে আসবি রে তোরা?”.তোদের জন্যে এই কটাদিন একটু খেতে পেলাম, নয়তো এই গ্রামের দিকে তো কেউ ফিরেই চাইনা। এসব শুনে ভৌমিক বাবুর মন ও চোখের পাতাটা কেঁপে ওঠে। একে একে রাঙামাটির পথ ধরে এগিয়ে যেতে থাকে গাড়িগুলো।
পরদিন বিকেলে ভৌমিকবাবু উদাস মনে এক দৃষ্টিতে ছোট্ট জানালা দিয়ে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে হাতে গরম চায়ের কাপ, আর মিউজিক প্লেয়ার থেকে ভেসে আসছে শানের গলায় রবীন্দ্র সংগীত “শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা,
শুধু আলো-আঁধারে কাঁদা-হাসা ॥
শুধু দেখা পাওয়া, শুধু ছুঁয়ে যাওয়া,
শুধু দূরে যেতে যেতে কেঁদে চাওয়া,
শুধু নব দুরাশায় আগে চ’লে যায়–
পিছে ফেলে যায় মিছে আশা ॥”