জিগনেশ চলে যাওয়ার পর মনের দিক থেকে একেবারে ভেঙ্গে পড়ল নীতিন রিন্দানী। তবে পুত্র ও পুত্রবধূকে কোনো দোষ দিলো না, সব দোষের ভাগী করল নিজেকে। অনেক বছর আগে সেও তো এভাবেই স্ত্রীকে নিয়ে পরিবার-পরিজন ছেড়ে এসেছিল। তখনও কি এমনই দুঃখ পেয়েছিল ওর বাবা, সতীশভাই রিন্দানী? কর্মফল, সবই ওর কর্মফল; তাই সারা জীবন সুখে কাটিয়ে এই শেষ বয়সে এসে কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হচ্ছে নীতিন রিন্দানীকে। আত্মগ্লানি হৃদয়ের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। হঠাৎ একদিন হার্ট-অ্যার্টাকে নীতিন রিন্দানীর হৃদয়ের স্পন্দন থেমে গেল চিরতরে। ইহজীবনের দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পেল অনুতপ্ত মানুষটা।
মেঘনাকে ছাড়াই পুনাতে এলো জিগনেশ, বাবার শ্রাদ্ধ করতে। কাজকর্ম মিটে গেলে মাকে পরামর্শ দিল বড় ফ্ল্যাটটা বেচে দিয়ে বোনকে নিয়ে একটা ছোট ফ্ল্যাটে শিফট করতে। ছেলের কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল কোকিলাবেন। লাভ হবে না দেখে জিগনেশও আর কথা বাড়ালো না, চুপচাপ ফিরে গেলো ব্যাঙ্গালোরে।
নীতিন রিন্দানী মারা যাওয়ার সাথেই মারা গেল দেবাঙ্গীর সংসার পাতার আশাও।
হঠাৎ করেই পালটে যেতে শুরু করল আশিষ। দূরে সরে যেতে লাগলো দেবাঙ্গীর কাছ থেকে। তারপর একদিন বাবা,মায়ের পছন্দ করা একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিল, তিন দিদির বিয়েতে খরচ হওয়া টাকাগুলো কোথাও না কোথাও থেকে উসুল করে আনতে হবে তো, দেবাঙ্গীকে বিয়ে করলে যৌতুক পাওয়ার কোনো আশা নেই তাই এই সিদ্ধান্ত।
আর কোকিলাবেন কোনোদিনই মেয়ের বিয়ের জন্য কোনো উদ্যোগ নেবে না, কারন তাতে জমানো পয়সা খরচ হয়ে যাবে।
পায়ের তলার মাটি শক্ত করার দিকে মন দিল দেবাঙ্গী, চেষ্টা করতে লাগল আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার। মহারাষ্ট্র রাজ্য বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগে চাকরি পেয়ে গেল ও। সরকারি চাকরি, রিটায়ারমেন্টের পর পেনশন; টাকাপয়সার জন্য আর কখনও কারও কাছে হাত পাততে হবে না ওকে।
মেয়ে চাকরি পেয়েছে দেখে হাতে স্বর্গ পেল কোকিলাবেন, বাকি জীবনটা বেশ ভালোভাবে কাটবে এবার। যতদিন জীবন আছে ততদিন এই সোনার ডিম পাড়া মুরগিটাকে হাতছাড়া করা যাবে না। মেয়ের ওপর নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করল কোকিলাবেন। যাতে অফিসের কোনো ছেলের সাথে দেবাঙ্গী কোনো সম্পর্ক তৈরি করতে না পারে, তাই অফিস থেকে ফিরলেই নানারকম প্রশ্নবাণে ক্ষত-বিক্ষত করে দিত মেয়েকে।
মনের বিষ ধীরে ধীরে ছড়াতে শুরু করল কোকিলাবেনের শরীরে। পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে গেল শরীরের নিম্নাংশ। আত্মসুখী কোকিলাবেন এবার অজগর সাপের মতো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল দেবাঙ্গীকে, গ্রাস করে নিল ওর মনের সব শান্তি।
দেবাঙ্গী মেনে নিয়েছিল ভবিতব্যকে। সব আশা ছেড়ে যখন নিঃস্পন্দ, নিরুত্তাপ জীবনটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল রুটিনমাফিক তখনই ওর জীবনে এলো সেবেস্টিয়ান উইলসন। তরতাজা, প্রাণবন্ত পুরুষ। মিষ্টি কথার জাল বুনে দেবাঙ্গীকে মোহিত করে ফেলল সেবেস্টিয়ান।
সেবেস্টিয়ান বিপত্নীক, পাঁচ বছরের কন্যাসন্তানকে নিয়ে ‘দোকা’-র সংসার। ও আগে একটা ওয়াটার পিউরিফায়ার কোম্পানিতে কাজ করতো, কিন্তু স্ত্রী মারা যাওয়ার পর মেয়েকে সামলে আর অতো কষ্টের কাজ করতে পারছিল না, তাই অনেক চেষ্টাচরিত্র করে এই সরকারি চাকরিটা জুটিয়েছে। অফিসের কাছেই একটা এক কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে।
প্রথমদিন থেকেই সেবেস্টিয়ানকে বেশ মনে ধরেছিল দেবাঙ্গীর। চেহারাটা ঝাঁ-চকচকে হলে কি হবে মনটা একেবারে সহজ, সরল; বাচ্চা ছেলের মতো। তাছাড়া ওদের দুজনের অবস্থাও প্রায় একই রকম ছিল, দুজনেই ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার, পরিস্থিতির চাপে পর্যদুস্ত; বেঁচে থাকা ভুলে শুধু মুখ বুজে দায়িত্ব পালন করে চলেছে। মনের কাছাকাছি আসতে খুব বেশি সময় লাগেনি দুজনের। প্রথমে অফিসেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটুআধটু গল্পগাছা। তারপর অফিস শেষে কাছাকাছি কোনো শপিং মলে ঘোরাফেরা। তারপর একদিন সেবেস্টিয়ানের জোরাজুরিতে ওর বাড়ি যাওয়া। যাওয়ার পথে ডে-কেয়ার থেকে পামকিনকে পিক-আপ করে নিয়েছিল সেবেস্টিয়ান। মা মরা মেয়েটার দেবাঙ্গীকে দেখে আনন্দ আর ধরে না, মনের ভেতর জমিয়ে রাখা যে কথাগুলো বাবাকে বলতে পারেনি এতোদিন সেগুলো সব একসাথে বলতে চাইছিল দেবাঙ্গীকে। আসলে দেবাঙ্গীর মধ্যে নিজের মাকে খুঁজছিল বাচ্চা মেয়েটা। দেবাঙ্গীও ভালোবেসে ফেলেছিল পামকিনকে। মাঝে মাঝে ছুটির পর ওরা তিনজনে রেস্তোরায় খেতে যেতো, ধারেকাছে কোথাও বেড়াতে যেতো; দেবাঙ্গীর মনে হোতো ঠিক এই রকম একটা সংসারই তো ও চেয়েছিল। কিন্তু সেবেস্টিয়ান কি কোনোদিনও আপন করে নেবে ওকে? অনেক সহৃদয় পুরুষ স্বেচ্ছায় বাচ্চা সমেত বিধবা বা ডিভোর্সিকে বিয়ে করে, কিন্তু পঙ্গু মা সমেত অবিবাহিতা? তাকে সংসারের জালে জড়াবার মতো উদারতা দেখাতে পারে কি কেউ?
আর যদি কোনোদিন সেবেস্টিয়ান দেবাঙ্গীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তাহলেও কি ও সেই প্রস্তাব গ্রহন করতে পারবে? কোকিলাবেন এতো সহজে মুক্তি দেবে ওকে?
কিন্তু বাঁচার অধিকার তো দেবাঙ্গীরও আছে। চলমান শরীরের ভেতর যে মনটা রয়েছে সেও তো এবার বাঁচতে চাইছে; কাছে পেতে চাইছে পছন্দের মানুষদের।
মন শক্ত করে দেবাঙ্গী। সারাজীবন অনেক সহ্য করেছে, আর নয়। যেভাবেই হোক এবার সাজিয়েগুছিয়ে নিতে হবে নিজের বাকি জীবনটাকে। কোকিলাবেনের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করতে হবে নিজেকে।
মনে মনে ছক কষতে থাকে দেবাঙ্গী।
শয্যাশায়ী হওয়ার পর থেকে আর বাইরে ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না কোকিলাবেন। তাই সব প্রয়োজনীয় মেডিকাল ইকুইপমেন্ট কিনে রেখেছে দেবাঙ্গী। নিজেই সময়মতো চেক-আপ করে দেয় মায়ের, কিছু গড়বড় হলে তবেই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়। রোজ অফিসে বের হওয়ার আগে কোকিলাবেনকে স্নান করিয়ে, দুপুরের খাবার খাইয়ে একটা করে ব্লাড-প্রেসারের ট্যাবলেট খেতে দেয় দেবাঙ্গী। খুব সন্তর্পনে কোকিলাবেনের ব্লাড-প্রেসারের ট্যাবলেটটাকে প্রায় একই রকম দেখতে একটা অ্যান্টাসিডের সাথে পালটে দিতে লাগলো ও। কোকিলাবেনের ছোটবেলা থেকেই অম্বলের ধাত, তাই অজান্তে রোজ অ্যান্টাসিড খেয়েও কোনো অভিযোগ করল না।
হিন্দুধর্মের এটাই বিশেষত্ব, যে মৃত্যুর পর মৃতদেহ দাহ করতে হয়, আর একবার যদি শরীর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় তাহলে শত চেষ্টা করলেও আর মৃত্যুর কারন অনুসন্ধান করা যায় না।
জানালা দিয়ে একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে এলো। দেবাঙ্গীর ঠোঁটের কোনে দেখা গেল একটা তৃপ্তির হাসি। পরিকল্পনা মাফিক কাজ করে সফল হওয়ার সন্তুষ্টি।
______
করোনা ভাইরাসের প্রকোপ খুব একটা না কমলেও আজই লকডাউনের শেষ দিন। আগামী কাল থেকে শুরু হচ্ছে আনলক ফেজ-ওয়ান। আর গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হবে না কাউকে, বিধিসন্মত সুরক্ষাসহ বাইরে বের হতে পারবে সবাই। ত্রিশ শতাংশ কর্মচারী নিয়ে খুলে যাবে বেশ কিছু অফিস। মাস্ক, গ্লাভস, আর স্যানিটাইজারকে সঙ্গে নিয়ে শুরু হবে মানুষজনের ‘নিউ নর্ম্যাল’ জীবনযাত্রা।
বারান্দায় এসে দাঁড়ায় দেবাঙ্গী। গোলকচাঁপা গাছটা ফুলে ফুলে ভরে আছে। গাছটার দিকে তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়।
হালকা হাওয়া বয়ে নিয়ে আসে গোলকচাঁপার সুগন্ধ। এই হলুদ-সাদা ফুলগুলোর গন্ধ দেবাঙ্গীর খুব প্রিয়। ছোটবেলায় ঝরে পড়া ফুলগুলোকে কুড়িয়ে এনে পুতুলের বিছানায় রেখে দিতো। একদিন বন্ধুদের সাথে গল্প করতে করতে অজান্তেই চুষে ফেলেছিল গোলকচাঁপা ফুলের মধু। মধুর স্বাদের কোনো তারতম্য নেই, অন্যান্য ফুলের মতোই তার স্বাদও মিষ্টি। কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই দেবাঙ্গীর গা গুলোতে শুরু করে, বমনোদ্রেক হয়। পরে জেনেছিল গোলকচাঁপা ফুলের ভেতর হালকা বিষ থাকে।
প্রিয় ফুলের সুগন্ধে ভরা বাতাসটাকে নিজের ভেতর টেনে নিতে চায় দেবাঙ্গী। এতো সুন্দর ফুলগুলোর ভেতরেও বিষ আছে? কেন??
হয়তো আত্মরক্ষা করার জন্য। বিরূপ প্রজাতির হাত থেকে নিজের গর্ভকেশরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
বাইকের হর্নের আওয়াজে সম্বিত ফেরে দেবাঙ্গীর। সেবেস্টিয়ান এসে গিয়েছে পামকিনকে সঙ্গে নিয়ে। একগাল হেসে পামকিনের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ে দেবাঙ্গী।