যবে থেকে বেপরোয়া হয়েছি দেখছি বেশ মজা।জীবনটা কেমন যেন ফুরফুরে হয়ে গেছে!ভাবি জীবন এর আগে এত ভালো কবে ছিল? উঁহু মনে করতে পারছি না তো!এখন যেন মনে হয় টপ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড!
না না গল্পটা সারা জীবন এই রকম ছিল না।বরং এই জীবন যদি রঙিন সিনেমা হয় তো ওটা ছিল সাদা কালো পঞ্চাশের দশকের ।একদম ফর্মুলা মিলিয়ে এক দজ্জাল শাশুড়ি, মেনীমুখো বর,ম্যাদা মার্কা শ্বশুর আর সবার ওপরে রায় বাঘিনী ননদিনী আর দেওর ভাসুর ও ছিল গন্ডাখানেক,তুতোছুতো মিলিয়ে।।
সে বাড়িতে আমি ছিলাম রাসুর বৌ!রাসবিহারী, রাসবিহারী দত্ত ,আমার বরের নাম।একটু সেকেলে।তো বনেদি দত্ত বাড়ির সব ছেলে মেয়েদেরই ছিল এই এক রকম লম্বা চওড়া বেশ ভারভারিক্বী নামের মহিমা। সে নামগুলোর এতই ভার যে মানুষগুলো নুইয়ে থাকতো মুড়ির মত ,চিঁড়ের মত বললেও তাতে দোষের কিছু নেই।
মোদ্দা কথা, আমার বাবা ,ছা পোষা কেরানী হারাধন দত্ত ধন হারা তো ছিল সারাজীবনই কিন্তু রূপের জোরে,অথবা হয়তো আগের দুই জা বেশ বড়লোক বাড়ির তাই তাদের কুটেবেটে শাশুড়ির তেমন সুবিধে বা সুখ কোনোটাই হচ্ছিল না বলে আমাকে এ বাড়ির বৌ করে আনে।
আমাদের তিন বোনের মধ্যে আমিই বড়।তাই নাইনে পড়তে না পড়তেই বছর পঁয়ত্রিশের রাসবিহারীর বৌ হিসেবে যখন এক বিয়ে বাড়িতে আমাকে দেখে শাশুড়ি আগ বাড়িয়ে সম্বন্ধ করলো, আমার বাবা ,কাঁধে ছাতা,বেঁকে দড়ি পাকানো মেরুদন্ড নিয়ে আমাকে ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেললো।
না পণটন নিয়ে আমাকে কোনো জ্বালাতন সহ্য করতে হয়নি কারণ আমার বাবার পকেট যে গড়ের মাঠ জেনেই আমাকে এ বাড়ির বৌ করা হয়।দত্ত বাড়ির সেজো বৌটা আমার পদবী।বাস্তবে আমি মানদা দি বা কাকলি মাসীর চেয়ে বাড়তি বা উঁচু দরের কেউ নই।
সেই ভোর পাঁচটায় উঠে এক তলার রান্নাঘরে আগুন জ্বালাতাম।গ্যাস এসে গেছিল তবে তা দোতলার রান্না ঘরে,শুধু নিরামিষের জন্য।ওখানে দায়িত্বে শাশুড়ির তত্বাবধানে ছোট জা আর মেজো জা।বড়লোকের আদুরে মেয়েরা।আর নিচের রান্না ঘরে আমি আর বড় জা।
যদিও বড় জা আমার মত হা ঘরে হাভাতে বাড়ির মেয়ে নয় তবুও প্রথম বৌ হয়ে আসার কারণে বেচারির ওপর হামানদিস্তার বারি বোধহয় বেশিই পড়েছিল।তাই আমার মত সামাজিক অবস্থানের না হয়েও ও ছিল আমার সমগোত্রীয়।
তবে ওর বেশ একটা সাধু সাধু ভাব।যেন কিছুই বোঝে না ,জানে না ,জানতে চায়ও না।ওর কাউকে কিছু বলার নেই, চাওয়ার নেই।চারটি খেতে পেলেই সুখ।আর রাতে একটু ঘুমোতে পেলে।তাও বনেদিয়ানা বজায় রাখতে শাশুড়ির পা টিপতে টিপতে প্রায় দিনই ঢলতে ঢলতে ঘরে যায়।তাই ভাসুর ঠাকুর যে দু দুখানা ছেলের বাবা হয়েই ভাব ভালোবাসায় খান্ত দিয়েছেন বেশ বুঝি।
আমাদের উনি আবার নিজেরটা বেশ বুঝে নেন।সে জ্বর হোক,মাথা যন্ত্রনায় দপদপ করুক ,চায় ওই দিন গুলোতে কোমর পেট ছিঁড়ে পড়ুক।রক্তে মাখামাখি হয়েও সব খিদে মেটাতে হত।আমি কিন্তু কাঁদতাম না, দাঁতে ঠোঁট চিপে পড়ে থাকতাম।এক একদিন দাঁতের চাপে ঠোঁট কেটে বা কালসিটে পড়ে গেলে শাশুড়ি শুনিয়ে শুনিয়ে গাল পাড়তো,”আ মরণ।রং তামাশা দেখ!”আর যেন কারো স্বামী সোহাগ হয় নি!ছোটলোকের বেটি কোনটা ঢাকতে আর কোনটা খুলতে হয় কি জানবে?শিক্ষের অভাব!”
আমি অবাক হতাম,এই কথাগুলো ছেলেকে বলে না কেন?আমি তো আর ছেলেকে বলিনি এসব করো!কার শিক্ষার অভাব সে বেশ জানি।কিন্তু না ওসব বলা যাবে না।সব ভায়েরা পৈতৃক ব্যবসায়।কেউ কেউ ওই টেনেটুনে কলেজ।আর বাকিরা ইস্কুলেই খ্যান্ত দিয়েছে।
একমাত্র রায়বাঘিনী ননদিনীও বনেদি বাড়ির বৌ।উত্তর কলকাতাতেই।তাই সে বেশিরভাগটাই এ বাড়িতে।জামাই বৌ নিতে আসলে দামি দামি উপহার নিয়ে বেশ কয়েকঘন্টা দোর বন্ধ করে কাটিয়ে হাঁটা দেয়।না ,সেও শশুরবাড়ি থাকে না।বনেদি পরিবারের ছেলেদের নাকি শ্বশুরবাড়ি থাকতে নেই।
এভাবেই দু দু বার মা হলাম।কিন্তু মা ডাক আর শুনলাম না।দু দুবার ই নাকি আমার মেয়ে হবে,তাই কি সব ওষুধ খাইয়েছে সবাই মিলে ধরে।সবাই বলতে আপনাদের রাসু বাবু,আমার ননদ মিন্টু আর আমার শাশুড়ি দত্তগিন্নী।প্রথম বার বুঝিনি, বললো ঠাকুরের প্রসাদি সিন্নী।আমিও খেয়ে নিলুম।তার পর শুরু হল ব্লিডিং।
বাবা গো, মা গো বলে কত চিৎকার করলাম, কত ভগবান কে ডাকলাম।না বাবা মা শুনলো,না ভগবান!তখনো এসব ফোনটোন হয়নি।ওই তার ওয়ালা ফোন।যা শাশুড়ির ঘরের সামনাসামনি বৈঠকখানায় রাখা থাকতো।তাও আবার বাক্স তালা লাগানো , আর চাবি শাশুড়ির আঁচলে!
কিন্তু দ্বিতীয় বার আমি রুখে দাঁড়ালাম।এক তো কি করে বুঝছে,মেয়ে হবে?ও কি গায়ে লেখা?কি? না, গুরুদেব বলেছেন রাসুর তৃতীয় সন্তান ছেলে হবে।তাই প্রথম দুই গর্ভ রাখা যাবে না।এই সময় যেখানে পৃথিবী কত এগিয়ে, মেয়েরা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, হচ্ছে,সেখানে বনেদিয়ানার নামে যে ঐসব চলে কে বলবে?
বাড়ির ছেলেরা যখন সাদা ফতুয়া আর পাঞ্জাবি পড়ে গদিতে বসে আহা পবিত্রতার পরাকাষ্ঠা!আর শাশুড়ি লালপাড় সাদা তাঁত এক গা গয়না, মুখে পান,স্বয়ং মা দুর্গা!ওরা যে আসলে এক একটা অসুরের অবতার তা কে বুঝবে?
এ বাড়িতে একমাত্র আশার আলো ছোট বৌ।ওকে দূর থেকে দেখি।মিষ্টি স্বল্পভাষী।ওর বাবা জজ না ম্যাজিস্ট্রেট কি যেন?ছোট দেওর নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছে।বেশ পড়ালেখা জানে।সে এ বাড়িতে বিশেষ আসে না।বরং দেওরই টালিগঞ্জে শ্বশুরবাড়িরতে যায়।
“বাপ মায়ের একমাত্র মেয়ে।সব সম্পত্তি তো তোরই ।এখন থেকে বুঝে নে।”
তাই দেওর ও প্রথম থেকেই নিজের ভাগ বুঝে নেয়।আর তাই বেশিরভাগ দিনই ওদের ঠিকানা টালিগঞ্জ।
আমার দ্বিতীয় বার মা হবার সময় আমি খুব সতর্ক।কারো দেওয়া কিছু খাচ্ছি না।ওসব প্রসাদ ফ্রসাদ তো নয়ই।শুরু হল অন্য রকম অত্যাচার।রোজ রাতে রাসবিহারী দত্তর পৌরুষ যেন দশগুণ হয়ে যেত।বুঝতাম কেন আর কিসের জন্য!কিন্তু কি করবো?আমার বিদ্যে তো ওই নাইন!ছোট দুই বোন এখনো বাবার ঘাড়ে।পালাবো কোথায়?
শেষে এক রাতে এত অত্যাচার যে আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।সে সময় ছোট জা ছিল বাড়িতে।ওর তদারকিতেই আমাকে নার্সিং হোমে ভর্তি করা হল।না হলে হয়তো বাড়িতেই রক্তশূন্য হয়ে বা ইনফেকশনে মারা যেতাম।সেই নার্সিং হোমেই বাচ্চা নষ্ট করতে এসেছিল লাবন্য।হয়তো ওর একটা আসল নাম আছে।কিন্তু ওকে আমরা লাবন্য নামেই চিনি।আমাকে কাঁদতে দেখে ও সব জিজ্ঞাসা করলো।তারপর আমাকে নিয়ে গেল ওর সঙ্গে। মানে পালিয়ে গেলাম আর কি!জানতাম ওর সঙ্গে গেলে দত্তবাড়ির দরজা বা হারাধন দত্তর দরজাও বন্ধ কিন্তু আমি দুবার ভাবিনি!
লাবন্য এক জনকে ভালোবেসেছিল।হাঁসখালি না বগুলা কোথায় যেন ওর বাড়ি।পালিয়ে বিয়ের পর দীঘায় দিন দশেক ছিল।সেই ভালোবাসার মানুষ নিজের আশ মিটিয়ে ওকে ভোগ করে কি এক খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে এখানে রেখে গেছে।সে দিন থেকেই ও ওই অন্ধকার গলিতে।মাঝে মাঝে মা হয়,আর কেউ একটা মাসীর অনুগত দালাল বাবা সেজে এসে এই নার্সিং হোমে ভর্তি করে সব ঝামেলা মিটিয়ে আবার ওঠে ওই গলিতেই।
আমিও জুটে গেলাম ওই দলে।রঙিন নেশার অন্ধকারে স্বেচ্ছায় নাম লেখালাম।বদনামের আর কি আছে!ও বাড়িতে যা এক পুরুষের সঙ্গে করতে হতো তাই এখানেও করতে হবে খালি পুরুষ বদলে যাবে।বদলে পয়সা পাবো,সারাদিন লাথিঝাঁটা খেতে হবে না,ছোটলোকের মেয়ে হবার খোঁটা শুনতে হবে না,বরং টাকা জমিয়ে কিছু নিজের জন্য ও ভাবতে পারবো।রাসু দত্তর যা খাবল তা বোধহয় বুড়োকাল অবধি চলবে, তার চেয়ে এই ভালো!বরং এখানে স্বাধীনতা আছে।অন্তত ওই দিনগুলোতে তো রক্ষা পাবো।
নষ্ট হয়ে থেকে বেশ আছি,আমার শুধু রাতে কাজ।বাকি সময় সব করার লোক আছে।আর আমি সুন্দরী বলে আমার দর বেশি।এক বাঁধা বাবুও আছে।সে বলে সে নাকি আমাকে ভালোবাসে।ফুঃ!ভালোবাসা!হাসি পায়!বেশ্যাকে আবার ভালোবাসা।যাকে ঘরের বৌ হিসেবে কেউ ভালো বাসলো না, তাকে বেশ্যা হয়েও নাকি কেউ ভালোবাসে।যাকগে!সে আসলে রক্ষে!
মাসির হাতে টাকা দিয়েও আমার থাকে বেশ।আর সে লোক এসে এক একদিন ছোঁয় না পর্যন্ত, ইনিয়ে বিনিয়ে গল্প ফাঁদে,ভালোবাসার গল্প!আমি শুনিই না!ওসবে আমার আর বিশ্বাস নেই।তবে শোনার ভান করি!বা রে ,যদি বাবুর মন উঠে যায় তবে তো আবার, হাজার জনের খাবলাখাবলি!বাবু আমার সঙ্গে বেশ সংসার সংসার খেলে, আমিও খেলি!এখন এই খেলাতে আমি আসল সংসারের চেয়ে অনেক ভালো আছি।তবে বাবু যতই বলুক আসল সংসারে আর পা রাখছি না!আসল সংসারে আমার বড় ভয়!