• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে অঞ্জনা চট্টোপাধ্যায় (পর্ব – ১৩)

গোলকচাঁপার গর্ভকেশর

“হাই সেনোরিটা, আমি কি এখানে বসতে পারি?”, উত্তর পাওয়ার অপেক্ষায় ভদ্রলোকের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে ফাঁকা চেয়ারটাতে ঝপ করে বসে পড়ল সেবেস্টিয়ান। পাছে উঠে যেতে হয় সেই আশঙ্কায় তাড়াতাড়ি নিজের লাঞ্চ-বক্স খুলে উল্টোদিকে বসা নিতান্ত ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত চেহারার মহিলাটির দিকে এগিয়ে দিল একটি বিস্বাদ চিকেন স্যান্ডউইচ। মিষ্টি হেসে স্যান্ডউইচটি প্রত্যাখ্যান করে ভদ্রমহিলা জানালেন যে তিনি নন-ভেজ খান না, তবে নিজের টিফিনবক্স থেকে একটি ধোকলা তুলে নিয়ে সেবেস্টিয়ানের লাঞ্চবক্সের ওপর রেখে বললেন, টেস্ট করে দেখতে। গদগদ হয়ে তৎক্ষণাৎ ধোকলায় একটা বড়োসড়ো কামড় বসিয়ে সামনে বসা মহিলাটিকে একমনে দেখতে লাগলো সেবেস্টিয়ান। স্লিম ফিগার, শার্প ফিচার, হাসি মুখের আড়ালে রয়েছে একটা চাপা দুঃখের আভাস, অনেকটা সেই বাইবেল-এ পড়া ম্যাডোনার মতো। এই অফিসে জয়েন করার দিনেই সেবেস্টিয়ানের নজর পড়েছিল এই মহিলাটির ওপর। ইচ্ছে হয়েছিল বন্ধুত্ব করার। সহকর্মীদের কাছ থেকে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছিল, ভদ্রমহিলার নাম দেবাঙ্গী রিন্দানী, ম্যারিটাল স্ট্যাটাস- সিঙ্গল, একা হাতে অসুস্থ মায়ের সেবাযত্ন করতে করতে নাজেহাল অবস্থা, তাই এখনও বিয়ে করে উঠতে পারেনি। কেন জানি সেবেস্টিয়ানের বার বার মনে হচ্ছিল এই বিশেষ মহিলাটির কাছে ও নিজেকে উজাড় করে দিতে পারবে, খালি করতে পারবে মনের ভেতর এতোদিন ধরে জমিয়ে রাখা দুঃখগুলো, বুনতে পারবে ভবিষ্যতের সুখস্বপ্ন।
জ্ঞান হওয়া থেকেই জীবনের যাঁতাকলে চূর্ন-বিচূর্ন হচ্ছে সেবেস্টিয়ান, মায়ের আদরের স্যাবি। ছোটবেলাতেই ওর বাবা মারা যায়। নিয়মিত রোজগার নেই তাই সংসারে চরম আর্থিক অনটন। ওদের তিন ভাইবোনকে নিয়ে মায়ের নাজেহাল অবস্থা। স্যাবির মা মার্গারেট তেমন লেখাপড়া জানতো না তাই ভালো ইংরেজি বলতে পারা সত্বেও কোনো ভালো কাজ জোটাতে পারলো না। নানা রকম ‘অড জব’ করেই সংসার চালাতে লাগলো মার্গারেট।
ওরা তিন ভাইবোন বিনা মাইনের মিশনারি স্কুলে পড়তো। স্যাবির বড় দিদি মার্থা স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ার সময় থেকেই মারাঠি মিডিয়ামের ছোট ছোট বাচ্চাদের ইংরেজি পড়াতো, একটু বড় ছেলেমেয়েদের ইংরেজিতে কথা বলতে শেখাতো। নিজের পড়ার খরচ চালানোর পর যে টাকাটা বেঁচে যেতো সেটা তুলে দিতো মার্গারেটের হাতে। স্কুলের পরীক্ষায় পাশ করে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর মার্থা টাইপ-শর্টহ্যান্ড শিখতে শুরু করলো। আর গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেই একটা ভালো অফিসে স্টেনোগ্রাফারের কাজ জুটিয়ে নিল। মার্গারেটের চাপ একটু কমলো, এখন থেকে আর অসুস্থ শরীরে বাইরে ঘুরে ঘুরে কাজ করতে হবে না।
মার্থার থেকে বছর দুয়েকের ছোট ছিল মারিনা। লেখাপড়ায় মারিনার একেবারেই মন ছিল না, মার্গারেটকে ঘরের কাজে সাহায্য করার বেলাও অষ্টরম্ভা। ঘরেও মন বসতো না মারিনার, ওর কাজ ছিল খালি সাজগোজ করা আর সারাদিন বখাটে ছেলেদের সাথে টইটই করে ঘুরে বেড়ানো। তবে দিদিকে সেজেগুজে অফিস যেতে দেখে ওরও খুব শখ হল চাকরি করার। মার্থার অফিসে রিসেপশনিস্টের পোষ্ট খালি হয়েছিল, বলেকয়ে সেখানেই ছোটবোনকে ঢুকিয়ে দিল মার্থা। অফিসের কাজ মন দিয়ে না করলেও কমবয়সী ম্যানেজারের সাথে প্রেম করার ব্যাপারটায় বেশ ভালোই মনোযোগ দিয়েছিল মারিনা। মারিনার চেহারায় চটক ছিল, তার ওপর ছিল এতোদিনের অভিজ্ঞতা, কয়েকদিনের মধ্যেই মারিনার প্রেমে হাবুডুবু খেতে লাগলো ম্যানেজারবাবু; তারপর একদিন বাড়ি এসে বিয়ের প্রস্তাব দিল। চাকুরিরতা, গৃহকর্মনিপুনা, শান্ত, ভদ্র, দায়িত্ববতী মার্থার আগেই ওয়েডিং ড্রেস পরে ফেলল অলস ও আত্মকেন্দ্রীক মারিনা।
চুলবুলি ছোট মেয়েটাকে নিয়ে মার্গারেটের বেশ চিন্তা ছিল, এই না কিছু করে বসে, সকলের মুখে কালি মাখায়, তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাওয়াতে সে সব দুঃশ্চিন্তার হাত থেকে মুক্তি পেল মার্গারেট। তবে সংসারের হাল ধরার জন্য তো আর বড় মেয়েকে চিরকাল আটকে রাখা যায় না, তাই মার্থার জন্য সুপাত্রের খোঁজখবর করা শুরু করে দিল। মার্থা দায়িত্ববতী ছিল ঠিকই কিন্তু ওর আগে ওর বোনের বিয়ে হয়ে গেল, তাও আবার ওরই অফিসের ম্যানেজারের সাথে, এই ব্যাপারটা বেশ নাড়া দিয়েছিল ওকে। বোনের বিয়ের পর থেকে সবসময় মনমরা হয়ে থাকতো ও, রুটিন কাজগুলো করতো যন্ত্রচালিতের মতো। মেয়ের মনের ভাব মার্গারেট বেশ ভালোই বুঝতে পারছিল, তাই এবার আদাজল খেয়ে লেগে পড়ল বড় মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে। বছর খানেকের মধ্যে মার্থাও সাদা পোষাক পরে বরের হাত ধরে চার্চ থেকে বেরিয়ে এলো।
মার্থা, মারিনার মতো স্বার্থপর ছিল না তাই বিয়ের পরেও সাধ্যমতো কর্তব্য পালন করতো মা আর ভাইয়ের প্রতি। কিন্তু বিবাহিত মেয়ের কাছ থেকে অর্থসাহায্য নিতে বেশ কুন্ঠাবোধ করতো মার্গারেট। তাই ভালো রেজাল্ট করলেও গ্রাজুয়েশনের পরেই লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে দিল স্যাবি, লেগে পড়লো রোজগারের চেষ্টায়।
ফর্সা, সুদর্শন, একেবারে ‘গ্রীক গড’-এর মতো চেহারা ছিল স্যাবির তাই চাকরি পেতে বেশি বেগ পেতে হল না। একটা নামী ওয়াটার পিউরিফায়ার কোম্পানি কাজে বহাল করলো ওকে; দরজায় দরজায় ঘুরে পরিস্রুত পানীয় জল পান করানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কাজ। ওদের কোম্পানির পলিশি ছিল ‘নক এভরি ডোর’, সেইমতো প্রত্যেক দরজাতেই কড়া নাড়তো স্যাবি। কেউ বিরক্ত হয়ে মুখের ওপরেই দরজা বন্ধ করে দিতো। কেউ আবার ভেতরে ডাকতো, সব রকম মেশিনের সমস্ত গুণাবলী শোনার পর সবচেয়ে কম দামী পিউরিফায়ারটা অর্ডার করতো। তবে সবথেকে অবাক করা কাজ-কারবার করতো মাঝবয়সী একাকিনীরা। তারা স্যাবির সুন্দর চেহারা দেখে মুগ্ধ হয়ে ওকে ভেতরে ডেকে বসাতো। গরমকালে ঠান্ডা জল, শীতকালে চা, কফি অফার করতো। একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে মেশিনের গুণগান শুনতো তারপর আদুরে গলায় জানাতো জল পরিশোধন করার যন্ত্র তো অনেকদিন থেকেই রয়েছে, তবে যদি কোনোদিন নতুন যন্ত্র লাগে তাহলে ওকেই যোগাযোগ করবে আর সেই সুযোগে আদায় করে নিতো ওর ফোন নম্বর।
কাজটা ভালো না লাগলেও রোজগারটা বেশ ভালোই হচ্ছিল স্যাবির। সুখেই দিন কাটছিল মা,ছেলের। তবে মানুষের জীবনে সুখ ক্ষণস্থায়ী। মার্গারেটের টিউবারকিউলোসিস ধরা পড়ল, একটু একটু করে ক্ষয়ে যেতে লাগলো শরীরটা। মরার আগে ছেলেকে সংসারী দেখতে চায় মার্গারেট কিন্তু শরীরের যা অবস্থা তাতে আর ছেলের জন্য পাত্রী খোঁজার ক্ষমতা নেই। মা অসুস্থ, দিদিরা যে যার নিজের নিজের সংসার নিয়ে বেজায় ব্যাস্ত, অগত্যা নিজের ব্যাবস্থা নিজে করাতেই মন দিল সেবেস্টিয়ান।
স্যাবির অফিসেই কাজ করতো অলিভিয়া, টেলি-কলার; সুমধুর স্বরে, সময়মতো ক্লায়েন্টদের মনে করিয়ে দিতো এ,এম,সি রিনিউ করানোর কথা, কান পেতে শুনত তাদের যন্ত্র সংক্রান্ত অভিযোগ, আশ্বাস দিতো যত শীঘ্র সম্ভব সুযোগ্য টেকনিশিয়ানকে সেখানে পাঠিয়ে দেওয়ার। প্রাণোচ্ছল মেয়েটার তিনকুলে কেউ ছিল না। বাবা,মা মারা গিয়েছে ছোটবেলাতেই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আত্মীয়ের বদান্নতায় বড় হয়েছে। লেখাপড়া শেষ করে চাকরি জোটানোর পর আর কারও গলগ্রহ হয়ে থাকতে চায়নি। আপাতত একটা লেডিস হোস্টেল ওর ঠিকানা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।