সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মানস চক্রবর্ত্তী – ৬
by
·
Published
· Updated
মর্তকায়ার অন্তরালে
|| ছয় ||
স্বাভিমানবোধ ও বিদ্যাসাগর
“বর্ধমানেশ্বরী শ্রীল শ্রীমতী মহারাজ্ঞী তুলাদান করিয়া কলিকাতাস্থ প্রধান পণ্ডিতগণের নিকট বিদায় প্রেরণ করিয়াছেন , তন্মধ্যে কেবল শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভট্টাচার্য্য মহাশয় উক্ত বিদায় গ্রহণ করেন নাই কহিয়াছেন যে আমি গবর্ণমেণ্টের স্থানে তিন শত টাকা মাসিক বেতন পাইয়াছি তাহাই আমার যথেষ্ট হইয়াছে আর অন্য প্রকারে উপার্জ্জন করিতে বাসনা নাই ….”
১৮৫৪ সালের ২২ জুলাই ‘সম্বাদ ভাস্করে’ প্রকাশিত একখানা প্রেরিত পত্রের কিয়দংশ উপরে উল্লিখিত হলো |
বর্দ্ধমানেশ্বরীর দান গ্রহণ না করাটা যে তাঁর অহঙ্কারের প্রকাশ একথার স্পষ্ট উল্লেখ ঐ পত্রে করা হয়েছে |
” ….বিদ্যাসাগর গবর্ণমেণ্টের অধিক প্রিয়পাত্র হইলেও বর্দ্ধমানেশ্বরীর দান অবজ্ঞা করিয়া ফিরিয়া দেওয়া অতি অসঙ্গত কার্য্য হইয়াছে আমি বোধ করি যদি ঐ দান বিদ্যাসাগর ভট্টাচার্য্য মহাশয় আপন সম্ভ্রম সূচক জ্ঞান করিয়াও গ্রহণ করিতেন তবে তাঁহার নামের উপযুক্ত কার্য্য করা হইত , হায় , আমারদিগের বাঙ্গালি লোকের কুস্বভাব বিদ্যা প্রভাবেও দূর হইতেছে না , অন্যদেশীয় লোকেরা বিদ্যায় বিদ্বান হইলেও বহু সংখ্যক ধনোপার্জ্জন করিতে পারিলেও আপনারদিগের নম্রতা শীলতা সভ্যতা করিতে পারেন না কিন্তু বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগরের বিন্দুমাত্র স্পর্শ করিয়াই ও তিনশত টাকা মাসিক বেতন প্রাপ্ত হওয়াতেই অহঙ্কারে একেবারে চক্ষুঃ কর্ণ উভয়েন্দ্রিয় হারাইয়াছেন ….. | ” ১
এই যুক্তি কি ন্যায় সঙ্গত ? ‘এ’ বিদ্যাসাগরের স্বাভিমানবোধ না অহঙ্কার ? প্রশ্ন তিনি কি কক্ষনো বিদায় গ্রহণ করেননি ?
কিন্তু রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে রূপোর পানপাত্রটি রক্ষিত আছে তা তো তাঁর বিদায় গ্রহণের স্বপক্ষে প্রমাণ দেয় | মাতৃভক্ত গুরুদাস মাতৃশ্রাদ্ধে বিদ্যাসাগরকে যে পানপাত্রটি দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর তা গ্রহণ করেছিলেন | পানপাত্রের একটি শ্লোক এখানে উল্লেখ করি :
“পান পাত্রমিদং দত্তং বিদ্যাসাগরশর্ম্মণে
স্বর্গকামনয়া মাতুর্গুরুদাসেন শ্রদ্ধয়া || ” ২
সুতরাং বিদ্যাসাগর যে অহঙ্কার বশত বিদায় অস্বীকার করছেন তা ধোঁপে টিকছে না | এটাই সত্য যে তিনি অহঙ্কারে নয় , বরং অহঙ্কারীর দানই গ্রহণ করতেন না | এটাই বিদ্যাসাগরের বিদ্যাসাগরত্ব |
সংস্কৃত কলেজ থেকে পড়াশোনা করে বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে সেরস্তাদার পদপ্রার্থী হলেন | ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের সেক্রেটারি তখন মার্শাল সাহেব |
১৮৪১খ্রিস্টাব্দের ২৯ডিসেম্বর বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বাংলা বিভাগের সেরেস্তাদার বা প্রথম পণ্ডিত হলেন | বেতন পঞ্চাশ টাকা |
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে সাহেবরা পড়তেন | ওদেশ থেকে যারা এদেশে বড়ো চাকরি করতে আসতেন তাদেরকে চাকরিতে বহাল হতে হলে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে শিখতে হতো এদেশী ভাষা – যেমন বাংলা , হিন্দি প্রভৃতি | পরীক্ষা দিতে হতো এদেশী ভাষায় | পাশ করলে চাকরি না হলে পগার পার – ফিরে যাও স্বস্থানে |
এখানে একটু উল্লেখ করে নিই – মার্শাল সাহেবের অনুরোধে বিদ্যাসাগর এই সময় ভালো করে ইংরেজি আর হিন্দি শিখতে শুরু করেন | হিন্দি শিখেছিলেন একজন হিন্দুস্থানী পণ্ডিতের কাছে | আর ইংরেজি শিখেছেন দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় , নীলমাধব মুখোপাধ্যায় , রাজনারায়ণ গুপ্ত প্রভৃতির কাছে | স্মরণ রাখতে হবে এই ইংরেজি শিক্ষার চর্চা বিদ্যাসাগর পরবর্তীতেও বজায় রেখেছিলেন | শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের তথ্য অনুযায়ী রাজা রাধাকান্ত দেবের জামাতা বাবু অমৃতলাল মিত্র ও অপর জামাতা বাবু শ্রীনাথচন্দ্র বসুর নিকট ইংরেজি অনুশীলন করতেন | বিহারীলাল সরকার জানাচ্ছেন বিদ্যাসাগর আনন্দকৃষ্ণ বসুর নিকট সেক্সপীয়র পড়তেন |
সে যাইহোক বিদ্যাসাগরের কাজকর্মে মার্শাল সাহেব বেশ খুশি | কিন্তু লক্ষ্য করলেন একটা ব্যাপারে বিদ্যাসাগর বড়ো নির্দয় | সেটা হলো পরীক্ষা | ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পরীক্ষায় যাঁরা কৃতকার্য হতে পারতেন না তাঁদেরকে বিলেতে ফিরে যেতে হতো | তাই মার্শাল সাহেব পরীক্ষায় আঁটো সাঁটো ভাবটা একটু কম করতে বললেন | অর্থাৎ যাঁদের পাশ করার যোগ্যতা নেই তাঁদেরকে পাশ করিয়ে দিতে হবে | বিদ্যাসাগর মার্শাল সাহেবকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন ওই কাজটি তাঁর দ্বারা সম্ভব নয় | বরং তিনি চাকরি ছাড়তে রাজী আছেন কিন্তু অন্যায়ের প্রশয় দিতে পারবেন না |
সংস্কৃত কলেজ সম্পর্কে পরিকল্পনা করলেন বিদ্যাসাগর | ১৯৪৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি পরিকল্পনাটি সেক্রেটারি রসময় দত্তের কাছে দাখিল করলেন | কিন্তু রসময় দত্ত সম্পূর্ণ পরিকল্পনাটি ‘ কাউন্সিল অফ এডুকেশনে ‘ না পাঠিয়ে সামান্য একটু অংশ খণ্ডিত করে পাঠালেন | বিদ্যাসাগরের অনুরোধ এক্ষেত্রে গ্রাহ্য হলো না | বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রসময় দত্তের মতান্তর শুরু হলো | বিদ্যাসাগর ঠিক করলেন তিনি চাকরিতে ইস্তফা দেবেন |
সেই অনুসারে বিদ্যাসাগর ১৮৪৭ সালের ৭এপ্রিল ইস্তফা দিলেন কাউন্সিল অফ এডুকেশনের সেক্রেটারির কাছে | সে ইস্তফাপত্র গৃহিত হলো না | বিদ্যাসাগর দ্বিতীয়বার ইস্তফাপত্র দিলেন ২০ এপ্রিল | ইস্তফা গৃহিত হলো ১৬জুলাই | চাকরি ছাড়লেন বিদ্যাসাগর | ১৮৪৭ সালে পঞ্চাশ টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয় |
রসময় দত্ত বললেন : ” বিদ্যাসাগর চাকরি তো ছেড়ে দিল , কিন্তু খাবে কী ? ” ৩ যার কাছে শুনলেন তাকে বিদ্যাসাগর বললেন : ” দত্তমশায়কে বলো , বিদ্যাসাগর আলু পটল বেচে খাবে , মুদির দোকান করে খাবে , কিন্তু যে চাকরিতে সম্মান নেই সে চাকরি করবে না | ” ৪
চাকরি ছাড়ার পর বিদ্যাসাগরের মানসিক স্থিতির পরিচয় নিই | শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন লিখলেন : ” কর্ম্ম ত্যাগ করিয়া অগ্রজের কিছুমাত্র মানসিক কষ্ট হইল না | তৎকালে বাসায় নিরুপায় আত্মীয় ও স্বসম্পকীর্য প্রায় ২০টি বালককে অন্নবস্ত্র দিয়া বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করাইতেছিলেন | তন্মধ্যে কাহাকেও বাসা হইতে যাইবার কথা একদিনের জন্যও বলেন না | ” ৫
বিদ্যাসাগর তখন সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক | কোনো এক কারণে বিদ্যাসাগরের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ কার সাহেবের ঘরে যাওয়ার | অবশ্য তিনি জানিয়েই গিয়েছিলেন | ঘরে প্রবেশ করে তিনি দেখলেন সাহেব জুতো শুদ্ধ পা টেবিলের উপর তুলে বসে আছেন | শুধু কী তাই সাহেব তাঁকে একবারও বসতে বললেন না | বিদ্যাসাগরও ছাড়বার পাত্র নয় | তিনিও সুযোগ খুঁজছিলেন | সেই সুযোগ একদিন এসে গেল | কী একটা কারণে কার সাহেবকে আসতে হলো সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের কাছে | বিদ্যাসাগরও ঠিক একইভাবে তাঁর চটিশুদ্ধ পা টেবিলের উপর তুলে ধরে তামাক খাচ্ছিলেন | এতে কার সাহেব অত্যন্ত অপমান বোধ করলেন | তিনি বিদ্যাসাগরের নামে শিক্ষা পরিষদের কাছে নালিশ জানালেন | সংস্কৃত কলেজের সম্পাদক নাকি সাধারণ ভদ্রতাও জানেন না | ডঃ মোয়াট বিদ্যাসাগরের কাছে কৈফিয়ৎ তলব করলেন | উত্তরে বিদ্যাসাগর উপযুক্ত জবাবই দিলেন | বললেন : ” My notions of refined manner being thus formed from the conduct of an enlightened and civilised European , I behaved myself as respectfully towards him as he had himself done .”
সন্তোষ কুমার অধিকারী এর বাংলা তর্জমা করেছেন ,” ব্যবহারের শালীনতা সম্পর্কে আমার ধারণা একজন সভ্য ও আলোক প্রাপ্ত ইউরোপীয় ভদ্রলোকের কাছ থেকেই আমি পেয়েছি | আমায় তিনি যে ব্যবহারে অভ্যর্থনা করেছিলেন , আমিও ঠিক সেই ব্যবহারেই তাঁকে আপ্যায়িত করেছি | “