: আমি রিনির কাছে গেলাম।
: ডেকেছে যখন যাবিই তো। তোকে প্রেম প্রস্তাব দিয়েছে নিশ্চয়। এবার সুরমার কাছ থেকে নৌকা অন্য ঘাটে লাগা।
: আরে ধুর! কী যে বলেন…..।
: তাহলে কী হয়েছে?
: রিনি বলল, হেলাল ভাইয়ের চিঠি পাওয়ার পর থেকেই তাকে লক্ষ্য করতে থাকি। তার ভাঙা চোয়াল, খোচা খোচা দাড়ি, লম্বার চুল, আমাকে মুগ্ধ করে দেয়। তাকে যতই দেখি ততই মুগ্ধ হই। রিনিকে বাজিয়ে দেখার জন্য আমি বললাম-ভাঙা চোয়াল যে কাউকে মুগ্ধ করে আগে তা শুনি নাই। রিনি বলল-শুনবা কিভাবে? তোমার নিজের তো তবলা তবলা গাল। শোন, চুল আর দাড়ি আর একটু বড় হলে হেলাল ভাই নির্মলেন্দু গুণের ফটোকপি হয়ে যেত। কি যে রোমান্টিক একজন মানুষ হেলাল ভাই! তখন আমি বললাম-সবই বুঝলাম। তারপর বলো, আগে বাড়ো। রিনি বলল-সৈয়দা নার্গিস জাহানের কাছ থেকে শুনেছি হেলাল ভাইয়ের আবৃত্তি তুলনাহীন। আমি বললাম-কথার ল্যাঞ্জা বাড়ায়া লাভ নাই। আসল কথায় যাও। রিনি বলল-আমি হেলাল ভাইকে ভালবাসি। আই লাভ হেলাল ভাই। আই লাভ হেলাল ভাই ভেরি মাচ। তোমরা তো হেলাল ভাইয়ের ল্যাঞ্জা ধরে থাকো। এই চিঠিটা হেলাল ভাইকে দিবা। আমি লিখে রেখেছি। দিস ইজ এ্যা লাভ লেটার। ফার্স্ট লাভ লেটার ইন মাই লাইফ।
এতক্ষণে আমরা দম ফিরে পেলাম। তার মানে হেলাল ভাইয়ের প্রেম প্রস্তাবপত্র স্বার্থক। একটা সাড়া মিলেছে।
গাব্বু বলল: এত সুন্দর চিঠি আমি আর জীবনে পড়ি নাই। জীবনে যদি প্রেম করি তো চিঠির মাধ্যমেই প্রেম করব। যে মেয়ে প্রেমপত্র লিখতে পারবে না, সে যদি বিউটি কুইন এঞ্জেলিনা জোলি হয় তবুও তার সাথে প্রেম করব না।
হেলাল ভাই রেগে উঠল: তার মনে তুই চিঠিটা আগেই পড়েছিস?
: হু।
: অন্যের চিঠ পড়া অপরাধ, তুই তা জানিস না?
: জানি, বাট ধৈর্য্য ধারণ করতে পারি নাই। রিনি মেয়েটাও যেমন সুন্দর চিঠিটাও তেমন…..।
: থাপ্পর দিয়ে তোর আক্কেল দাঁত ফেলে দেয়া দরকার। দে’, চিঠি দে’।
গাব্বু পকেট থেকে চিঠি বের করে হেলাল ভাইয়ের হাতে দিল। হলুদ কাগজে লেখা চিঠি। সাধারণত হলুদ খামে সাদা পাতায় কালো কালির লেখা চিঠি আসে। এখানে চিঠির পাতাটাই হলুদ। কী কালিতে লিখেছে কে জানে।
চিঠিটা হাতে নিয়েই হেলাল ভাই উঠে যেতে উদ্ধত হল। আমি বললাম: হেলাল ভাই, প্রথম চিঠিটা আমাদের সামনে পড়তে হবে।
হেলাল ভাই লজ্জিত কন্ঠে বলল: আশ্চার্য! সেটা কী করে সম্ভব?
: গাব্বু তো আগেই চিঠিটা পড়ে ফেলেছে। এখন আমাদের না দেখিয়ে আর লাভ কী?
হেলাল ভাই আবার বসল। বলল: তোর কথায় যুক্তি আছে। আচ্ছা, তোরা সবাই মিলে পড়।
চিঠিটা আমি খুললাম। হলুদ কাগজে লাল কালি দিয়ে লিখেছে। হলুদ কাগজের কারণে লাল রঙটা হয়ে গেছে গোলাপি। হেলাল ভাই বল: গোলাপি হল আনন্দের রঙ, ভালবাসারও।
ফাঁকা ফাঁকা শব্দে ঘন অক্ষরে হাতের লেখাটা দেখা মত হয়েছে। কাগজের চারপাশে আবার আলপনাও এঁকেছে। নকশা, ফুল, পাখি, লতা-পাতা এইসব। সব মিলিয়ে পরিপূর্ণ প্রেমের চিঠি হয়ে উঠেছে। বলতে হবে, মেয়েটার শৈল্পিক হাত আছে।
গাব্বু বলল: একাডেমিতে ছবি আঁকা শেখে তো।
ফজা বলল: ফোনের প্রেম একটা ফালতু ব্যাপার। তুমি কই? মিস ইউ। এইসব কোনো প্রেমের শব্দ?
রান্টু বলল: হেলাল ভাইয়ের কারণেই প্রতি মুহূর্তে আমাদের নতুন করে একটা চোখ খুলে যাচ্ছে। একযোগে বায়ান্নটা মেয়েকে প্রেম প্রস্তাব দেয়া যায় এটা তো আমাদের কল্পনার অগোচরে ছিল।
গুল্লু বলল: অনেক প্রেমের চিঠি বা সাধারণ চিঠিই কিন্তু কালজয়ী সাহিত্য হয়ে আছে। সেলফোনের কারণে চিঠি উঠে গেছে। চিঠি সাহিত্যও উঠে গেছে। সাহিত্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক মার খেয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রের কথাই ভাব।
হেলাল ভাই হাত উচু করে সবাইকে চুপ করার নির্দেশ দিল। বলল: প্রথমে চিঠির ব্যাপারে তোদের কিন্তু বিশেষ আগ্রহ ছিল না। বলেছিলি-এ যুগে কেউ……।
: আমরা তো যুগের তালে নাচি। আপনিই যুগকে নাচাতে পারেন।
: ঠিক আছে, এবার চিঠিটা কেউ একজন পড়।
: আপনার চমৎকার আবৃত্তির কন্ঠ। আপনিই পড়ুন, আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনি। বলল গুল্লু।
: না না, তোদের মধ্যে থেকেই কাউকে পড়তে হবে। আমি শুনব।
হেলাল ভাই দেয়ালে ঠেস দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসল। চোখ বন্ধ করল। আমি চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম-
প্রিয় হেলাল ভাই//
আমার হৃদয়ের অকুন্ঠ ভালোবাসা নিবেদন করছি আপনাকে। আপনার চিঠি পাবার পর থেকে আমার মনটা ভীষণ আনচান আনচান করছে। আপনাকে যতই দেখছি, আপনার সম্পর্কে যতই জানছি ততই আপনার প্রতি আমার ভালবাসা দূরন্ত হয়ে যাচ্ছে। মেঘ যেমন ছুটে আসে পৃথিবীর দিকে। বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে পৃথিবীর বুকে। তেমনি দূরন্ত মেঘের মতই আমি ছুটে যাচ্ছি আপনার দিকে। কণা কণা হয়ে ছড়িয়ে পড়তে চাচ্ছি আপনার হৃদয়ে। ধরণীর বুকে লুটিয়ে পড়তে মেঘের কোনো বাঁধা নেই। কিন্তু স্বশরীরে আপনার কাছে ছুটে যেতে আমার আছে অনেক বাঁধা। সব বাঁধাই এক সময় আমি ভেঙে ফেলব, টুকরো টুকরো করে কাঁচের মতো ছড়িয়ে ফলব। আপনি হয়ত জানেন না, আমার হৃদয় আপনার পাশে বসে থাকে মোজাফ্ফরের চায়ের দোকানে। আপনার গায়ে ঠেস দিয়ে বসে থাকে আপনারই মুখ পানে চেয়ে। আপনার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমায় নিশুতি রাতে। আপনি এসব কিছুই জানেন না। হয়ত একটা চিঠি লিখেই সব ভুলে গেছেন। এক দঙ্গল বাজে ছেলে নিয়ে বসে থাকেন, চা-সিঙ্গারা খান, আর টকটক ঢেকুর তোলেন।
এই পর্যন্ত পড়তেই ফজা বলল: আমাদেরকে বাজে ছেলে বলেছে। হেলাল ভাইয়ের চিঠি তো আমরাই ওর কাছে পৌছে দিয়েছি। আমরা ছাড়া হেলাল ভাইয়ের সাথে ওর যোগাযোগের উপায় আছে?
হেলাল ভাই বলল: আপাতত অবজেকশন ছিকায় তুলে রাখ। পরে ভুল-ক্রটি ঠিক করা হবে। এই পড়তো, কি হৃদয় আবিষ্ঠ করা ভাষা!
আমি আবার পড়তে লাগলাম-
প্রিয় হেলাল ভাই, যদিও আজ ‘ভাই’ শব্দটা ব্যবহার করছি, এরপর থেকে আর সেটা করব না। তখন সম্বোধন হবে শুধুই ‘প্রিয়তম আমার’। আপনি আপনার চিঠিতে আমাকে ‘সুরঞ্জনা’ নামে সম্বোধন করেছেন। ‘সুরঞ্জনা’ নামটা সুন্দর। তবু এই সম্বোধন আমি চাই না। কেননা, সুরঞ্জনা কবিকে রেখে অন্য যুবকের কাছে যায়। কিন্তু আমি আপনাকে ছেড়ে আর কোনো যুবকের কাছে যেতে পারবো না। হাজার বছর পথ হেঁটে এসে আপনি শুধু আমার কাছেই দু’দণ্ড শান্তি পাবেন। সিংহল সমুদ্র আর মালয় সাগর পারি দিয়ে এসে আপনি আমার মুখপানে চেয়ে ক্লান্তি দূর করতে পারবেন। বিম্বিসার অশোখের ধুসর জগত পেরিয়ে এসে আপনি আমার কাছেই সব ক্লান্তির অবসান পাবেন। আপনার কোটরাগত ফ্যাকাশে চোখ থেকে সফেন সমুদ্র মুছে ফেলে আপনি যখন আমার মুখে তাকাবেন, আমার মুখ মনে হবে শ্রাবস্তির কারুকার্য শোভিত। আমার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে আপনার মনে হবে. এ তো চুল নয়, এ যেন অন্ধকার বিদিশান নিশা। তাই, পরের চিঠিগুলোতে আপনি আমাকে বনলতা বলে সম্বোধন করবেন। আমি আপনার বনলতা সেন।
প্রিয় হেলাল ভাই, আপনি দার্শনিক মানুষ। জানি, প্রেমের দর্শন আপনাকে শেখাতে হবে না। তাই সে পথে যাচ্ছি না। অনেক কিছুই লিখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু প্রথম চিঠিতেই সব কথা বলে দেয়া ঠিক না। কিছু রেখে দিতে হয়। তাই মনকে প্রবোধ দিচ্ছি, হাতকে টেনে ধরছি। আপনার পরবর্তী চিঠির প্রত্যাশায়-
ইতি//
আপনার বনলতা সেন।
পুনশ্চঃ শুধু চিঠিতে আমি তুষ্ট থাকতে চাই না। খুব শীঘ্রই আপনার সাথে আমি দেখা করতে চাই। আপনার পাশে বসতে চাই। আপনার হাতে হাত রাখতে চাই। আপনার চোখে চোখ রেখে ভাষাহীন কন্ঠে অসংখ্য কথা বলতে চাই। আপনার ঠোঁটের নিকোটিনের বিশ্রী গন্ধ শুষে নিতে চাই। যাহোক, আপনার প্রতি আমার উপদেশ, আপনি ঐ বাজে ছেলেদের খুব বেশি পাত্তা দিবেন না।
পড়া শেষ হল। আমি থামলাম। তাকালাম সবার মুখে। সবাই স্তব্ধ। কেউ কিছুই বলে না। আমি এক গ্লাস পানি খেলাম। পড়তে পড়তে গলাটা একটু শুকিয়েও গিয়েছিল।
নীরবতা ভাঙলো মফিজ। বলল: এই মেয়ের সাহিত্য নিয়ে পড়া উচিত হবে। এ বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে পারবে। চিঠিটা অসাধারণ। তবে এক চিঠিতে দুইবার আমাদেরকে বাজে ছেলে বলেছে। হেলাল ভাই, এর একটা বিহিত না করে আপনি ওর সাথে প্রেম করতে পারবেন না।
হেলাল ভাই আধশোয়া থেকে সোজা হয়ে বসল। বলল: পুনশ্চতে গিয়ে শেষ লাইনের আগের লাইনটা কী লিখল দেখেছিস? বিপজ্জনক মেয়ে।
মফিজ বলল: বিপজ্জনকের কী আছে? প্রেম থাকবে চুমু থাকবে না, এটা কোনো কথা হল? কবি শামসুর রাহমান বলেছেন-প্রেম যেখানে আছে, সেখানে শরীর থাকবে। হৃদয় তো শরীরের বাইরের কিছু নয়, ভেতরেরই জিনিশ। যেমন হীরে থেকে যে দ্যুতি বেরোয় সেটাই হল আমাদের হৃদয়ের ব্যাপার, আর সেই প্রস্তরখণ্ডটি হল আমাদের শরীর।
: তুই আমার অন্যতম প্রিয় কবির কথাকে উদাহরণ হিসেবে আনলি! ধন্যবাদ তোকে। তোর নামটা মোফিজ রাখা ঠিক হয়নি। তবে যাই বলিস, তোরা পেকে পাকা পেঁপে হয়ে যাচ্ছিস।
এখন এই চিঠির উত্তর লেখার কথা ভাবেন। দার্শনিক তত্ত্ব দিয়ে চিঠি লেখা যাবে না; সাহিত্য থাকতে হবে।
আর তখনই গাব্বু বলল: চিঠি আরও একটা আছে।
কথাটা যেন আমাদের সবার পিঠে চিকন বেত দিয়ে সপাং করে একটা বাড়ি দিল। আর কার চিঠি? কয়জনের কাছ থেকে প্রেমপত্র এসেছে?