বাদল ঠাকুর ডালের কড়াই নামিয়ে পায়েস বসান উনুনে। রাধামাধব মন্দিরের এই পায়েসের সুখ্যাতি শুধু এই গ্রামেই নয়, আশেপাশের গ্রামগুলোতেও আছে। এই পায়েস টা বাদল ঠাকুরের স্পেশাল আইটেম। কিভাবে উনি কি করেন,কেউ জানেনা। কিন্তু বারো মাস তিরিশ দিন একই স্বাদ। এতোটুকু হেরফের নেই স্বাদে। অবশ্য এর জন্য শ্যামা আর পিয়ালির কৃতিত্বই বোধ হয় সবচেয়ে বেশি। সরকারি বাড়ির গোয়ালে অনেকগুলো গরু আছে। কিন্তু শ্যামা আর পিয়ালির দুধ সবচেয়ে পুরু।মা বলে, একেবারে বটের আঠার মত। সেই দুধ দিয়ে পায়েস রাঁধেন বাদল ঠাকুর।
শ্যামা আর পিয়ালি দুটো গরুকেই দেখেছে সুমনা। কুচকুচে কালো গায়ের রং শ্যামার। গায়ের চামড়া চকচকে, যেন তেল চুঁইয়ে পড়ছে। স্বাস্থ্য ও তেমনি। হঠাৎ করে দেখলে মোষ বলে ভুল হতে পারে। পিয়ালির গায়ের রং হরিণের মত। হরিণ দেখেনি সুমনা, মার মুখে শুনেছে যে, হরিণের গায়ের রং নাকি ঐরকম হলদেটে সোনালী হয়। পিয়ালি অবশ্য শ্যামার মত অত মোটাসোটা নয়। বেশ দোহারা চেহারা। সরকার বাড়ির বড় গিন্নিমার খুব প্রিয় ওই গরু দুটো। কমলাদেবী নিজের হাতে যত্ন করেন ওদের।
আনাজ কাটা শেষ হয়ে গেছে সুমনার। সে বাদল ঠাকুরকে বলে, দাদু, আনাজ কোটা হয়ে গেছে। আর কিছু করতে হবে তো বল।
—– না আর কিছু করতে হবে না। এই ঢের! তা হ্যাঁরে, তোর মার তো অসুখ, সকাল থেকে কিছু খেয়েছিস তুই?
সুমনা চুপ করে থাকে।
বাদল ঠাকুর বলেন, তুই একটু বসতো, আমি এক্ষুনি আসছি। সব খোলা থাকলো, আমি না আসা পর্যন্ত কোত্থাও যাস না কিন্তু।
—-বেশ। আমি ততক্ষনে কোটা আনাজ গুলো ধুয়ে রাখছি।
—– বাঃ! তাহলে তো খুব ভালো হয়।
কোথায় যায় যেন বাদল দাদু। সুমনা কোটা আনাজ গুলো ধুতে থাকে। পায়েসের গন্ধ বেরিয়েছে। আগে সুমনার জন্মদিনে পায়েস রাঁধতো মা। সে অবশ্য ছোটবেলায়। তখনো হারিয়ে যায়নি বাবা। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে গোয়ালপাড়া থেকে দুধ নিয়ে আসতো বাবা। বাড়ি ফিরে দুধ ভরতি ঘটিটা মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতো, এই নাও, কানু গোয়ালার বাড়ি থেকে নিয়ে এলাম। একেবারে খাঁটি দুধ। জমিয়ে পায়েস রেঁধো আজ।
মা একগাল হেসে বলতো, ও বাবা, সুমির জন্মদিন মনে আছে তোমার! আমি তো ভাবলাম, সকালে উঠে তোমাকে দুধ আনতে বলবো গয়লা পাড়া থেকে।তা ঘুম ভেঙে দেখি, তুমি নেই। সুমি বলল যে, তুমি বেরিয়েছ।
—— হ্যাঁ। আমার সুমি মায়ের জন্মদিন আমি ভুলে যাব ,তুমি এটা ভাবলে কি করে?
—–বেশ বেশ। মেয়ে সোহাগী বাপ। দুধ তো আনলে, কিন্তু মাছ?
—— কোন চিন্তা করোনা, আমি জেলেপাড়ায় গিয়ে লাট্টু কে বলে এসেছি। ও মাছ ধরলেই মাছ দিয়ে যাবে। বড় মাছ দিতে বলেছি, যদি দেয়, মাথাটা দিয়ে একটু মুড়িঘন্ট কোরোতো।
—- আচ্ছা।
বাবা হারিয়ে যাবার পর থেকে সেভাবে আর জন্মদিন পালন হয় না সুমনার। মা শুধু বাতাসা দিয়ে ক্ষ্যাপা কালির থানে সুমনার নামে পুজো দিয়ে আসে। বাড়ি ফিরে মা কালীর পুষ্প সুমনার মাথায় ঠেকিয়ে দিয়ে হাতে প্রসাদ দেয়।
সুমনা দেখেছে, মায়ের দুচোখ বেয়ে তখন নিঃশব্দে জল ঝরে পড়ে।
আনাজ ধুতে ধুতে সুমনার চোখ দুটো ও জলে ভরে যায়। বাবার কথা খুব মনে পড়ে তার। বাঁ হাতের চেটোর পিছন দিক দিয়ে চোখের জল মোছে সুমনা।
ফিরে আসেন বাদল ঠাকুর। সুমনাকে বলেন, আনাজ গুলো রেখে দে ,পরে ধুবি।হাতটা ধুয়ে আমার কাছে আয় দেখি একবার।
সুমনা কাছে যেতেই বাদল ঠাকুর ওর হাতে নানা রকম ফলের টুকরো, বাতাসা , ছানার মন্ডা ইত্যাদি দিয়ে বলেন, চট করে এটা খেয়ে নে দেখি।
সুমনা বোঝে, এটা সকাল বেলায় রাধামাধব কে স্নান করানোর পরে যে ফল মিষ্টির ভোগ দেওয়া হয়,সেই প্রসাদ। সরকার বাড়িতে খুব নিয়ম রীতি শৃঙ্খলা মেনে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাধা মাধবের পূজা, আরতি, ভোগ ইত্যাদি হয়।
সুমনা প্রসাদ টা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে বাদল ঠাকুর বলেন, প্রসাদ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? খেয়ে নে।
—- একটা কাগজের ঠোঙা বা এক টুকরো শালপাতা হবে গো দাদু?
—– কেন, কি করবি?
—– মায়ের জন্য একটু প্রসাদ নিয়ে যেতাম।
—- ওই সামান্য প্রসাদটুকু আবার বাড়িতে নিবি কি করে ? তুই ঠাকুরদালানে গিয়ে একটু অপেক্ষা কর । আমি রান্নাটা সেরে ঠাকুরের ভোগ দেবো। ঠাকুরের অন্নভোগ হয়ে গেলে আমি তোকে প্রসাদ দেবো, বাড়িতে নিয়ে যাস মার জন্য।
সুমনা ঘাড় কাত করে। আবার চোখ জলে ভরে যায় তার।