লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলো আদিত্য। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে টেরেসের রেলিং-এর ওপর একটা একটা করে প্রদীপ সাজাচ্ছে গুরপ্রীত আর পাম্মি। আদিত্যকে দেখে পিতা-পুত্রী দুজনেই হেসে হাত নাড়িয়ে সৌজন্যতা দেখালো। আদিত্যর মনে পড়ে গেল করোনা ভাইরাসের কারনে আজ ‘অকাল দিওয়ালী’, আজ সন্ধ্যায় সারা দেশের মানুষ একসাথে ঘরের আলো নিভিয়ে বাইরে আলো জ্বালবে। মোমবাতি, প্রদীপ, মোবাইলের টর্চ এই লকডাউনের বাজারে হাতের কাছে যে যেটা পাবে সেটা দিয়েই কাজ চালাবে, মানে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজস্ব আলোর সাথে আলোকচিত্র পোষ্ট করবে। সুরভিও তাই শো-কেস থেকে বাহারি টি-লাইট ক্যান্ডেল হোল্ডারটা বের করে বেশ কয়েকটা ছোট ছোট সুগন্ধি মোমবাতি দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। আজ সন্ধ্যায় জ্বালাবে। আর আজও আবার একটা নতুন কিছু করে সুরভিকে তাক লাগিয়ে দেবে গুরপ্রীত। আনমনা হয়ে একটা নিমগাছের দিকে তাকালো আদিত্য। আশেপাশের কোনো একটা গাছের ভেতর থেকে কোকিল ডেকে উঠলো, শেষ বসন্তের বিদায়ী ডাক, বড়ো করুণ, বড়ো কঠোর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরের ভেতর ঢুকতে যাচ্ছিল আদিত্য হঠাৎ মাথার ভেতর একটা আইডিয়া চাগাড় দিয়ে উঠল। গুরপ্রীতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আদিত্য ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতর, এগিয়ে গেল কিচেনের দিকে।
“তোমার কাছে খানিকটা কেরোসিন তেল আছে না ?”
প্লেটের ওপর গরম গরম পরোটা আর আচার সাজাচ্ছিল সুরভি, আদিত্যর প্রশ্নে ঘুরে দাঁড়িয়ে একটু বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞেস করল,”এখন আবার কেরোসিন দিয়ে কি করবে ?”
“এখন না, সন্ধ্যাবেলায় ?
“সন্ধ্যাবেলায় ??”, উত্তর শুনে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল সুরভি। আদিত্য কোনো উত্তর দিল না শুধু মুখ টিপে মুচকি হাসল।
কেরোসিন দিয়ে ঘর মুছলে পোকামাকড় কম হয়, সেই ছোটবেলায় মা-ঠাকুমার কাছে শুনেছিল তাই ফাঁকা ফিনাইলের বোতলে খানিকটা কেরোসিন মজুত রাখে সুরভি; কাজের মেয়েকে দিয়ে মাঝে মাঝে মোজাইকের মেঝে মোছানোর জন্য।
পরোটার প্লেটগুলো ডাইনিং টেবিলে রেখে কেরোসিনের বোতলটা বের করে আদিত্যর হাতে ধরিয়ে দিল সুরভি। আদেশের সুরে বলল,”বেশি খরচা কোরো না কিন্তু, এখন শেষ হয়ে গেলে আর আনাতে পারবো না।”, তারপর গলার স্বরে আদর মাখিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি করবে বলো না গো ?”, আদিত্য সরাসরি উত্তর না দিয়ে রহস্যের হাসি হেসে জবাব দিলো,”সন্ধ্যে হলেই দেখতে পাবে ম্যাডাম।”
একটু অন্ধকার হতে না হতেই সবাই নিজেদের আলোক-অস্ত্রের সাথে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে করোনা-অসুরকে বধ করতে, এবার শুধু সাতটা বাজার অপেক্ষা। মুখোমুখি বারান্দায় সপরিবারে প্রস্তুত দুই অসম প্রতিপক্ষ। স্থিতধী হয়ে সঠিক সময় আসার অপেক্ষা করতে লাগলো আদিত্য।
সাতটা বাজতে না বাজতেই চারদিকে অন্ধকার হয়ে গেল, তারপর একে একে জ্বলে উঠতে লাগলো নানা ধরনের আলো। গুরপ্রীত সপরিবারে প্রদীপ জ্বালাচ্ছে। সুরভি জ্বেলে দিয়েছে জুঁইফুলের গন্ধওয়ালা ছোট ছোট পান্না সবুজ রঙের মোমবাতি, রঙিন কাচ ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ছে তাদের হালকা আলো, মৃদু সুগন্ধ। আদিত্যর চারপাশ কৃত্রিম ফুলের সৌরভে সুবাসিত। মোহময় পরিবেশ ছেড়ে ঘরে ঢুকে পড়ল আদিত্য, জিজ্ঞাসু চোখে মা-মেয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে।
একটু পরেই বেরিয়ে এল আদিত্য, হাতে একখানা জ্বলন্ত মশাল। আজ সকালে গুরপ্রীতকে প্রদীপ সাজাতে দেখে এই আইডিয়াটাই খেলে গিয়েছিল আদিত্যর মাথায়; গুরপ্রীতকে পরাস্ত করতে হলে একটা বড়োসড়ো কিছু করতে হবে, আর তাই এই মশালের ব্যাবস্থা। প্লাস্টিকের ডান্ডাওয়ালা একটা পুরোনো ঝাঁটা অনেকদিন ধরেই শু-ক্যাবিনেটের নীচে পড়ে ছিল। আর পুরোনো জামাকাপড়েরও তো অভাব নেই ঘরে। সুরভি বেশ কিছু জামাকাপড় জমিয়ে রাখে ঘর মোছার ন্যাতা করার জন্য। সেই দুটোকেই কাজে লাগিয়ে আজ দুপুরে মা,মেয়ে যখন ঘুমোচ্ছিল তখনই এই মশালটা বানিয়ে ফেলেছে আদিত্য। তারপর আর কি, শুধু কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে নেওয়ার অপেক্ষা।
আদিত্য মশাল হাতে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই আশেপাশের সবার চোখ আটকে গেল ওর দিকে। ঠিকঠাক ঠাওর করতে না পারলেও আদিত্য বেশ ভালোমতোই বুঝতে পারল সবাই অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কয়েকজন অতি উৎসাহী মোবাইল ক্যামেরা তাক করে বন্দী করে ফেলতে চাইলো এই অদ্ভুত দৃশ্যকে। ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে আদিত্যও বেশ কায়দা করে মশালটাকে উঁচু করে ধরে ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’ স্টাইলে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘটনার আকস্মিকতায় গুরপ্রীত বেশ একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল, ধীরে ধীরে সম্বিত ফিরতে সেও নিজের স্মার্ট ফোনটাকে তুলে ধরল আদিত্যর দিকে।
আর কি চাই ? জয়লাভের আনন্দে এক গাল পরিতৃপ্তির হাসি হেসে সুরভির কাঁধে হাত রাখলো আদিত্য।
করোনা ভাইরাসের জন্য আজ আবার সব দেশবাসী একজোট হয়েছে; প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সন্ধ্যা সাতটা বাজতে না বাজতেই যে যার ঘরের বিজলি বাতি নিভিয়ে দিয়েছে, জ্বেলে নিয়েছে বিকল্প। আশিষের ঘরেও সকাল থেকেই তার তোড়জোড় চলেছে, সন্ধ্যায় সব আলো নিভতেই জ্বলে উঠেছে পিতলের পঞ্চপ্রদীপ, আরতি করার জন্য বরাদ্দ একান্ন প্রদীপ।
নম্রতা একটা সোনালী জরির কাজ করা টকটকে লাল শাড়ি পরে, আরতি করার থালায় কয়েকটা ডিজাইনার প্রদীপ জ্বালিয়ে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল বারান্দায়, ওর সাজপোষাক দেখে মনে হচ্ছিল আজ করভাচৌথ, আশেপাশে কোথাও নজর ছিল না ওর, ও শুধু ভালোবাসা ভরা চোখে তাকিয়ে ছিল আশিষের দিকে। আশিষ অবশ্য নম্রতাকে দেখেও না দেখার ভান করে ছিল, কারন ওর নজর আটকে ছিল অন্য এক জায়গায়। দেবাঙ্গীর ব্যালকনিতে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল দেবাঙ্গীকে এক ঝলক দেখার। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেও আশিষ দেবাঙ্গীর দেখা পেলো না, ও থেকে গেলো বন্ধ দরজার ওপারে, অন্ধকারের অন্তরালে।
কোকিলাবেন রিন্দানী মারা গিয়েছেন শুনে মনে মনে বেশ কিছু ছক কষে নিয়েছিল আশিষ। কোকিলাবেনের একমাত্র ছেলে জিগনেশ বাইরে থাকে, বোধহয় ব্যাঙ্গালোরে। এই লকডাউনের সময় সে কি আর অতো দূর থেকে আসতে পারবে মায়ের শেষকৃত্য করতে? একাকিনী ভগিনীকে সঙ্গ দিতে??
মনটা খুশিতে ভরে উঠেছিল আশিষের। জিগনেশ ব্যাঙ্গালোর থেকে আসতে পারবে না, ধারেকাছে আর কোনো আত্মীয়স্বজনও নেই তার মানে দেবাঙ্গী এখন একেবারে একা, পুরোপুরি বে-সাহারা। এটাই তো উপযুক্ত সময়, ওর কাছাকাছি যাওয়ার, ঘনিষ্ঠ হওয়ার। সেই হাততালি দেওয়ার দিন ঘরোয়া পোষাকে দেবাঙ্গীকে দেখার পর থেকেই আশিষের মনটা বড়ো উচাটন হয়ে আছে। দেবাঙ্গী আর আগের মতো রোগাপটকা নেই, এখন ওর ভরা শরীর, ভরন্ত নারীত্ব উপছে পড়ছে পোষাক ভেদ করে। অজান্তেই আশিষের হাতটা চলে গিয়েছিল শর্টসের ঠিক মাঝখানে, সেলাই বরাবর।
অনেক আশা নিয়ে বাবা-মায়ের সাথে আশিষ পৌঁছে গিয়েছিল কোকিলাবেন রিন্দানীর মৃতদেহ দেখতে। ঠিক করেছিল ভিড় একটু পাতলা হলেই দেবাঙ্গীর কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করবে; সহানুভূতি দেখানোর নাম করে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দেবে, সবার অগোচরে হাত রাখবে ওর নরম বুকে, প্রথমে সেই আগের মতোই হালকা একটু চাপ দেবে তারপর প্রাণভরে মিটিয়ে নেবে অনেকদিনের জমে থাকা সাধ। মায়ের মৃত্যুশোকে পাগলপারা নিঃসঙ্গ দেবাঙ্গী কি পারবে ওকে বাধা দিতে? না,ইচ্ছে থাকলেও ওর ওই বুনো ষাঁড়ের মতো জিদকে কিছুতেই দমন করতে পারবে না দেবাঙ্গী।