স্টুডিওতে আগুন লেগেছে শুনে বিতানকে ডেকে সেখানে গেলাম। ভাবলাম সেখানে গিয়ে অবস্থা বুঝে গুলেদাকে একটা ফোন করব। গিয়ে দেখি সাংঘাতিক অবস্থা। যারা প্রথম থেকে দেখেছে তারা জানাল আগুনের লেলিহান শিখা ফ্লোরের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই আগুনের মাঝখানে নায়িকা। সে বারবার চেষ্টা করছে বেরুতে। পারছে না। যে দিকে বেরুবার জন্য ছুটে যাচ্ছে সেদিকেই আগুন দিয়ে ঘেরা।
দমকল যখন এল তখন আর কিছু করার ছিল না। নায়িকাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মনে হচ্ছে কোনো লাভ হবে না। সুন্দরী নায়িকাকে বোধহয় আর বাঁচান গেল না।
লোকে লোকারণ্য। তার মধ্যেই গুলদার দেখা পেলাম।
বললাম, ‘তুমি এসে গেছ?’
সব একবারে পুড়ে খাক। ছ’মাস ধরে শুটিং চলছে। শুনলাম টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখান শুরু হয়ে গেছে। কবে সিরিয়াল শুরু হবে তা এখনও জানায়নি।
গুলেদাকে দেখলাম খুবই বিপর্যস্ত অবস্থা। বহুদিন আমাদের সঙ্গে দেখা নেই। গুলেদাকে কোনদিন সিনেমা সিরিয়ালের ত্রিসীমানায় আমরা দেখিনি। ভাবলাম গুলেদা বোধহয় সামাজিক দায় পালনের জন্য এখানে এসেছে।
বললাম, ‘তুমি আমাদের তো একটা খবর দিতে পারতে।’
আমার মাথার ঠিক নাই রে। আমি তো এইহানে ছয়মাস ধইরা সকাল দশটা থিকা রাইত দশটা পর্যন্ত
বিতান বলল, ‘ও তাই তোমাকে বহুদিন দেখতে পাইনি।’
‘একবার তো খোঁজ খবর নেওয়ারও প্রেয়োজন মনে করস নাই। তগো গুলেদা আছে না মরছে।’
বললাম, ‘তুমি এই স্টুডিও পাড়ায় সারাদিন থাক কেন? এখানে তোমার কি দরকার?’
‘এহানে আমারেই তো দরকার। যে সিরিয়ালডা হইতে আছিল হেইয়ার কাহিনীডা তো আমারই লেহা।’
‘তুমি সিরিয়ালের কাহিনী লিখছ?’ কথাটা বলে বিতানের মুখটা হাঁ হয়ে রইল। আমি ইশারায় বন্ধ করতে বললাম।
‘ক্যান আমি ল্যাখতে পারি না?’
আমতা আমতা করে বললাম, ‘আসলে তোমার মুখ থেকে এসব কথা তো কোনোদিন শুনিনি।’
‘আরে আমিও কি ভাবছিলাম যে লিহুম। সব তগো বউদির জন্য। এহন বাধ্য হইয়া ফ্যারে পইড়া গেছি।’
‘কেন! বউদি কি বায়না ধরেছে যে তোমার লেখা সিরিয়াল ছাড়া দেখবে না?’
‘না না। তগো বউদির আর আমার কোনো ব্যাপারেই ইন্টারেস্ট নাই। হে কেবল টিভির সামনে বইয়া একবার এই সিরিয়াল আর একবার ওই সিরিয়াল এই করতে থাহে। কথা তো কয়ই না। এক কাপ চা দেওয়ার কথাও মনে থাহে না।একদিন নজর কইরা দেখলাম হে দ্যাহেটা কি। তহন মনে হইল এ তো আমিও ল্যাখতে পারি। আমার কাছে কোনো ব্যাপার না। আমার ছোডো ভায়রাভাই ফোন করল। হেডারও খুব খারাপ অবস্থা। আমার ছোটো শালী তো আরেক কাঠি উপরে। সিরিয়ালগুলি তো দেহেই এইয়ার লগে নাচ, গান, রান্না কিছুই বাদ দেয় না।
বিতান বলল, ‘সব বাড়িতেই এখন একই অবস্থা।’
গুলেদা বলল, ‘ছোডো ভায়রা ভাইরে কইলাম এই তো ছাতার গল্প। ও আমিও পারি। বানাইয়া বানাইয়া একডা গল্প কইতে গেছি কিছুডা শুননাই আমারে কইল, দাদা কাইল আমার লগে দেহা করেন।’
‘তারপর?’ জানতে চাইলাম।
‘হে আমারে লইয়া গেল ফান্টূসলালের কাছে । আমার পিডে একটা গোত্তা মাইরা কইল কাইল যে গল্পডা কইতে আছিলাম হেইডা তহন কইতে।’
‘গল্প বললেন?’ বিতান বলল।
‘না কইয়া উপায় আছে। সামনে কাজুবাদামের প্লেট। খাই আর গল্প কইয়া যাই। গল্প য্যান ভুড় ভুড় কইরা বাইরাইতে লাগল আমার মুখ দিয়া । দেহি আমি আর থামতে পারতাছি না। একসময় ফান্টূসলালই আমারে বাঁচাইল। থামাইয়া কইল, আপনি জমাইয়া দিছেন। লিখা যাইতে কইল। কইল একমাস বাদে শুটিং শুরু করবে।’
একটু থেমে গুলেদা বলল, ‘আমি হেই দিনই বুঝলাম যে আমার কপাল পোড়ছে।’
চারদিকে লোকজন সবাই কথা বলে যাচ্ছে। দমকলের লোকজন, পুলিশ, মিডিয়ার লোকজন যাকে সামনে পাচ্ছে নানা কথা জিজ্ঞাসা করছে।
আমি বললাম, ‘চল গুলেদা। আমরা ওই ফাঁকা আয়গায় গিয়ে দাঁড়াই।’
বিতান বলল, ‘ওই যে ফান্টুসলালের কথা বললে উনি কে?’
‘উনিই তো সব। প্রোডিউসার। ভালো গল্প খোঁজতে আছিল। আমার ছোড ভায়রা ভাই আমারে নিয়া সেহানে ফেলাইল।’
বিতান লাফিয়ে উঠল। বলল, ‘এত বড়ো একটা খবর আমরা জানি না! আমাদের বললে না?’
‘তোগো যে কমু কিন্তু সময়ডা পাইলাম কই। সেইদিন থিকাই তো গাধার খাটনি। আমি খালি লিখতাছি আর লিখতেছি। একদিন তগোও কিন্তু আমার লগে লিখতে হইত। হুনছি অনেকে নাকি লেহার জন্য লোক রাহে। হে এক লাইন কয় তহন অন্য সবাই হেইডারে একশো লাইন বানাইয়া ফ্যালে। নয় বছর টানা এই সিরিয়াল চালাইয়া যাইতে গেলে আমি একা লিখা কুলাইতে পারুম না।’
বললাম, ‘নায়িকার যা অবস্থা হয়েছে শুনলাম তাতে কি এই সিরিয়াল আর হবে?’
‘আমিও হেইয়াই ভাবতাছি। ফান্টুসলাল আমারে একলাখ টাকা অ্যাডভান্স দিছে। এই টাহাডা হ্যারে ফেরত দিয়া আসুম। আমার আর সিরিয়াল লেহায় কাম নাই। আমার মাইয়াডার লেইগা দুক্কু লাগে। জীবনের শুরুতেই এইরকম হইল ভাবা যায় না।’
বিতান বলল, ‘কি নিয়ে লিখলে জানতে ইচ্ছে করছে।’
বললাম, ‘এখন কি গল্প শোনার সময়?’
গুলেদা দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলল, ‘কাহিনীডা নায়িকারে লইয়া। ছোডবেলায় পরিচিত একজন নায়ক আছে। তহন হেই নায়ক খুব গরিব আছিল। তহন নায়িকা তারে পাত্তা দেয় নাই। সে ভালো কইরা লেহাপড়া কইরা আমেরিকা গিয়া সেহান থিকা ধনী হইয়া যহন দ্যাশে আইল তহন নায়িকার লগে দেহা। এদিকে নায়কের কলেজের বান্ধবীর আইসা হাজির। নায়ক আবার আমেরিকায় সুসিরে কথা দিয়া রাখছে। এই নিয়া এমনই অবস্থা যে হেইয়ার জট দুই বছর টানা সিরিয়াল চললেও কিছুতেই ছাড়ান যাইব না। এইবার হইল দুই নম্বর নায়ক। হে হইল গিয়া কলেজের বন্ধু ছিল। রোজই নায়িকার পিছনে ঘুর ঘুর করে। হেই পোলাডার মায় আবার হ্যার এক বান্ধবীর মাইয়ারে পছন্দ কইরা রাখছে। সেই মাইয়াডা আবার ভালোবাসে এক রাজনীতি করা নেতারে।
তিন নম্বর নায়ক হইল নায়িকার অফিসের সহকর্মী। সে নায়িকার মায়ের খুব প্রিয়পাত্র। নায়িকার মা হ্যারে হবু জামাই ভাইবা জামাইষষ্ঠীর দিন ভালো মন্দ খাওয়ায়। আপাতত এই।’
বিতান বলল, ‘তোমার গল্পে কোনো ভিলেন নেই?’
‘নাই আবার। ভিলেন না থাকলে ফান্টুসলালের আমার কাহিনী পছন্দই হইত না। ভিলেন নায়িকার কলেজের যাতায়াতের পথে বাইক চালাইয়া বাপের পয়সায় ত্যাল খরচ করত। এহন কয়লা,বালি,মাটি পাচার কইরা সমাজে বেশ প্রতিষ্ঠা পাইছে।’
আপাতত এই একজন নায়িকার তিনজন নায়ক। একজন ভিলেন। তিন বছর পরে দেহা যাইবে একজন নায়কের তিনজন কইরা বান্ধবী। প্রথম জন মাদক পাচার করতে গিয়া ধরা পড়বে,দ্বিতীয় জন ফ্যাশন ডিজাইনার। তৃতীয়জন কলেজের অধ্যাপিকা। হে আবার নায়িকার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী।’
আমি বললাম, ‘গুলেদা তোমার গল্প অন্য সময় শুনব। মনে হচ্ছে এখানে থাকা যাবে না। ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে মনে হয় আমাদের দিকে আসছে।’
‘আউক না।অত ঘাবড়াইবার কী আছে?’
বিতান বলল, ‘তোমার এই গল্প যদি অন্য কেউ চুরি করে?’
‘অত্ত সোজা না। একটা অনলাইন কাগজে কাহিনীর সারবস্তু এক লাইন কইরা লিখছি। যদি নকল করে তাইলে মামলা করুম। পাঁচকোটি টাহার। মামলার খরচ দেবে ফান্টুসলাল। কথা হইয়া আছে।’
ক্যামেরা নিয়ে আমাদের কাছে একজন সাংবাদিক এল।
এসেই বলতে শুরু করল, আমরা হাজির হয়েছি এই সিরিয়ালের লেখক গুরুপদ লেটের কাছে। ডাক নাম গুলেদা। ‘আচ্ছা গুলেদা, এই কাহিনী লেখার কথা আপনার কেন মনে হল?’
গুলেদা বলল, ‘এহন এই ফালতু পাঁচাল পাইড়া আমার মটকা গরম কইরেন না।’
সাংবাদিক বলল, ‘আমরা এখন ছোট একটা বিজ্ঞাপন বিরতিতে যাচ্ছি। কেউ কোথাও যাবেন না। এখনই ফিরে আসছি।’
আমরা চলে যাব ভাবছি তার আগেই সাংবাদিক বলল, ‘ফিরে এলাম একটি বিশেষ খবর নিয়ে। এইমাত্র খবর এল এই সিরিয়ালের নায়িকা হাসপাতালে মারা গেছেন। নব্বই শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় নায়িকাকে অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি। নায়িকার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে শিল্পীমহলে।’
আমরা আবার গুলেদার কাছে যাব। ‘আচ্ছা গুলেদা যখন আগুন লাগে তখন কি আপনি এখানে ছিলেন?’
‘ছিলাম।’
‘আপনি কী দেখলেন? দর্শকরা আপনার কাছে শুনতে চায়।’
‘দ্যাখলাম তিনজন নায়কই নায়িকাকে আগুনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আউগাইয়া যাইতেছে। দেখি একজন আউগগাইলে আরেকজনরে হ্যারে টাইননা পিছনে নিয়া আসে।’
সাংবাদিক বলল, ‘ আপনারা শুনলেন নায়কেরা সকলেই মনে করেছে আমার যা হয় হোক অন্যের যেন কোনো ক্ষতি না হয়।’
‘আচ্ছা গুলেদা এই যে তিনজন নায়ক এদের মধ্যে সম্পর্ক কেমন ছিল?’
‘মোডেও ভালো ছিল না। ওই নায়িকারে নিয়াই তো যত গন্ডগোল। অভিনয় করতে করতে তিনজনই এক্কেবারে প্রেমে হাবুডুবু খাইতে আছিল। কাজ না থাকলেও ফ্লোরে আইয়া বইয়া থাকত।’
সাংবাদিক বলল, ‘তাহলে নায়িকাকে বাঁচাবার জন্য কে এগিয়ে গেল আগুনের মধ্যে?’
‘কেউ না।’গুলেদা বলল।
‘তাহলে?’
গুলেদা বলল, ‘দ্যাখলাম ওই তিনজন নায়কের মধ্যে কে আগে নায়িকার কাছে যাইবো এই নিয়া অগো মধ্যে হাতাহাতি হইতেছিল।’