রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ‘ব্রাহ্মণ’: কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয়
কে ব্রাহ্মণ ?
রবীন্দ্রনাথ ছান্দোগ্য উপনিষদ থেকে চমৎকার একটা গল্প তুলে এনে দিয়েছিলেন আমার ছোটবেলায়।
মায়ের নাম জবালা। ছেলের নাম সত্যকাম। জবালা একক মা। সিঙ্গল মাদার। জবালার ভারি শখ তার ছেলে লেখাপড়া শিখুক । উপনিষদের যুগে মুনি ঋষিদের তপোবনে আশ্রমিক পরিবেশে লেখাপড়া হত। কেবল ব্রাহ্মণের ছিল পড়াশোনার অধিকার।
মায়ের আগ্রহে তেমন একটা আশ্রমে গেল বালক সত্যকাম। সেখানকার গুরুর নাম গৌতম । সত্যকাম ভারি মিষ্টি দেখতে। তার দু চোখে আশ্চর্য পবিত্র সরলতা। গুরুর আশ্রমে গিয়ে সে নিজের পড়াশোনার ইচ্ছের কথা জানালো। নিজের নাম বললো। গুরু জানতে চাইলেন তার পিতৃনাম। সত্যকাম সিঙ্গল মায়ের সন্তান। সে পিতার নাম পাবে কোথায়? জানে না সে নিজ পিতার নাম। সে কথা সহজভবে বললো সে। গুরু তাকে বললেন পিতৃনাম জেনে আসতে। আরো বললেন শুধু ব্রাহ্মণের বেদ পাঠের অধিকার আছে। বালক সত্যকাম মায়ের কাছে ফিরে এসে জানতে চাইলো নিজের পিতৃনাম । এবার জবালা, সিঙ্গল মা টি, একটা অসামান্য কাণ্ড ঘটাবেন। মা হিসেবে নিজের পেশাগত পরিচয় স্পষ্ট করবেন আত্মজের কাছে। বলবেন, তিনি সেই আদিম দেহ ব্যবসার মাধ্যমে অন্নসংগ্রহ করে থাকেন। প্রতি সন্ধ্যায় নিজের গতর খাটিয়ে তাঁকে উপার্জন করে সংসার চালাতে হয় । আজকের পলিটিক্যালি কারেক্ট ভাষায় ‘যৌনকর্মী’।
সত্যকাম তার মাকে জানে। সে সেই কথা অম্লানবদনে গিয়ে গুরু সমীপে বলে। স্কুলে আজকাল যেমন ইঁচড়েপাকা ছোঁড়া দেখা যায়, কোনোকালেই তার অভাব ছিল না বোধ করি। অন্ততঃ গুরু গৌতমের পাঠশালায় তেমন দু চারটি চিজ ছিলই। তারা তো জানে “বহু পরিচর্যা” মানে কি ? গুন গুন করতে লাগলো সমস্ত ঘর। কানে কানে কানাকানি হতে লাগলো “বহু পরিচর্যা” কথাটার ব্যঞ্জনা নিয়ে। যৌনকর্মীর ছেলে , (পড়ুন খানকীর ছেলে ) আবার ইশকুলে পড়বে?
আজকের ভারত বহু ঢোঁক গিলে সিঙ্গল মাদার এর সন্তানের পড়বার অধিকারকে মেনে নিয়েছেন। হ্যাঁ, বহু ঢোঁক গিলে, তারপর। তাও এই সেদিন। গুরু গৌতমের অত দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিল না। তিনি বালক সত্যকামের সত্য কথা বলবার মনের জোর দেখে , বিশেষতঃ তার মধ্য দিয়ে তার জননীর যে সত্যবাদী ছবি ফুটে উঠলো, তাকে সম্ভ্রম জানাতে সত্যকামকে বুকে টেনে নিলেন। বললেন যে সত্যবাদী সেই ব্রাহ্মণ।
সে সব দিন কি একেবারেই গিয়েছে?
সিঙ্গল মাদারহুড একটা বড় জিনিস। ভারতে মেয়েরা এই মর্যাদা পেয়েছেন বহু কষ্টে, বহু সংগ্রামের পর। সন্তানের জন্ম দিতে মাকে যে পরিমাণ কষ্ট করতে হয়, পুরুষটিকে তার এক সহস্রাংশটুকুও করতে হয় না। দশমাস দশদিন ধরে মা গর্ভাবস্থায় থেকে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সন্তানকে পৃথিবীতে আনেন। পুরুষকে এই শারীরিক কষ্ট ও দৈহিক ঝুঁকির ভারবহন করতে হয় না। তাই মা কেন স্বর্গাদপি গরীয়সী, তা সহজেই বুঝতে পারা সম্ভব। মা হলেন জীবন্ত দেবতা। কিন্তু সন্তানের উপর কর্তৃত্ব ও অধিকারের প্রশ্নে আধ্যাত্মিক ভারত রক্তমাংসের মায়ের এই দৈবী উচ্চতাকে পাত্তা দিতে চায় নি। সেখানে পুরুষতন্ত্রের দাপট। পদবিতে বাপের পরিচয়। ওই যে জবালা আত্মজের কাছে নিজের পেশাগত অবস্থানটা তুলে ধরল, জানে, এতে লোকসমাজে নিন্দার ঝুঁকি আছে, তবুও সত্যের খাতিরে সে মা এই ঝুঁকি নিল।
একটা মেয়ে কিন্তু যৌনকর্মী হয়ে জন্মায় না। পাকে প্রকারে তাকে এই পেশায় এনে ফেলা হয়। দীর্ঘদিন ধরেই যৌনকর্মীদের সঙ্গে মিশি। ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব সত্ত্বেও তাঁরা সেই করুণ ইতিহাস তুলে ধরতে চান না। প্রেমের নামে কত মেয়েকে ফুসলে বাড়ি থেকে বের করে এনে বিয়ের খেলা খেলে বেচে দেয় প্রেমিকেরা। বাবারাও মেয়েকে বেচে দিয়েছে, এ ঘটনা হিন্দু ভারত দেখতে পায়। শুধুমাত্র দুটো পেটে খেতে পেয়ে শরীরে বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছায় দেহটাকে প্রতি রাত্রে কাস্টমারের হাতে সঁপে দেয় যে মেয়ে, তার বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাকে অপমান করতে পারব না। অনেকেই সন্তানকে বড় করে তোলার দায়ে এই জীবন কাটিয়ে চলতে বাধ্য হচ্ছে। সবাই তো আত্মহত্যা করতে পারে না। আর আত্মহত্যা কখনোই কোনো যুক্তিসংগত সমাধান নয়। এদের সামাজিক পুনর্বাসন দিতে অনিচ্ছুক হিন্দু ভারত। সেক্যুলার ভারতও সব জড়তা কাটিয়ে এদের মানবিক অধিকার সংরক্ষণ করতে এখনো পর্যন্ত দোদুল্যমান। ভারতের গণিকাপল্লীগুলিতে প্রায় প্রতিদিন মেয়েদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। সভ্যসমাজ কি এদের ভারতীয় হিসেবে গণ্য করবে না?