• Uncategorized
  • 0

গদ্যানুশীলনে সাধন চন্দ্র সৎপথী

আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে

বেলা প্রায় সাড়ে নয়টা। দিকেশের ক্লান্ত পা দুটো অলস ভাবে চাপ দিয়ে চলেছে সাইকেলের প্যাডেলে। সাইকেলটা ভাঙা রাস্তার উপর ঝড় ঝড় শব্দ করতে করতে কোনো রকমে এগিয়ে চলেছে। চেষ্টা করল আরও জোরে প্যাডেলে চাপ দিতে, কিন্তু হাঁটুর নিচে কেমন যেন একটা যন্ত্রণা হচ্ছে।
দিকেশকে সাইকেল চালাতে হয় না বিশেষ একটা।বাজার করতে বা ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ি যেতে ঐ টুকটাক যা চালাতে হয়। অন্য কোথাও যেতে হলে বটতলার মোড়ে দাঁড়ালে বাস, ট্রেকার পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে দু একটা টোটোর দর্শনও পাওয়া যায়। তবে এ রাস্তায় বাস বা ট্রেকারের সংখ্যা অনেক কম।
আজ সকালের টিউশনিটা একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। স্নানটান সেরে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।
পঞ্চাদার চা দোকানের দেওয়ালে ঠেসিয়ে রেখেওছিল সাইকেলটা। বাইরে কোথাও যেতে হলে সাইকেলটা ওখানেই রাখে।
বলেছিল -“সাইকেলটা রইল হে ,পঞ্চাদা- আমি আসছি।”
পঞ্চাদা জানতে চেয়েছিল-” বাইরে কোথাও যেতে হবে নাকি?”
-” হ্যাঁ,এই আটটার বাসটায়..”
কথা শেষ হওয়ার আগেই পঞ্চাদা শুকনো মুখে জানিয়েছিল-” বাস এখন বেশ কিছু দিন আসবে না।করোনার ভয়ে লোকজন বাসে উঠতে চাইছে না।গতকাল বলছিল-‘একেবারেই প্যাসেজার হচ্ছে না-লস হচ্ছে’।আর ওই একই কারণে ট্রেকারও পাবে কিনা সন্দেহ আছে।দেখছো না আমার দোকানের খদ্দেরও কেমন কমে গেছে।কী করে যে দিন চলবে জানি না।”
গলায় ঝুলতে থাকা মাস্কটাকে তুলে মুখটা বন্ধ করেছিল পঞ্চাদা।
দিকেশ মিনিট কয়েক ভেবেছিল। দোকানের দেওয়ালের নিরাপদ আশ্রয় থেকে সাইকেলটা বের করে নিয়েছিল। মাস্কটা ঠিক করতে করতে বলেছিল- “পঞ্চাদা আসছি।”
পিছন থেকে পঞ্চাদার গলা শুনতে পেয়েছিল-“কী এমন এমারজেন্সি কাজ! সাইকেল চালিয়ে…”
পঞ্চাদার কথা পিছনে পড়ে রইল।
এখন কথার উত্তর দিতে গেলেই পঞ্চাদা বলবে ‘তুমি সবসময় ওই অকাজ নিয়ে মেতে থাকো! কী হবে ওই সব করে?”
“কী হবে” -কেমন করে পঞ্চাদাকে বোঝাবে?
পঞ্চাদার মতো মানুষ -যাদের কাছে টাকা রোজগারটাই একমাত্র কাজ, কেমন করে বুঝবে এই’ অকাজের’ মর্ম। কেমন করে বোঝানো যাবে টাকা রোজগারটাই জীবনের একমাত্র কাজ নয়; তার বাইরে একটা জগৎ আছে -ভালোলাগার, ভালোবাসার জগৎ।এই জগতটাই তো মানুষের আসল পরিচয়। টাকা কম বেশী রোজগার সকলেই করে, কিন্তু এই ‘অকাজের’ জগতে থাকতে পারে ক’জন!
পঞ্চাদারা কোনোদিনই বুঝবে না যেটা তাদের কাছে ‘অকাজ’ কারও কারও কাছে সেটাই প্রকৃত কাজ।
এতক্ষণ ধরে সাইকেল চালিয়ে দিকেশের হাঁফ ধরে যাচ্ছে।মাস্কে নাক-মুখ ঢাকা থাকার জন্য বাতাসের অভাবে শরীরে কেমন একটা অবসন্ন ভাব এসে গেছে।রাস্তায় তেমন লোকজন নেই দেখে মাস্কটা খুলে ফেলল।ভিজে গেছে মাস্কটা। জামাটাও ঘামে ভিজে গেছে। হাতের ঘাম গড়িয়ে তালুতে এসে পৌঁছে সাইকেলের হ্যান্ডেলের প্রান্তদুটিকে পিচ্ছিল করে তুলছে। চারপাশের বাতাস ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে। মাথার উপরে সূর্য নিজের শক্তি প্রদর্শনের খেলায় মেতে উঠেছে।যেন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে দিকেশকে পৌঁছাতে দেবে না তাঁর ভালোলাগার জগতে।
দিকেশ ভয় পায়না সূর্যের চোখ রাঙানিকে।জানে -এই পথ সহজ নয়, প্রতিমুহূর্তে বাধারা পাহাড় হয়ে দাঁড়ায়। ভয় পেয়ে থেমে গেলে চলবে না।
দিকেশ দেখেছে -কেউ একবারও বলেনি ‘তুমি যা করছ ঠিক করছ, তোমার প্রাণের টানকে উপেক্ষা করো না ;তোমার সৃষ্টিরা হয়তো একদিন পথ দেখাবে মানুষকে।
বরং পঞ্চাদার মতোই সকলে বলে- কি যে অকাজ নিয়ে মেতে থাকো বুঝি না বাপু; আরও দু-চারটে টিউশনি যোগাড় করো- চাকরি চেষ্টা করো- তবে তো বুঝবো কাজের কাজ করছো।তা নয় কবিতা লেখে, গল্প লেখে সময় নষ্ট করছো! গল্প, কবিতা লেখে কী টাকা রোজগার হয়? তাহলে কী পাও ওইসব লেখে!”
দিকেশ কাউকে বোঝাতে যায় না -লেখে কী পাওয়া যায়! বোঝানোর চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই; কেবল কথার পিঠে কথা বাড়বে ,আর আপাত ভালো সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যাবে। তাই কেউ প্রশ্ন করলে বা কৌতুহল প্রকাশ করলে শুধু হেসে বলে -“ভালো লাগে ,তাই-“
প্রশ্নকর্তার দুই চোখ কপালে ওঠে, কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে যায় -তারপর আবার স্বস্থানে ফিরে আসে। মাথা নাড়তে নাড়তে প্রস্থান করে।
এই মাথা নাড়ার অর্থ দিকেশ জানে-অর্থাৎ এ ছেলের দ্বারা কিচ্ছু হবে না।
বাইরের লোকের সঙ্গে বাড়ির সকলেরও ধারণার আশ্চর্য মিল। ভাবে- এছেলের ভবিষ্যৎ ঝরঝরে। সকলের নিস্পৃহ, নিরাসক্ত ভাব প্রতিটি মুহূর্তে অনুভব করে।
অথচ আর পাঁচজনের মতো সবই তো সে করে। টাকা রোজগারের জন্য টিউশন করে, চাকরির চেষ্টা করে, বাজার করে, পরচর্চা পরনিন্দার আসরে অনিচ্ছাসত্ত্বেও যোগ দেয়। তাহলে তাঁর প্রতি এমন নিরাসক্ত ভাব কেন সকলে? সে গল্প, কবিতা লেখে বলে? কিন্তু লেখতে গিয়ে কারো কোনো ক্ষতি তো করেনি! সাধ্যমতো সংসারের দাবি পূরণ করে লেখতে বসে। সবাই যখন ঘুমের দেশে ডুবে যায় তখন দিকেশ ডুবে থাকে নিজের ভালোলাগা আর ভালোবাসার একান্ত আপন জগতে। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে গড়ে তোলে এক একটি চরিত্র। চরিত্রগুলির কোনো কোনোটি বাস্তবেদেখা, কোনোটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক অথবা মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা আবছা অবয়ব থেকে উঠে আসা। একমনে কথা বলে চলে চরিত্রগুলি সঙ্গে। কখনো কখনো মন দিয়ে শোনে ওদের না বলা জীবন কাহিনী।রাত কখন যে ভোর হয়ে যায় বুঝতে পারেনা।
রাত জাগার ফলে শারীরিক কষ্ট হয় ঠিকই,তাও ভালো লাগে- খুব ভাল লাগে নিজের সৃষ্টির আনন্দে মেতে থাকতে। কখনও কোনো পত্রিকায় গল্প প্রকাশিত হলে মনটা আনন্দে বিভোর হয়ে ওঠে। কে প্রশংসা করল বা সমালোচনা করল-ভাবে না এখন। মনের মাঝে বার বার একটা কথাই অনুরণিত হয় ‘আমি পেরেছি- অকাজের জগতে ডুবে থাকতে পেরেছি’।
আনন্দের একটা জোয়ার এসে দিকেশের ক্লান্তি দূর করে দিল। পা দুটো আবার যেন নতুন শক্তি পেল।
আর বেশি দেরি নেই -মাত্র মিনিট কয়েক, তারপরেই পৌঁছে যাবে সেই সব মানুষদের কাছে যারা ‘অকাজের জগতে’ ডুবে থাকতে ভালোবাসেন।
এবড়ো খেবড়ো রাস্তাটা এখানেই শেষ। এরপর মসৃণ- সদ্য সারানো রাস্তা। রাস্তার দুপাশে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া আর শিরিষ গাছ।
কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া ফুলে ফুলে সেজেছে। ডালে ডালে সবুজ কচি পাতা- সবুজ পাতার মাঝে লাল ফুল যেন হাসছে! পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিরিষও হলুদ হয়ে হাসিতে যোগ দিয়েছে। পাখি ডাকছে।
এখন দিকেশের মাথার উপর ছায়ার আবরণ। ফুলে ফুলে সজ্জিত কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ে গেল -ছোটোবেলায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো কবে ফুটবে কৃষ্ণচূড়া ফুল! কৃষ্ণচূড়া ফুল ফোটা মানেই আসছে রবীন্দ্র জয়ন্তী। রবীন্দ্রজয়ন্তী মানেই কবিতা আবৃত্তি, গান, নাটক! কতদিন ধরে চলতো তার মহড়া! তারপর রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিন সকাল থেকে উৎসবের, আনন্দের সীমা পরিসীমা থাকতো না।
দিকেশ ছোটোবেলা থেকেই কেমন যেন একটা টান অনুভব করে রবীন্দ্রনাথের প্রতি। রবীন্দ্রনাথের গল্প, কবিতা ওর খুব প্রিয়। তারপর যত বড়ো হয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রতি টান ততই বেড়েছে।
নিজে উদ্যোগী হয়ে প্রতিবছর পাড়ায় রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করে এসেছে। সকলের স্বতঃস্ফূর্ত সাহায্য সহযোগিতাও পেয়েছে।
গত বছরই প্রথম সেই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছিল।পাড়ায় রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করতে পারেনি।বার বার ডেকেও কারও সাড়া পায়নি।করোনার ভয়ে কেউ যোগ দেয়নি।কচি-কাঁচাদেরও আসতে দেয়নি।খুব মন খারাপ হলেও কারোর উপর রাগ করেনি। কারণ দিকেশ জানে-মৃত্যু ভয় সবচেয়ে বড়ো ভয়। আর কেউই মন প্রাণ এক করে বলতে পারে না-“আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়ো।”
একাই রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেছিল; রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিল।
কিন্তু মনটা কেমন একটা বিষাদে আচ্ছন্ন হয়েছিল।মনে হয়েছিল- একটা মহান কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হলাম।
ক্রমশ করোনার দাপট যতই কমে আসছিল দিকেশের মনটা ততই আনন্দে ভরে উঠছিল-যাক এবছর প্রাণভরে উদযাপন করা যাবে রবীন্দ্রজয়ন্তী। ছোটোদের দিয়ে অভিনয় করানোর জন্য রবীন্দ্রনাথের একটি গল্পের নাট্যরূপও করে রেখেছিল।
কিন্তু যতই রবীন্দ্রজয়ন্তীর সময় এগিয়ে আসতে লাগল ততই করোনার দাপট আবার বাড়তে লাগল। ঠিক সেই গতবছরের মতোই আতঙ্ক।মাস্ক পরা , সামাজিক দূরত্ব তৈরি করা ইত্যাদি ইত্যাদি।
তার মানে এবারও রবীন্দ্র জয়ন্তীতে কোনো অনুষ্ঠান করা যাবে না? আবার সেই একলা ঘরের কোনে নীরবে,নিভৃতে শ্রদ্ধা নিবেদন?
খুব মন খারাপ হয়ে যায় দিকেশের। পঁচিশে বৈশাখের আর তো দেরি নেই।তবে কী..?
মর্মবেদনায় বিদ্ধ হতে হতে পার যায় একটার পর একটা দিন।
হঠাৎ একদিন খবর পায়” রবীন্দ্র স্মরণ ও শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন” এর আয়োজন করেছে “আমরা বাঙালি” সংঘ।কোভিড বিধি মেনেই হবে অনুষ্ঠান। সকাল দশটায় শুরু হবে অনুষ্ঠান।
আজ পঁচিশে বৈশাখ । দিকেশ বেরিয়ে পড়েছে। আজ তাঁকে পৌঁছাতেই হবে প্রাণের ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের কাছে। নিবেদন করতে হবে শ্রদ্ধাঞ্জলি।রবীন্দ্রনাথকে অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করবে স্বরচিত কবিতা পাঠ করে।
দিকেশ শুনতে পায় দূর থেকে ভেসে আসছে রবীন্দ্র সংগীত-“আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে..”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।