১৩০১ সালের ফাল্গুন মাসের বারো তারিখে শিলাইদহে বসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতাটি লেখেন। এই কবিতা লেখার সময়ে রবীন্দ্রনাথ একজন যুবক, বয়স তখন বছর তেত্রিশ, এবং পৈতৃক জমিদারি পরিচালনা করা তাঁর পেশা। সঞ্চয়িতায় এই কবিতাটি ‘চিত্রা’ কাব্যগ্রন্থের ভিতর রাখা হয়েছে। ছাত্রপাঠ্য কথা ও কাহিনীতেও পরবর্তীতে এই কবিতাটি সংকলিত হওয়ায়, ছাত্রাবস্থার পর যাঁরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা বিশেষ পড়েন নি, তাঁরাও এটি সম্বন্ধে অবহিত। রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতাগুলির একটি এই পুরাতন ভৃত্য। সে কারণে আমি ধরে নিচ্ছি, এই কবিতার কাহিনী অংশটি আমার প্রত্যেক পাঠকের কম বেশি মনে আছে। তাই কবিতার সূত্রে সেই সময়কার সমাজের কতকগুলি গভীর সঙ্কটের দিকে আলোকপাত করলে ভাল হবে মনে করছি।
কবিতাটিতে একটি ভদ্র মধ্যবিত্ত পরিবারে একটি ভৃত্যের আর্থিক সামাজিক অবস্থান নিয়ে লেখা হয়েছে। এই কবিতা লেখার সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে একজন জমিদার এবং জমিদার মানেই পরজীবী গোত্রের মানুষ। এই কবিতা লেখার সময়ে, অর্থাৎ ইংরেজি ক্যালেণ্ডারের ফেব্রুয়ারি ২৫, ১৮৯৫ তে ব্রিটিশ সরকার তার ক্ষমতার মধ্যগগনে। স্কট সিভিলিয়ান অ্যালান অকটাভিয়ান হিউমের হাতে যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস স্থাপিত হয়েছে, তার বয়স তখন দশ বৎসর। কংগ্রেসের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন উমেশচন্দ্র বনার্জি। সেটা ১৮৮৫ সালের কথা। আবার ১৮৯২ তে তিনি প্রেসিডেন্ট। ১৮৯৩তে দাদাভাই নৌরোজি প্রেসিডেন্ট হলেন। ১৮৯৪ তে আলফ্রেড ওয়েব এবং ১৮৯৫ তে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন। সে সময় কংগ্রেসের নেতৃত্বে আবেদন নিবেদনের প্রক্রিয়ায় একধরনের স্বাধীনতা অর্জনের প্রক্রিয়া চলছে।
১৮৮৬ তেই চব্বিশ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ গান বেঁধেছেন, “আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না… এ যে নয়নের জল, হতাশের শ্বাস, কলঙ্কের কথা, দরিদ্রের আশ, / এ যে বুক-ফাটা দুখে গুমরিছে বুকে গভীর মরমবেদনা।… এসেছি কি হেথা যশের কাঙালি কথা গেঁথে গেঁথে নিতে করতালি/ মিছে কথা কয়ে, মিছে যশ লয়ে, মিছে কাজে নিশিযাপনা!”
ইতিমধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস ক্যানসারে ভুগে ভুগে অত্যধিক কষ্ট পেয়ে মারা গিয়েছেন। সেটা ১৮৮৬ সাল। ১৮৯১ সালে প্রবল হতাশায় ভুগতে ভুগতে মারা গিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়। ১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে স্বামী বিবেকানন্দ চিকাগোয় গিয়ে “হে আমার আমেরিকাবাসী ভাই ও বোনেরা” বলে বক্তৃতা দিয়ে সারা দুনিয়ার নজর কেড়েছেন। অল্প কয়েকটি মাস আগে ১৮৯৪ সালের এপ্রিল মাসে ছাপ্পান্ন বৎসর বয়সী সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেহরক্ষা করেছেন। এই রকম একটা সময়ে ১৮৯৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতাটির জন্ম।
এই সময়ের বাংলাভূমির নগরজীবনে ভদ্র মধ্যবিত্ত পরিবারে ভৃত্য থাকতই। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁর বাল্যাবস্থায় অত্যন্ত দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হলেও, তিনি যখন নামকরা ব্যক্তি, এবং বিধবা বিবাহ চালু করতে গিয়ে সমাজপতিদের রোষের শিকার, সেই সময় মা ভগবতী দেবী পুত্রের সুরক্ষার জন্য শ্রীমন্ত সর্দার নামে এক লাঠিয়াল দেহরক্ষীর ব্যবস্থা করেছিলেন। রাতে কোনো সভা সমিতি সেরে হয়তো পদব্রজে গ্যাসের আলোয় কলকাতার বাড়িতে ফেরবার সময় সন্দেহজনক লোকেদের দেখলে পণ্ডিত বলতেন, ‘ছিরে, আছিস তো!”
রবীন্দ্রনাথ নিজে বেশ কতকগুলি ঝি চাকরকে নিয়েই জোড়াসাঁকো শিলাইদহে সংসার পরিচালনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের শৈশবে ঠাকুরবাড়িতে অনেকগুলি শিশু একসাথে বড় হচ্ছিলেন। ঠাকুরবাড়ির নিয়মে প্রতিটি শিশু সদস্যের জন্য এক একটি করে চাকর নিয়োগ করা হত।
রবীন্দ্রনাথ চাকর বাকরের হাতেই শৈশবে মানুষ হয়েছেন। এদের কয়েকজনকে তিনি নিজের স্মৃতি কথায় স্থান দিয়ে বাংলা সাহিত্যে পরিচিত করে দিয়ে গিয়েছেন।
দশ বৎসরের বালক রবীন্দ্রনাথের মা সারদা দেবী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে জনৈক ঝি ঘুমন্ত শিশুগুলিকে “ওরে তোদের কী হল রে!” বলে চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে করতে ডাকাডাকি করায় বাড়ির বড়দের কাছে বকুনি খেয়েছিলেন। এই ঝি চাকররাই শিশু রবিকে খাওয়াত পরাত, প্রয়োজনে সামান্য শাসন করত ও গল্প বলে ভুলিয়ে রাখত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথায় এসব রয়েছে।
ঠাকুরবাড়িতে এক চাকর ছিল ঈশ্বর। ঈশ্বর পল্লীগ্রামে গুরুগিরি করত। ঠাকুরবাড়িতে দেবেন ঠাকুরের পরিবারে সেই গ্রাম্য পাঠশালার গুরু এল চাকরের কাজ করতে। এই কথাটা তলিয়ে ভাবলে ধ্বক করে বুকের ভিতরে লাগে। যে মানুষ গ্রামে পাঠশালার গুরু, গ্রামীণ অর্থনীতির কতখানি দৈন্যদশা হলে সে কলকাতার সম্ভ্রান্ত পরিবারে চাকরের কাজ নিতে বাধ্য হয়, সেটা ভাবলে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের পঙ্গু অর্থনীতির একটা চেহারা ধরা পড়ে।
ব্রিটিশ শাসনে ইচ্ছাকৃতভাবে ভারতের শিল্পোদ্যোগকে স্তম্ভিত করে দেওয়া হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪ – ০১.০৮. ১৮৪৬) ছিলেন বাংলার শিল্পোদ্যোগের কাণ্ডারী। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতামহ সম্পর্কে বিশেষ কিছু শব্দ খরচ করতে উল্লেখযোগ্য ভাবে কার্পণ্য করেছেন। তার কারণটা হল, দ্বারকানাথ ঠাকুর খুব বর্ণময় চরিত্রের মানুষ হলেও পুত্র দেবেন ঠাকুরের ব্রাহ্ম ঘরাণার পরিবারে তিনি খুব শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন না।
অথচ রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২ -১৮৩৩) দ্বারকানাথ ঠাকুরকে ছোটভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। রাজার চোখে পড়ার কারণ ছিল একটাই, সেটা হল দ্বারকানাথের প্রবল ব্যক্তিত্ব। রাজার চাইতে দ্বারকানাথ প্রায় বাইশ বছরের ছোট ছিলেন। বয়সের বেশ খানিকটা তফাত থাকা সত্ত্বেও যুবক রামমোহন বালক দ্বারকানাথকে সময় দিতেন। এই দ্বারকানাথ ইঞ্জিনচালিত কল কারখানা, খনি, জাহাজ, ইত্যাদির কারবার শুরু করেন। কার, টেগোর অ্যাণ্ড কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেন। এবং এইভাবে ব্রিটিশ সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে একজন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে পরিচিত হন। এমনকি তিনি লণ্ডনে মহারাণীর সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব অর্জন করেন। তাঁর এই চূড়ান্ত আর্থিক সাফল্য নিশ্চিতভাবেই একটি গবেষণার বিষয়। ওই সমাজে মিশতে গিয়ে যে আচার আচরণ, জীবন যাপনের রীতি হওয়া স্বাভাবিক, তা দ্বারকানাথ সোচ্চারে পালন করতেন। তাই তিনি বাড়িতে ছিলেন ব্রাত্য। তাঁর স্ত্রী দিগম্বরী দেবী তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন না। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে পিতামহের পরিচয় সম্পর্কে অদ্ভুত নীরবতা পালন করবেন, তা পারিবারিক পরিবেশ থেকে পাওয়া।
ব্রিটিশরা ভারতীয়ের শিল্পোদ্যোগের মধ্যে নিজেদের সর্বনাশ লক্ষ করেছিল। ততদিনে ব্রিটিশ পুঁজি সাম্রাজ্যবাদী স্তরে নিশ্চিতভাবে পৌঁছে গেছে এবং ক্ষয়িষ্ণু চেহারা নিয়েছে। যে সময়ে পুঁজিবাদ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়েছে, সামন্ততান্ত্রিক কুঅভ্যাস যথা জাতপাতের বিচার, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি করা, এগুলির বিরুদ্ধে লড়েছে, সে ছিল পুঁজিবাদের উত্থানের যুগ। সাম্রাজ্যবাদী স্তরে পৌঁছে পুঁজিবাদের চেহারাটাই আলাদা হয়ে গেছে। সমাজকে তার আর ইতিবাচক, গঠনমূলক কোনো কিছু দেবার ক্ষমতাটাই হারিয়ে গিয়েছে। ব্রিটিশ যখন পাকাপোক্ত ভাবে ভারতে শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছে, তখন ব্রিটিশ পুঁজির ক্ষয়িত গলিত মানবতাবিরোধী চরিত্রটা দাঁড়িয়ে গিয়েছে। তখন কুসংস্কার, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, সতীদাহ, জাতপাতের ভেদাভেদ ইত্যাদি যতো রকম ক্লেদ ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় ছিল, তার সাথে কোনোরকম বাস্তব সংঘাতে না গিয়ে কিভাবে চললে নিজেদের শোষণ শাসনের যন্ত্রটা চালু থাকে, সেই লক্ষ্যে কাজ করে চলেছিল ব্রিটিশ সরকারের মূল চালিকাশক্তি। এখানে ওখানে একটা দুটো উদারপন্থী, মানবতাবাদী, আলোকপ্রাপ্ত ইউরোপীয় ব্যক্তিরা ছিলেন না, তা কিন্তু নয়। তবে তাঁরা ব্রিটিশ স্বার্থের মূল চালিকাশক্তি ছিলেন না।
আধুনিক বৈজ্ঞানিক শিক্ষাবিস্তার করে, শিল্প বিস্তার করে জনজীবনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার ও চর্চা বাড়াতে ব্রিটিশ স্বার্থের মূল চালিকাশক্তি কোনো আগ্রহবোধ করে নি। ভারতকে আলোকিত করার দায়টাই তারা ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছিল। কুসংস্কার ও পশ্চাৎপদতার সাথে আপস করে যে করে হোক শোষণের মৃগয়াক্ষেত্রটাকে তাঁবে রাখাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল ব্রিটিশের লক্ষ্য। এইজন্যই ভারতীয় শিল্পোদ্যোগকে তার শৈশবাবস্থায় মর্মান্তিক আঘাত করে তাকে চিরতরে শেষ করে দেওয়া ছিল ব্রিটিশের বাঁচার উপায়। ব্রিটিশ ভারত থেকেই কাঁচামাল সংগ্রহ করত এবং শিল্পপণ্য এখানেই বিক্রি করত। এই বাজারটা কোনো কারণে হাতছাড়া হয়ে যাক, এটা ব্রিটিশ চাইত না। তাই কোথাও কোনো গঠনমূলক ইতিবাচক উদ্যোগ গড়ে উঠতে দিতে তারা ছিল নারাজ। সেইজন্য সুকৌশলে তারা এদেশের শিল্পোদ্যোগকে ধ্বংস করে দিল। তারা চাইল, ভারতীয় প্রতিভাবানেরা ব্রিটিশ ব্যবসার দালাল, ফড়ে, পাইকার, আড়তদার কিংবা ম্যানেজার হোক; কিন্তু শিল্পপতি হতে দেব না।
এই যে পাইকার, ফড়ে, আড়তদার, এদের হাতের পুঁজিটাকে বলে মুৎসুদ্দি পুঁজি। শিল্পপতি হতে গেলে যন্ত্রপাতি আর উৎপাদন পদ্ধতির খবর রাখতে হয়, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের সঙ্গে কিছু সম্পর্ক তৈরি করতে হয়। সেটা করতে গিয়ে একধরণের প্রগতিশীলতা অর্জিত হয়। ফড়ে, পাইকার, আড়তদারদের সেই দায় নেই। তারা উৎপাদন প্রক্রিয়ার ধার ধারে না, প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি কলকব্জার খবরাখবর রাখে না। তারা কেনাবেচা করে, মাল গুদামে আটকে, কৃত্রিম অভাব তৈরি করে, চাষিকে কায়দা করে অভাবি বিক্রি করতে বাধ্য করে লাভ করতে অভ্যস্ত। শিল্পপতি প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে দিন দুনিয়ার পরিবর্তনশীলতার কিছু কিছু খবর পায়, এই খবরটা তাকে রাখতেই হয়। এই কাজটা করতে গিয়ে যে যৎসামান্য হলেও প্রগতিশীলতার স্পর্শ পায়। আড়তদার পাইকার সে ছোঁয়া থেকে চিরবঞ্চিত। শিল্পপুঁজি আর মুৎসুদ্দি পুঁজির এই মৌলিক তফাত।
দেশে কলকারখানার বিকাশের সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়ে যেতে এই পুঁজিটা গিয়ে পড়ল জমিদারি ব্যবস্থার মধ্যে।
এখন জমিদারি নিয়েও কিছু কথা বলা উচিত। ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় মোগল সম্রাটের অধীনে নবাব এবং নবাবের অধীনে ছোটখাটো রাজা ও নৃপতি ছিলেন। এই সমস্ত রাজারা প্রজাদের থেকে কর আদায় করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এক অংশ দিয়ে নিজেরা বাকি অংশ ভোগ করতেন। মোগল সম্রাটের অধীনেও মনসবদারি প্রথা ছিল। মনসবদার মানে মোগল শাসন ব্যবস্থায় অতি উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী। অনেক সময়েই এদের বিপুল অঙ্কের বেতন রাজকোষ থেকে দেওয়া সম্ভব হত না। বিনিময়ে তাদের কিছু পরিমাণে জমি দিয়ে দেওয়া হত, যেখানকার খাজনা দিয়ে বেতনের বিকল্পে মনসবদারদের খরচ চলত। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে মোগল সম্রাটদের সার্বভৌমত্বের অবনতি হয়। মোগল সাম্রাজ্যের পতনের ক্ষেত্রে এই সার্বভৌমত্বের অবনতির সুনির্দিষ্ট ভূমিকা ছিল।
তথাপি এইসব রাজারা ছিল অনেক সময়েই বংশানুক্রমিক। এঁরা ছিলেন স্থানীয় মানুষ। কিন্তু ব্রিটিশ এসে অন্য ধরণের ভূমি ব্যবস্থা চালু করে। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিশের সময় বাংলা বিহার উড়িষ্যা ও বারাণসীতে আইন করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রচলিত হয়। এই সময়ে দেশীয় জমিদারদের উপরে শুধুমাত্র খাজনা আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় কোনো কর্তৃত্ব তাদের ছিল না। ওই ১৭৯৩ সালেই কর্ণওয়ালিশের নেতৃত্বে এই ব্যবস্থা চালু হয়। আগে প্রথাগতভাবে স্থানীয় রাজা ও ভূস্বামীগণ তাঁদের মতো করে দেশ শাসন করতেন, এবং সেই শাসন অক্ষুণ্ন রাখার প্রয়োজনে, প্রজার কাছে মান্যতা পাওয়ার স্বার্থে তাঁকে খানিকটা দক্ষতার সঙ্গে শাসকীয় কাজও করতে হত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এসে গেলে যে কেউ টাকা যোগান দিতে পারার দায়িত্ব নিলেই জমিদার হতে পারত, তার দেশশাসনের দায় থাকত না। জমিদারি গৌরবের লোভে দেশ শাসনে সম্পূর্ণ অনাগ্রহী ও অনভিজ্ঞ লোকেও এই ব্যবস্থায় ঢুকে পড়ল। এই নতুন ভুঁইফোড় জমিদারদের দেশের মানুষের প্রতি কিছুমাত্র দায়বদ্ধতা ছিল না। সেই উত্তরাধিকারটুকুও তাদের ছিল না। যিনি খাজনা আদায়ের অধিকারী, প্রজার দরকারে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে তাঁর কোনো দায় রইল না। একধরণের বল্গাহীন শোষণের যন্ত্র খাড়া হল কর্ণওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে। এর ফলে কৃষিজীবী লোকেরা দারুণ বিপদে পড়ল। তাদের গলায় পা দিয়ে খাজনা আদায় হত, অথচ সুশাসন বলতে যা বোঝায়, তা দেশে ছিল না। কৃষিজমিতে জলসেচ, নিরাপদ পানীয় জল ইত্যাদি ন্যূনতম ব্যবস্থা না করেই যে কেউ জমিদার হয়ে বসল। ব্রিটিশের ব্যবস্থাপনায় জমিদারিকে নিলামে তোলার ব্যবস্থা হল। নিলাম হেঁকে ব্রিটিশ প্রভুকে যে বেশি খাজনা দেবার প্রতিশ্রুতি দিত, তার জনপ্রশাসনে যোগ্যতা কিছুমাত্র থাক বা না থাক, নিলাম বলে সেই জমিদারি পেত। এর ফলে আসমুদ্র হিমাচল ব্রিটিশ শাসিত ভারতের তদানীন্তন রাজধানী শহর কলকাতার আড়তদার, পাইকার, ফড়ে ইত্যাদি মুৎসুদ্দি শ্রেণির লোকের হাতে থাকা বাড়তি পুঁজি জমিদারি অর্থনীতিতে ঢুকে পড়ল। কেননা, দেশে শিল্পবিকাশের পথ ছিল রুদ্ধ। জমিদারিই ছিল পুঁজি বিনিয়োগের একমাত্র পথ। এই নব্য জমিদারগণ থাকতেন শহরে এবং মাঝে মাঝে দূরে দূরান্তরে তাঁদের জমিদারি পরিদর্শন করতেন, এবং নিজেদের নায়েব গোমস্তার মাধ্যমে যথেচ্ছ শোষণ করতেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৈতৃক পরিবারও জমিদারির উপর নির্ভরশীল ছিলেন। তাঁদের গ্রাসাচ্ছাদন, বিলাস ব্যসন, হিমালয় ভ্রমণ, বিদেশ ভ্রমণ, নাটক করা, কাগজ চালানো, লোক লৌকিকতা সব কিছুই আসত বাংলাভূমির বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র থেকে নায়েব গোমস্তার মাধ্যমে। দৈবাৎ ঠাকুর বাড়ির কোনো বাবু আইইসিএস ইত্যাদি উচ্চপদে চাকুরি নিলেও সংসারের বেশিরভাগ খরচ চলত জমিদারির আয়ে। অন্য বাবুরা নিয়মিত মাসোহারা হিসেবে হাতখরচের টাকা পেতেন।
কর্ণওয়ালিশের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্যই গ্রামবাংলার নিম্নকোটির মানুষ ভীষণভাবে পিছিয়ে পড়ল। একটি হিসেবে দেখা যায়, খাজনার উপর নির্ভরশীলতার নিরিখে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ থেকে নিম্নস্তরের প্রজা অবধি বত্রিশটি পর্যন্ত স্তর ছিল। বলা দরকার, এই নিম্নস্থ প্রজা ছাড়া সকলেই ছিল পরশ্রমজীবী। এরা কেউই বাংলাভূমির কৃষি ও সেচের উন্নতির কথা ভাবে নি। শস্যের আবর্তন, জমিতে সারের প্রয়োগ এসবই ছিল কৃষকের কল্পনার বাইরে। বাংলার নিম্নকোটির মানুষের শিক্ষার অধিকারটুকু পর্যন্ত ছিল না। যৎসামান্য হলেও সে রাস্তা ক্রমে ক্রমে তৈরি করে দেবেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। একঘেয়ে সনাতনী পথে চাষ হতে হতে জমির উৎপাদিকা শক্তি ও বীজের গুণমান রীতিমতো হ্রাস পেয়েছিল। এর ফলে জমি আর মানুষকে আহার জোগাতে পারছিল না। তাকে শহরে গিয়ে বিকল্প জীবিকার সন্ধান করতেই হচ্ছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পিতামহ রামজয় তর্কালঙ্কার ছিলেন পণ্ডিত ব্যক্তি। কিন্তু গ্রামে কোনো জীবিকার সংস্থান না থাকায়, কর্মঠ যুবক ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় পায়ে হেঁটে কলকাতার বড়বাজারে পৌঁছে হিন্দিভাষী মালিকের অধীনে মুদিখানা দোকানে চাকরি করতেন। ঠাকুরদাসের বেতন ছিল দশটাকা। ওই বেতনে ঠাকুরদাসকে কলকাতার বাসাভাড়া, ছেলেদের পড়ার খরচ, ও খাইখরচ সামলে গ্রামে তাঁর পরিবারকে টাকা পাঠাতে হত। এই যে গ্রামীণ পণ্ডিতের পুত্রকে রাজধানী শহরে হিন্দিভাষী ব্যক্তির দোকানে শ্রমিকের কাজ নিতে হচ্ছে, এটা বিশেষভাবে লক্ষ করার বিষয়। সমস্ত আর্থিক সমৃদ্ধি ছিল কলকাতা কেন্দ্রিক। এবং সেই গরিমার ছিটে ফোঁটাও গ্রামবাংলায় গিয়ে পৌঁছত না। বিদ্যাসাগর বড় হয়ে নিজের উদ্যোগে ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাদপ্তরের অধ্যক্ষের পদে থেকে গ্রামবাংলায় সরকারি শিক্ষা পৌঁছতে প্রাণপাত করে গিয়েছেন।
নইলে গ্রামীণ বুদ্ধিজীবীকুল সকলেই কলকাতায় আশ্রয় খুঁজতেন। রামমোহন রায় হুগলির প্রত্যন্ত দুর্গম খানাকুল থেকে কলকাতা এসে পৌঁছেছেন, হুগলিরই চন্দননগর গোদলপাড়া থেকে রাধানাথ শিকদার, যশোরের সাগরদাঁড়ি থেকে মাইকেল মধুসূদনের পৈতৃক পরিবার, নৈহাটির কাঁঠালপাড়া থেকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বাঁকুড়া থেকে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, জয়নগর মজিলপুর থেকে শিবনাথ শাস্ত্রী, মুনশিগঞ্জ বিক্রমপুর থেকে জগদীশচন্দ্র বসু, রাঢ়ুলী খুলনা থেকে প্রফুল্লচন্দ্র রায়, দেবানন্দপুর ব্যাণ্ডেল থেকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ অজস্র বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিভাশালী মানুষের আশ্রয়স্থল ছিল কলকাতা।
এঁদের পরিবারের কেউ কেউ ছিলেন কলকাতার আদালতের কাজে যুক্ত, কেউ বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আর কেউ বা সাহিত্যিক হিসেবে সাময়িক পত্রের সঙ্গে যুক্ত। রাধানাথ শিকদার সরকারি ভূসর্বেক্ষণ অফিসের গণিত বিষয়ক কর্মী ছিলেন।
এ রকম বুদ্ধিজীবী না হলেও, বাংলা রেনেসাঁসে একটি সমুচ্চ জায়গা নিয়েছেন গদাধর চট্টোপাধ্যায়। হুগলি জেলার প্রত্যন্তের কামারপুকুর গ্রাম থেকে দাদার হাত ধরে ছুটে এসেছেন গদাধর। কলকাতার পাশে দক্ষিণেশ্বরে নিচু কৈবর্ত জাতের বড়লোক রাণি রাসমণির কালি মন্দিরে পূজারী হতে। কলকাতার বামুনরা যে কৈবর্ত মহিলার ঠাকুর সেবায় অনীহা প্রকাশ করেছেন, সেই একই ঠাকুরের পূজক হতে ছুটে এসেছেন তাঁরা, স্রেফ অন্নকষ্টে। ইংরেজের ভূমিব্যবস্থা গ্রামবাংলার এই হাল করে দিয়েছিল।
যে সময়ে ইউরোপীয় জাতিগুলি নিজেদের দেশে দাসত্বের বিরুদ্ধে কথা বলছে, যে সময় সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা নিয়ে দার্শনিকেরা বই লিখেছেন, সেই একই সময়ে নতুন করে এক দাসব্যবস্থা ভারতে গড়ে উঠছে। গ্রামের শিক্ষিত মানুষ অন্নের দায়ে শহরের উচ্চবিত্ত পরিবারে এসে চাকরের কাজ নিয়েছে, এ আমরা দেবেন ঠাকুরের আলোকপ্রাপ্ত পরিবারে দেখেছি। এছাড়া, সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারেও ঝি চাকর রাখা ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। চাকরি শব্দের মধ্যে চাকর কথাটি আছে। কিন্তু ভৃত্য বা দাস বলতে যে ধরনের চাকর বোঝায়, তা একেবারেই অমানবিক। শেক্সপিয়রের ‘কমেডি অফ এররস’ নাটক অবলম্বনে ১৮৬৯ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় ‘ভ্রান্তি বিলাস’ নামে উপন্যাস লেখেন। শেক্সপিয়রের মূল নাটকে এফিসস নগরীতে ঘটনাটি ঘটছে। সম্ভ্রান্ত পরিবারের দুই যমজ ভাই। তারা সাইরাকিউজ শহরের বণিক দম্পতি ঈজিয়ন ও এমিলিয়ার যমজ সন্তান। আইডেনটিক্যাল টুইন। বাবা দুজনের নামই রেখেছিলেন অ্যান্টিফোলাস। আর তাদের দুই চাকর। তারা দুজনেও যমজ। আইডেনটিক্যাল টুইন। কর্তামশায় ঈজিয়ন দুজনের নামই রেখেছিলেন ড্রোমিও। বণিক ঈজিয়নের অর্ণবপোত ঝড়ের কবলে পড়ে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যান ঈজিয়ন এমিলিয়া। ঈজিয়নের সঙ্গে ছিলেন একজন শিশুপুত্র আর তার শিশু চাকর। এমিলিয়ার সঙ্গে ছিলেন আরেকজন শিশুপুত্র আর তার শিশু চাকর। ঈজিয়ন কোনো গতিকে শিশুদের নিয়ে ফিরলেন তাঁর ভদ্রাসন সাইরাকিউজ শহরে। এমিলিয়া তাঁর কাছে থাকা শিশুদের নিয়ে ঠাঁই পেলেন এফিসস নগরে। মায়ের কাছে থাকা অ্যান্টিফোলাস এর স্ত্রী আদ্রিয়ানা। আর তার বোন লুসিয়ানা। বাবার কাছে থাকা অ্যান্টিফোলাস অবিবাহিত। সে তার চাকর ড্রোমিও এফিসস শহরে এসে পড়েছে। দুই শহরের মধ্যে দারুণ ঝগড়া। এই অবস্থায় আইডেনটিক্যাল দুজোড়া টুইন নিয়ে চমৎকার নাটককে উপন্যাসের ছকে ঢেলেছেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। তাঁর গুণী কলমে অ্যান্টিফোলাস দুজনের নাম চিরঞ্জীব, আর ড্রোমিও দুজনের নাম কিঙ্কর। কিঙ্কর কথাটার অর্থই হল চাকর। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁর উপন্যাসে যমজ ক্রীতদাসের নাম দিয়ে ফেললেন কিঙ্কর। হয়তো বা অজান্তেই নামটা তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে এল। সেকালে চাকরের মধ্যে হাড়ে মজ্জায় দাসত্ব। নামের মধ্যেও তাই।
এবার একবার পুরাতন ভৃত্য কবিতার দিকে তাকাই। কমেডি অফ এররস এর ড্রোমিও ওরফে কিঙ্কররা যেমন অ্যান্টিফোলাস ওরফে চিরঞ্জীবদের সঙ্গে শিশুকাল থেকেই চাকর হিসেবে যুক্ত ছিল, তেমন ভাবেই কৃষ্ণকান্ত এই কবিতার কথকের সঙ্গে যুক্ত। কবিতার একেবারে প্রথম পংক্তিতেই রবীন্দ্রনাথ কৃষ্ণকান্তের রূপবর্ণনা করেছেন। তার চেহারাটি ভূতের মতো, ভূতের গায়ের রঙ বুঝি কালো, আর কেষ্টার চেহারা সেই কালিমা তার নামেও ধরা আছে। কৃষ্ণকান্ত শব্দের বাচ্যার্থ হল, যার শরীর কৃষ্ণবর্ণের। আর কবি তার বুদ্ধি শুদ্ধির পরিচয়ও দিয়ে বলেছেন, নির্বোধ অতি ঘোর। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, কৃষ্ণকান্তকে কেষ্টা বলে ডাকা হয়। আবার তাকে সময়ে সময়ে বেটা বলে সম্বোধন করা হয়। লোকেরা ছেলেকে বেটা বলে, কিন্তু মূলগত অর্থে বেটা মানে বিনা মাহিনার মজুর। কবিতায় বলা হয়েছে, যত পায় বেত, না পায় বেতন। কেষ্টাকে তার কর্মস্থলে নিত্য নৈমিত্তিক ভাবে উঠতে বসতে গালি দেওয়া হয় জুতসই শব্দে। পাজি, হতভাগা, গাধা, এইসব শব্দ তার উদাহরণ। কোনো ভদ্রলোক অন্য কোনো ভদ্রলোকের উপর রাগান্বিত হয়ে কটূক্তি করলেও সাধারণত বাপ মা তোলা হয় না। কিন্তু কেষ্টার উপর উঠতে বসতে বাপান্ত করা চলে। এমনকি তাকে শারীরিক ভাবে নির্যাতন পর্যন্ত করা চলে। তাকে বেত্রাঘাত করা হয়। রেগে গেলে মালিক তাকে টিকি ধরে টেনে আনতে পারে। কেষ্টাকে তার কর্মস্থলে তুই সম্বোধন করা হয়।
কিন্তু কেষ্টা একেবারে ছোটবেলা থেকে সমবয়সী চাকর হিসেবে আলোচ্য পরিবারে আছে এবং আশৈশব দীর্ঘদিন ধরে থাকতে থাকতে গৃহকর্তাকে সে একরকম ভালও বেসে ফেলেছে। গৃহকর্তার শাসন ও তাড়নায় সে বিশেষ বিচলিতও হয় না। কর্তার সঙ্গে তার এই সম্পর্কের বিন্যাস দেখে ঘরণী যথেষ্ট বিরক্ত। তিনি মাঝে মধ্যেই ঝঙ্কার দিয়ে বলেন, ‘রহিল তোমার এ ঘর দুয়ার, কেষ্টারে লয়ে থাকো’।… আরো বলেন, ‘ করিলে চেষ্টা কেষ্টা ছাড়া কি ভৃত্য মেলে না আর?’
আমার চোখে কৃষ্ণকান্ত একজন দীন দরিদ্র সহায় সম্বলহীন মানুষ, যার কি না মালিকের ঘর ছাড়া অন্য কোথাও যাবার জায়গা নেই। নিজের কোনো সংসার নেই, যৌনতা নেই, স্বপ্ন নেই, ভবিষ্যৎ নেই। এক পরিচয়হীন, সম্ভ্রমহীন, সর্বহারার সর্বহারা সে। এই মানুষের ভিতরেও যে কতবড় একজন মানুষ থাকতে পারে, তা বহু পরে গৃহস্বামী বুঝতে পারেন। তখন অবশ্য করার আর কিছু ছিল না। কবিতার একেবারে শেষ পংক্তিতে মৃত্যুর পর কৃষ্ণকান্ত গৃহস্বামীর কাছে একটু স্বীকৃতি পায়। তাকে ‘চিরসাথি’ বলে উল্লেখ করেন কবিতার কথক।