T3 || ঈদ স্পেশালে || লিখেছেন শিল্পী নাজনীন

শূন‍্যতা ও জোছনার গল্প

ট্রেনটা তুমুল দুলছে। দুলুনিতে কেমন ঘুম-ঘুম পাচ্ছে। জানালাটা সম্ভবত খোলা। না-কি বন্ধ? না। খোলাই। হাওয়া আসছে জোর। চৈত্রের গরমে হাওয়াটা স্বস্তি ছড়াচ্ছে শরীরে। চোখ মুদে আসছে আপনাতেই। শ্রান্তিকাতর শরীরটা আলস‍্যে এলিয়ে পড়ছে ফার্স্টক্লাশ কামরাটার ডাবলডেকের ওপরের ডেকে। নীচে কি কেউ আছে? অথবা ছিল? মনে পড়ছে না। সম্ভবত আছে। কিংবা ছিল। থাকুক। অথবা না থাকুক। কী আসে যায় তাতে! কিছু না। কিচ্ছু না। আমার থাকা বা না থাকাতেও। এই ট্রেন সর্পিল শরীরে এমনি তুমুল দুলুনি তুলে তখনও এঁকেবেঁকে ছুটে যাবে তার নির্ধারিত পথে। জানালা দিয়ে দারুণ প্রশান্তির হাওয়া এসে তখনও এমন শীতল করবে ট্রেনের সব যাত্রীর শ্রান্ত মন। আকাশে এমন পোয়াতি চাঁদ তখনও মুঠো মুঠো জোছনায় ঢেকে দেবে পৃথিবীর মায়াবী মুখ। এই তারাভরা রাত রহস্যের ডালি মেলে এমনই আবছায়া ঘোরে ডুবিয়ে দেবে অন‍্য কোনো উদাস মন। আমার থাকা বা না থাকায় কিচ্ছুটি বদলাবে না এইসব অভ‍্যস্থতা, সামান্যও চির ধরবে না এইসব প্রাত‍্যহিক যাপনে। তাহলে আমার এই থাকারই বা অর্থ কী! আদৌ কি আছি আমি কোথাও? প্রশ্নটা মাথার ভেতর ঘাই দিতেই তন্দ্রার ঘোর কেটে যেতে চায়। মনটা আচমকা চঞ্চল হয়ে উঠতে চায়। নিজেকে নিজেই ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করি, আমি কি আছি? আমি কি কোথাও আছি?
প্রশ্নটা চলন্ত ট্রেনের হাওয়ার শরীরে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে পুনরায় আমারই কানের কাছে। ট্রেনের দুলুনির তালে তালে দোলে। উড়ে উড়ে, ঘুরে ঘুরে আমারই কানের কাছে আছড়ে পড়ে এসে। ফিসফিসিয়ে আমাকেই সে প্রশ্ন করে, আমি কি আছি? আমি কি কোথাও আছি?
আমার কেমন অনিত‍্য লাগে সব। এলোমেলো লাগে।প্রশ্নের কি প্রাণ থাকে? অথবা শরীর? প্রশ্ন কী করে আমাকে প্রশ্ন করে তাহলে? তবু তার উত্তরে মনে হয়, নেই। আমি নেই। কোত্থাও নেই। কোনো প্রশ্নও নেই। অনন্ত শূন‍্য এক গহ্বরে সাঁতার কাটছি আমি, বিন্দুসম শক্তি এক, হাওয়ার শরীরে ভর রেখে। হাওয়া উবে গেলেই অনন্ত মহাশূন‍্য শুষে নেবে আমাকে, আমিও শূন্য তখন। আমি উঠি। উঠে বসি। চোখ রাখি খোলা জানালায়। বাইরে জোছনা ধোয়া রাত। চলন্ত ট্রেনের দুপাশের ছুটন্ত গাছের শরীর ছুঁয়ে নাচছে ভৈরবি নাচ। নীচের বাথে নড়াচড়া করে কেউ। ফিসফিস কথা কয়। হাওয়ার শরীরে ভর দিয়ে কথারা সাঁতরায় ঘরময়। মনে পড়ে নীচের বাথে এক জুটি উঠেছিল। অল্প বয়সী। স্টেশনে বসেছিল। টিকিট ছাড়া। ওরা নিজেদের ভেতর আলাপ করছিল। ছেলেটা বলছিল, চল ফিরে যাই। অন‍্যদিন যাব।
মেয়েটার মন খারাপ। সে ফিরতে নারাজ। ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, না। আজ যাব।
টিকিট পাচ্ছি না তো! -ছেলেটার কণ্ঠে নিরুপায়তা কাঁপে। মেয়েটা গোঁজ হয়ে বসে থাকে। সে ফিরবে না। ঘরে কে ফিরতে চায়! বাঁধন ছেঁড়ার নেশা প্রকৃতি আমাদের রক্তে ছড়িয়ে দিয়েছে সেই আদিতেই। অজান্তেই সেটা আমরা বয়ে বেড়াই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। কেন তবে ঘরে থাকবে মেয়ে? পাশে বসে ওদের কথোপকথন শুনতে বেশ লাগে। মান-অভিমান। হঠাৎ জয়াকে মনে পড়ে। বহুকাল আগে, না-কি গতজন্মে, মনে নেই, আমরাও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ট্রেনটা সেদিনও দুলছিল খুব। কষ্টেসৃষ্টে থার্ডক্লাসের দুটো টিকিট যোগাড় করে আমরা চড়ে বসেছিলাম ট্রেনে। জয়ার মাথা ছিল আমার কাঁধে। আমার ডানহাত জড়িয়ে ছিল জয়ার কোমর। আকাশে ভরাট চাঁদ। জয়া গুনগুনিয়ে গাইছিল, এ মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে এসো না গল্প করি…
গল্প, গান, হাসিতে তুমুল মেতেছিলাম আমরা। প্রায় সারারাত। শেষ রাতের দিকে জয়া ঘুমিয়ে পড়ল। তখনও আমার কাঁধে তার মাথা। হাওয়া উড়িয়ে দিচ্ছে তার নরম, সুগন্ধি চুল, লেপ্টে দিচ্ছে আমার চোখে, মুখে, বুকে। পশ্চিমে হেলে যাওয়া চাঁদের মুখ তখন ঋতুবতী কিশোরীর মুখের মতো ম্লান, ফ‍্যাকাশে। সেই মরা জোছনার খানিকটা এসে জয়ার মুখে পড়েছিল ঝুপ করে। জয়ার অমন মুখ আগে দেখিনি কখনও। কেমন অপার্থিব। অনিত‍্য। মায়াকাড়া। আমি তার কপালে চুমু আঁকলাম অজান্তেই। জয়া অস্ফুটে কী একটা বলল। কাঁধে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরল আমাকে। অদ্ভুত এক ভালোলাগা ছড়িয়ে গেল শরীরজুড়ে। এক মুহূর্ত ভাবলাম। আস্তে জয়ার মাথাটা সরিয়ে দিলাম কাঁধ থেকে। সাবধানে নিজেকে জয়ার বাঁধন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে। অতঃপর চলন্ত ট্রেন থেকে নিজেকে ভাসিয়ে দিলাম শূন্যে। আমার শরীরে হাওয়ার চাবুক কেটে ট্রেনটা নিজের শরীরে তুমুল দুলুনি তুলে জয়াকে নিয়ে চলে গেল গন্তব্য লক্ষ্য করে।
অল্প বয়সী এই জুটির মান-অভিমান, খুনসুটি আমাকে গতজন্মের সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। কিংবা গত দিনের। নাকি আগামীর? মনে পড়ে না।
জয়ার জন‍্য ভীষণ মন কেমন করে হঠাৎ। কেমন আছে সে? কোথায়? সেদিন আচমকা ঘুম ভেঙে যখন দেখেছিল পাশে কেউ নেই, শূন্য পড়ে আছে পাশের আসন, কেমন হয়েছিল তার মুখটা, জানতে ইচ্ছে করে খুব। প্রবল কৌতূহলে পাশে বসা খুনসুটিরত জুটির দিকে চোখ রাখি। মেয়েটার দিকে তাকাই। আশাভঙ্গাঘাতে আহত মেয়েটার চোখে-মুখে তীব্র অভিমান, হতাশা, ক্ষোভ। তাকিয়ে মনটা কেমন উদাস হয় আমার। মনে পড়ে ট্রেনের ফার্স্টক্লাসে একটা বাথ রিজার্ভ করা আছে আমার। যেচে প্রস্তাবটা আমিই দেই। ছেলেটার চোখে ঘোর সন্দেহ। মেয়েটা রাজি হয়ে যায় এককথায়। বড্ড সরল। জয়ার মতোই। পথে ওঁৎ পেতে থাকা হাজারো শঙ্কা চেনে না। কিংবা পাত্তাই দেয় না। আমার বাথটার নীচের ডেকে উঠে বসে তারা অগত‍্যা। আমি ওপরে। নীচে তাদের মৃদু ফিসফাস। আলাপন। অস্পষ্ট কানে আসে। জুটিটা সম্ভবত নেমে গেছিল কয়েক স্টেশন পর। ওপরের ডেক থেকে নেমে গিয়ে দরজায় সিটকিনি তুলে দিয়েছিলাম, মনে পড়ে স্পষ্ট। তাহলে কাদের কথা ভাসে হাওয়ায়? কারা অমন কথা কয় ফিসফিস? জয়া? আমি কান পাতি হাওয়ায়। খিলখিল হাসির শব্দ আসে। কে হাসে? জয়া? তার হাসিতে ঝর্ণা ঝরে আনন্দের। জয়ার আনন্দে আমারও আনন্দ হয় খুব। আমি জানালা দিয়ে আবার বাইরে তাকাই। বাইরে জোছনার ঝিরিঝিরি ঝর্ণায় স্নানরত প্রকৃতি খিলখিল হাসে। নাকি জয়া? হঠাৎ বদলে যায় সব। শিশু আমি। মার হাত ধরে গুটি গুটি হাঁটি। সামনে বাবা। পাশে রেণু আপা। রেণু আপার চোখে গাঢ় কাজল। চাঁদের ফিনিক ফোটা জোছনায় রেণু আপার চোখের কালো কাজল গাঢ় দেখায় আরো। আমার দিকে ফিরে রেণু আপা বলে, বাবু, আমরা কোথায় যাচ্ছি বলতো?
মার হাত আঁকড়ে ধরে আমি ঘাড় উঁচিয়ে তাকাই। খানিক গর্ব, খানিক আনন্দ নিয়ে বলি, নানুবালি দাত্তি!
রেণুপা খিলখিল হাসে। মা হাসে। বাবাও। রেণুপা দৌড়ে এসে আমাকে কোলে তুলে নেয়। চুমুতে চুমুতে আমাকে ভরিয়ে দিয়ে বলে, ওওও মাআআ! তাইইই? নানুবালি দাত্তিইইই?
হাঁসফাস লাগে। রেণুপার কোল থেকে জোর করে নেমে মার হাত ধরতে ধরতে উত্তর দেই, হু।
চাঁদটাও সাথে সাথে হাঁটে আমাদের। জোছনাও পিছু নেয়।
দেখেছিস বাবু? চাঁদও নানুবাড়ি যাচ্ছে আমাদের সাথে!
-সবিস্ময়ে বলে রেণুপা। তারচে অধিক বিস্ময়ে আমি চাঁদের দিকে তাকাই। সত‍্যিই তো! এত হ‍্যাংলা! এম্মাহ! কারো সাথে এমন করে বুঝি যেতে আছে! সাথে আবার একপাল ছানাপোনা! ছি!
কিন্তু মনটা দারুণ খুশিতে নেচে ওঠে আমার। আস্ত একটা চাঁদ আর তার আকাশভরা তারা, রেণুপা বলে ওরা নাকি চাঁদের ছানাপোনা, ওরা আমাদের সঙ্গী হয়ে নানুবাড়ি যাচ্ছে দেখে আনন্দ পেখম মেলে মনে। আমি মার হাত ধরে হাঁটি। চটিতে শব্দ ওঠে ফটফট। মার সবুজ শাড়ি চাঁদের আলোয় জ্বলে। মার চোখও জ্বলে আনন্দে। বাবার সাদা পাঞ্জাবি জোছনাস্নানে ধবধবে সাদা দেখায় আরো। রেণুপার চোখের কাজল আরো গাঢ়। চারপাশে জোছনার মিছিল। পথের দুপাশে সবুজ গাছগুলো জোছনায় ডুবে অদ্ভুত রহস্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নির্বাক। সুনসান নীরব গ্রামটা ঘুমোয়। রেণুপা বলে, জানিস বাবু, গ্রামটা ঘুমোয় না, নিশ্চুপ রাজার গল্প বলে আসলে!
সেই নিশ্চুপ রাজার গল্পের ভেতর দিয়ে আমরা পথ হাঁটি। নানুবাড়ি লক্ষ্য করে এগোই। চাঁদ আর তার একপাল ছানাপোনা আমাদের সঙ্গী হয়। সঙ্গী হয় রাশি রাশি রুপালি জোছনাও।
ক্ষণপরেই জয়া ধোঁয়া ওঠা চা হাতে ঘরে ঢোকে। খোলা চুল কোমর ছাপিয়ে নেমে গেছে আরো। ভেজা চুল বেয়ে জল ঝরছে টুপটাপ। ভেজা, এলো চুলে তাকে দেখিনি কখনও। অবাক তাকিয়ে থাকি। হঠাৎ জয়া কোত্থেকে এল, ভাবনাটা মনের ভেতর উঁকি দিয়েই হারিয়ে যায় কোথায়। মাথার কাছে রাখা ছোট্ট টেবিলে কাপটা নামিয়ে রেখে জয়া সিথানে বসে টুপ করে। মাথায় আলতো হাত রাখে। বিলি কাটে চুলে। ভীষণ ভালো লাগে। ঘুমে জড়িয়ে আসে চোখ। চোখ বন্ধ করতেই জয়া মৃদু ধমক দিয়ে বলে, সে কী! আবার ঘুমাচ্ছ যে! ওঠ! চা ঠান্ডা হয়ে যাবে তো!
আমার উঠতে ইচ্ছে করে না। চোখও খুলতে ইচ্ছে করে না। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি। বন্ধ চোখেই দেখতে পাই জয়া বরের সাথে কী একটা নিয়ে কথা বলছে। হাসছে। কাঁচভাঙা হাসির শব্দে ভীষণ সরব হয়ে উঠছে চারপাশ। জয়ার হাসির শব্দ কান্না হয়ে ওঠে সহসা। তিন বছরের শিশুকন‍্যাটিকে জড়িয়ে ধরে জয়া কাঁদে। বাড়িভর্তি মানুষ। জয়াকে জোর করে সেখান থেকে সরিয়ে নেয় কেউ। জয়ার বরের হাউমাউ কান্নার আওয়াজ আসে। কে যেন বলে, কাঁদে না বাছা! মৃতের পাশে কাঁদতে নেই।
কথাটা কানে আসতেই চোখ খুলে ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকাই। ছুটন্ত প্রকৃতির দিকে চোখ পড়তেই কেমন অনিত‍্য লাগে সব। জয়া আর তার বরের জন্য কেন যেন আমার কষ্ট হয় ভীষণ। হাত নাড়ি। সান্ত্বনা দিতে চাই। সহসা চমকে উঠি। জয়ার বর কি তবে আমি? জয়ার পাশে বসে আমি কেন কাঁদছি? সবাই আমাকেই কেন সরিয়ে দিচ্ছে সেখান থেকে? কেন বলছে, কাঁদে না বাছা! মৃতের পাশে কাঁদতে নেই! আমারই শিশুকন‍্যাটি কি মারা গেছে তবে? তাহলে কি নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে চাইছি আমি! জানালায় সতর্ক চোখ রাখি। দেখতে চাই। কে কাঁদে জয়ার পাশে? আমিই? ট্রেন ছুটে যায় তুমুল বেগে। দৃষ্টি থেকে সরে যায় জয়ার শিশুকন‍্যার মৃত মুখ। জয়া আর তার বরের ক্রন্দনরত চেহারা। চলন্ত ট্রেনটা পেছনে ফেলে চলে যায় তাদের। আমিও কি পেছনে ফেলে যাই আমাকে? বুঝতে পারি না।
রেণুপাকে দেখি। বধুবেশে বসে আছে রেণুপা। গা ভর্তি গয়না। কী যে সুন্দর দেখাচ্ছে রেণুপাকে! মা ঘোমটা দিয়ে ঘুরছে বাড়িময়। তদারকিতে ব‍্যস্ত ভীষণ। বর এখনও আসছে না কেন? বাবা চিন্তিত মুখে পায়চারি করছে এদিক-ওদিক। সব কাজ ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা সেদিকেও নজর রাখছে কড়া। আমি অবাক হয়ে রেণুপাকে দেখছি। মানুষ কী করে সুন্দর হয় এত! বউসাজে রেণুপাকে দেখে কিছুতেই চোখ সরাতে পারছি না। রেণুপা এত সুন্দর! এত্ত! চোখেই পড়েনি এতদিন! রেণুপার চোখে জল। চোখে লেপ্টে আছে কাজল। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলছে, তোকে ছাড়া কী করে থাকব বাবু! কী করে থাকব বল!
রেণুপার কণ্ঠটা কানে বাজছে বারবার। ভাসছে হাওয়ায়।
ট্রেনের তীব্র ঝাঁকুনিতে হঠাৎই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। ট্রেনটা ব্রীজ পার হচ্ছে। নদীতে আছড়ে পড়ছে ভুবনভোলানো জোছনা। চিকচিক করছে নদীর জল। আনন্দ সাঁতার কাটছে তার রুপালি বুকে। অবিকল মার চোখ। আমার চোখে বাষ্প জমে যায়। মাকে মনে পড়ে। রেণুপাকে মনে পড়ে। মনে পড়ে বহুকাল কিংবা বহুজনম আগের সেই ঝাপসা স্মৃতি। এমনই কোনো এক ট্রেন। তুমুল দুলুনিতে ছুটছে। ছুটছে তো ছুটছেই। হঠাৎ ছিটকে পড়ল ট্রেন। উল্টে গেল কামরা। পৃথিবী ফাঁকা। শূন্য সব। ভেসে এল রেণুপার বিস্মিত, হতবিহ্বল কণ্ঠ, আমার মার মাথা কই?!
রেণুপার কণ্ঠটা অনেকক্ষণ ভাসল হাওয়ায়। কারা যেন হেসে উঠল খিলখিল। নাকি কেঁদে? হবে কিছু একটা। ট্রেনটা ব্রিজ পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। নদী ফেলে এসেছে দূরে। মার চোখও। মাথার ভেতর রেণুপার কণ্ঠটা ভেসে ভেসে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে দূরে। ট্রেনটা দুলছে। তার তুমুল দুলুনিতে শরীর দুলছে আমারও। বাইরে জোছনা ধোয়া রাত। আকাশে মস্ত চাঁদ। রহস‍্যময় প্রকৃতি। ছুটছে। জানালা দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া আসছে জোর। ঘুম-ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু আমি কি আছি? কোথায় আছি? কোথায় যাচ্ছি? জানি না। চোখ মুদে আসে ঘুমে। কে যেন জড়িয়ে ধরে। কে? জয়া? নাকি মা? বুঝতে পারি না। যে হয় হোক। ঘুম পাচ্ছে। ঘুমোই। তীব্রভাবে আমিও জড়িয়ে ধরি মাকে। অথবা জয়াকে। ট্রেন তুমুল গতিতে ছোটে। তার শরীরে দুলুনি। ছন্দময় ঝাঁকুনি। জয়া ফিসফিসিয়ে কী একটা বলে। নীচের ডেকে জুটিটার খুনসুটি শোনা যায়। ফাল্গুনের হাওয়া জানালা দিয়ে ছুড়ে দেয় প্রশান্তি। ঘরময় ওড়ে। মনজুড়ে ঘোরে। কিংবা না। কিছুই নেই। আমি নেই, রেণুপা নেই, জয়া নেই, ট্রেন নেই। কেউ কোথাও নেই। শুধু রেণুপার বিস্মিত, হতবিহ্বল প্রশ্নটা হাওয়ায় ওড়ে, আমার মার মাথা কই?!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।