• Uncategorized
  • 0

|| সুকান্ত ভট্টাচার্যের স্মরণে || লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

আজকের দিনে সুকান্ত অশেষ হয়েছিলেন

আমাদের ছোটবেলায় পাড়ায় পাড়ায় আবৃত্তি প্রতিযোগিতা হত। ছোটরা শিখত, “একটি মোরগ হঠাৎ আশ্রয় পেয়ে গেল/ বিরাট প্রাসাদের ছোট্ট এক কোণে, ভাঙা প্যাকিং বাক্সের গাদায়— ” কিংবা,  “আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি এত নগণ্য, হয়তো চোখেও পড়ি না: তবু জেনো মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ— বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস;” অথবা “হঠাৎ দেশে উঠল আওয়াজ- “হো-হো, হো-হো, হো-হো”
চমকে সবাই তাকিয়ে দেখে- সিপাহী বিদ্রোহ!” কবিতা শুরুর আগে বলতে হত কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের নাম। ১৯২৬ সালের পনেরো আগস্ট জন্মেছিলেন তিনি। কালিঘাটে, আর পাঁচটি বাঙালি ঘরের সন্তানের মতোই, মামাবাড়িতে, ৪৩, মহিম হালদার স্ট্রিটে। বাবা নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্য আর মা সুনীতিদেবীর কোলে।   পনেরো আগস্টে জন্মালেও দেশকে স্বাধীন দেখে যেতে আর পারেননি। জীবনাবসান হয়ে গেল, মে মাসেই, ১৯৪৭ সালে, তেরো তারিখে। কঠিন যক্ষ্মা রোগে নিঃশেষিত হয়ে। কবির বয়স একুশে পৌঁছয় নি
তখনো। বেলেঘাটায় জীবনের বেশিরভাগ সময়টা কেটেছে। থাকতেন ৩৪, হরমোহন ঘোষ রোডের বাড়িতে। খুব অল্পবয়স থেকেই লেখালেখি শুরু করেন সুকান্ত। গভীর বোধ, আর উজ্জ্বল চিন্তায় ভরপুর। কিন্তু অ্যাকাডেমিক পড়াশুনায় সে বুদ্ধিদীপ্তির ছাপ পড়ে নি। ১৯৪৫ সালে ঊনিশ বছর বয়সে বেলেঘাটা দেশবন্ধু স্কুল থেকে প্রবেশিকা বা এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হন। তারপর পড়াশুনায় ছেদ পড়ে গেল। গভীর
ভাবে জড়িয়ে পড়লেন বামপন্থী সংগঠন গড়তে। নিম্ন মধ‍্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন সুকান্ত। অভাব, অনাহার, অপুষ্টি ছিল নিত্য সহচর। তার উপর দেশের দাবিতে সাম‍্যবাদী আন্দোলনের পথিক হয়ে নিজেকে নিঃশেষে নিংড়ে দিয়েছেন। যখন বলেন, জড় ন‌ই, মৃত ন‌ই, ন‌ই অন্ধকারের খনিজ, আমি তো জীবন্ত প্রাণ, আমি এক অঙ্কুরিত বীজ, তখন খুব টের পাই মর্মের ভিতরে কী অপরিসীম শক্তি অনুভব করতেন তিনি। কলকাতার নানা স্থানের সাথে বেলেঘাটায় দাঙ্গার কথা বলতে হবে। দি গ্রেট ক‍্যালকাটা কিলিং। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট। বাহাত্তর ঘন্টার মধ‍্যে চার হাজারের বেশি মানুষ খুন আর লক্ষাধিক মানুষ আশ্রয়হারা। এই পরিস্থিতিতে দাঙ্গা থামাতে দেশের কোণে কোণে দৌড়ে যাচ্ছেন গান্ধিজি। সুকান্ত লেখেন, “এখানে আমরা লড়েছি, মরেছি, করেছি অঙ্গীকার, এ মৃতদেহের বাধা ঠেলে হব অজেয় রাজ্য পার। এসেছে বন্যা, এসেছে মৃত্যু, পরে যুদ্ধের ঝড়, মন্বন্তর রেখে গেছে তার পথে পথে স্বাক্ষর, প্রতি মুহূর্তে বুঝেছি এবার মুছে নেবে ইতিহাস- তবু উদ্দাম, মৃত্যু-আহত ফেলি নি দীর্ঘশ্বাস; নগর গ্রামের শ্মশানে শ্মশানে নিহিত অভিজ্ঞান;
বহু মৃত্যুর মুখোমুখি দৃঢ় করেছি জয়ের ধ্যান। বলেন, আজ হাত ধরো গান্ধিজি। সাম‍্যবাদী আন্দোলনের প্রতীক লেনিনের ভাবাদর্শের প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন। লিখেছেন, “যেখানে মুক্তির যুদ্ধ সেখানেই কমরেড লেনিন। অন্ধকার ভারতবর্ষ: বুভুক্ষায় পথে মৃতদেহ— অনৈক্যের চোরাবালি; পরস্পর অযথা সন্দেহ; দরজায় চিহ্নিত নিত্য শত্রুর উদ্ধত পদাঘাত, অদৃষ্ট ভর্ৎসনা-ক্লান্ত কাটে দিন, বিমর্ষ রাত বিদেশী শৃঙ্খলে পিষ্ট, শ্বাস তার ক্রমাগত ক্ষীণ— এখানেও আয়োজন পূর্ণ করে নিঃশব্দে লেনিন।” কী অসাধারণ এক একটা কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যের আকাশে সমুজ্জ্বল স্থানটি অধিকার করে গিয়েছেন পরীক্ষায় পাশ না করতে পারা ছেলেটা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।