T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় সুপর্ণা বোস
by
·
Published
· Updated
রবিঠাকুরের বাল্মীকি-প্রতিভা ও তার আনুসঙ্গিক খুঁটিনাটি
বাঙালির জীবনের প্রতিটি পর্বে জড়িয়ে থাকেন রবীন্দ্রনাথ।সহজপাঠের সাথে সহজেই ঢুকে পড়েন শিক্ষা ও সংস্কৃতির বীজের মতো। রবিঠাকুরের ছড়া এবং গানের হাত ধরেই আমাদের কচিবয়সের সংস্কৃতিচর্চা শুরু হয়। একটু বড় হয়ে অর্থাৎ কৈশোরে, নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ অথবা দুইবিঘা জমি আবৃত্তি করে দু একটা ওয়াটারবটল, টিফিনবাটি পুরস্কার নিয়ে বাড়ি ঢোকেনি এমন ছেলেমেয়ে পাওয়া কঠিন। কিছু না হোক বছরে একবার দুবার বাড়ি থেকে তক্তপোস নিয়ে গিয়ে প্যান্ডেল করে রবিঠাকুরের চন্ডালিকা, শ্যামা অথবা তাসের দেশ অনুষ্ঠিত হবেই।আর সেখানে পাড়ার ছোট বড় অনেকেই অংশ নেবে।এটাই দস্তুর।আমিও অংশ নিতাম।একবার বাল্মীকিপ্রতিভায় সরস্বতী আর কালমৃগয়ায় রাজা।এ তো গেল কৈশোরের কথা।যৌবনে এসে প্রেমপত্রে দু এক ছত্রে তাঁর কবিতা বা গানের দু এক লাইন উদ্ধৃত হবে না সেতো হতে পারে না।” তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা” অথবা ” যারা কাছে আছে তারা কাছে থাক। তারা তো পারেনা জানিতে।তাহাদের থেকে তুমি কাছে আছ আমার হৃদয় খনিতে” এই সমস্ত অমোঘ পংক্তি না থাকলে হৃদয়ের প্রকৃত ভাব প্রকাশ করাই সম্ভব হতোনা কোনোভাবে। বার্ধ্যক্যের অবসরেও সেই রবীন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাস আর রবিঠাকুরের গান আশ্রয়।এই আমাদের রবিঠাকুর।আমাদের আত্মার আত্মীয়। আমরা তাঁকে ছুঁয়ে থাকি।আমাদের জীবন সহনীয় হয়।
একজন সৃষ্টিশীল মানুষ তাঁর কাজের মধ্যেই ঘনীভূত হয়ে থাকেন।তাঁর এক একটি কাজের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অনুষঙ্গ ও অনুপ্রেরণাগুলি চাঁদের গায়ে জড়িয়ে থাকা মেঘের মতই ঘিরে রাখে সৃষ্টির হিরন্ময় আখ্যান।যেগুলি তাঁর বিপুল কর্মকান্ডের চালিকাশক্তি! রবীন্দ্রনাথ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন।বিভিন্ন সময়ে তাঁর সৃষ্টির মহার্ণবে যুক্ত হয়েছে অজস্র ধারা। শিল্প সাহিত্যের কোনো ক্ষেত্রই অস্পৃষ্ট রাখেননি তিনি।একই সঙ্গে তিনি ছিলেন কবি ঔপন্যাসিক সঙ্গীতস্রষ্টা,নাট্যকার,চিত্রকর,ছোটগল্পকার,প্রাবন্ধিক,অভিনেতা কন্ঠশিল্পী সর্বোপরি একজন দার্শনিক।এই বিপুল ধারার মধ্যে এক সময় যুক্ত হলো গীতিনাট্য। তাঁর রচিত প্রথম গীতিনাট্য “বাল্মীকি প্রতিভা”।বাল্মীকি প্রতিভা তাঁর সাহিত্যচর্চার একটি টার্নিং পয়েন্ট বলা যায় কারণ এর মাধ্যমেই তাঁর গীতিনাট্য রচনার শুরু।পরবর্তীকালে আরো অনেক গীতিনাট্য রচনা করেছেন।সেগুলি বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন স্থানে অভিনীত হয়েছে।রবীন্দ্রনাথ নিজে অভিনয় করতেন।বাল্মীকি প্রতিভায় তিনি বাল্মীকির চরিত্রে অভিনয় করেন এবং সরস্বতীর ভূমিকাটি করেন তাঁর দ্বাদশবর্ষীয়া ভাতুষ্পুত্রী প্রতিভা।বাল্মীকি প্রতিভার নামের মধ্যে সেই ইতিহাসটুকু রয়ে গিয়েছে।
বাল্মীকি-প্রতিভা প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল বারোশ সাতাশি সালের ষোলোই ফাল্গুন( 26th February 1881)।ভারতী উৎসবের ষষ্ঠ বার্ষিক সন্মেলনের অনুষ্ঠানে।এই উপলক্ষে বিদ্বজ্জনের আমন্ত্রণের উদ্দেশ্যে শ্রী দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পক্ষ থেকে একটি আমন্ত্রণলিপি ছাপানো হয়।সেখানে বাল্মীকি প্রতিভা নামে একটি অভিনব গীতিনাট্য অনুষ্ঠিত হবার কথা উল্লেখ করা হয়।এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে বাল্মীকি প্রতিভার যে স্ক্রিপ্ট বা অভিনয়পত্রীটি ব্যবহার হয়েছিল সেটিই এর প্রথম মুদ্রিত প্রকাশ।প্রকাশক ছিলেন প্রসন্ন কুমার বিশ্বাস।প্রথমদফায় মোট একহাজার কপি ছাপা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে তিনটি দৃশ্য ও মোট ছাব্বিশটি গান গ্রন্থিত হয়।প্রতিটি গানের সঙ্গে মূল রাগ ও তাল উল্লেখ করা ছিল। ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য অনুষ্ঠানের মতই এই এই অনুষ্ঠানটিও আয়োজন করা হয়েছিল ঠাকুরবাড়ির তেতলার ছাদে প্যান্ডেল করে।প্রথম দুটি সংস্করণে বাল্মীকি প্রতিভার রচয়ীতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নাম উল্লিখিত হয়নি।পরবর্তীকালে গানের বহি ও বাল্মীকিপ্রতিভা গ্রন্থে লেখক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নাম মুদ্রিত হয়।সূচনায় লেখা হয়েছিল, ” এই গীতিনাট্যখানি ছন্দ ইত্যাদির অভাবে অপাঠ্য হইয়াছে।ইহা সুর লয়ে নাট্যমঞ্চে শ্রবণ ও দর্শনযোগ্য।” বাল্মীকি প্রতিভা মূলত কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর ” সারদামঙ্গল ” গীতিনাট্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে রচনা করেছিলেন।পরবর্তীতে কালমৃগয়ার কয়েকটি গান এর সঙ্গে যুক্ত হয়।
জানা যায়,বছরে একবার দেশের সমস্ত সাহিত্যিকগনকে একত্র করার উদ্দেশ্যে ঠাকুরবাড়িতে ‘ বিদ্বজ্জনসমাগম ‘ নামে একটি সভা স্থাপন করা হয়েছিল। সেই সম্মেলন উপলক্ষেই গানবাজনা আবৃত্তি ও খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হতো।এই সভার দ্বিতীয় বাৎসরিক অনুষ্ঠানে বাল্মীকি প্রতিভা অনুষ্ঠিত হয়। এই নাটকের বিষয়বস্তু ছিল, দস্যু রত্নাকর কিভাবে দেবী সরস্বতীর কৃপায় দস্যুবৃত্তি ছেড়ে কবি হিসেবে অমরত্ব লাভ করলেন সেই আখ্যান। অনুষ্ঠানে দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,প্যারীমোহন মিত্র, পন্ডিত মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন,ডঃ কৃষ্ণমোহন মুখোপাধ্যায়ের মত গন্যমান্য মানুষেরা।পরের দিন ‘সাধারণী’ পত্রিকায় একটি সপ্রশংস প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। এই সমস্ত আনুসঙ্গিক বিষয়গুলি অবশ্যই একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে তাঁর কাজের ক্ষেত্রে উজ্জীবিত ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে নিশ্চিত।সেইসঙ্গে থাকে তাঁর ,সৃজনশীলতা, ধৈর্য, ও পরিশ্রমে কঠিন_কোমল বাস্তব ও সমকালকে শিল্পে তর্জমা করার বিরল প্রতিভা।
বহু গবেষক তাঁকে খুঁজেছেন তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে।ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন।সে এক ধরনের খোঁজ।আবার একজন সাধারণ পাঠক যখন তার জীবনযন্ত্রণায় নিদান হিসেবে খোঁজেন তখন সে এক ভিন্নধারার খোঁজ।এই খোঁজ যত না মস্তিষ্ক চালিত তার থেকে অনেক বেশি আবেগ সঞ্জাত।উভয়েরই নিবিড় অন্বেষণ।আনন্দে বিষাদে বিপদে সম্পদে বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথ এক চিরকালীন আশ্রয়।