T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় প্রদীপ গুপ্ত
by
·
Published
· Updated
সুমনার পঁচিশে
মন খারাপ করে স্টাডিতে বসে রয়েছে সুমনা। আজকের বিকেলটা খুব খারাপ লাগছে ওর। বুকের ভেতরটায় কষ্ট হচ্ছে খুব। গলার মধ্যে কী যেন একটা দলা পাকিয়ে আছে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না সুমির।
স্টাডিতে কিছুক্ষণ গুম মেরে বসে থেকে ছাদের বাগানে গেলো সুমনা। ছাদটা ওর খুব প্রিয়। চারদিকে ফুলের টবে ভরে আছে ছাদটা। পাখিদের জল খাবার পাত্রটাতে জল আছে কিনা দেখে নিলো ও। রোদে শুকিয়ে গেছে অনেকটা। অথচ সারাদিন রোদে পুড়ে এই সন্ধ্যে হওয়ার সময়, ওরা যখন পাশে বিরাট রেনট্রির ডালে ডালে বেঁধে রাখা বাসায় ঢোকে, তার আগে প্রতিদিন ওদের জন্য দেওয়া জলের পাত্রে ঠোঁট ডুবিয়ে জল খেয়ে ফের বাসায় ফেরে ওরা।
সুমনা পাত্রটাতে কানায় কানায় জল ভরে দিলো। এরপর জলের ঝাঁঝরিটাতে জল ভরে নিয়ে এগিয়ে গেলো ফুল গাছগুলোর দিকে।
প্রতিদিনই এই সময়টা ওদের সাথে কথা বলে সুমি। এবছর বৃষ্টি কবে হবে, ফুল ফুটতে দেরি হবে, না কি সময়মতোই ফুটবে ফুলেরা। গাছগুলোর সুখ দুঃখের কথা শুনতে শুনতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। তারপর ঘরে ঢুকে হাত-পা ধুয়ে স্টাডিতে গিয়ে বসে।
কিন্তু আজ এতোটুকুও ভালো লাগছে না ওর। বেলফুলে ঝাপসা হয়ে আছে গাছগুলো। জুঁইও প্রচুর ফুটেছে এবার। চচন্দ্রমল্লিকাদের চলে যাওয়ার সময় হলেও এখনো যেন যেতে চাইছে না ওরা।
আজ আর বেল জুঁই, চন্দ্রমল্লিকা,জিনিয়া কোনো দিকে মন নেই সুমির। একটা ছোট্ট বুলবুল এসে ওর দিকে এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে ছোট্ট ছোট্ট শিস দিয়ে উঠলো। যেন ওকে জিজ্ঞাসা করলো — কিগো মেয়ে, কালো মুখ করে বসে আছো কেন?
কিন্তু সুমি সেদিকে ফিরেও চাইলো না। ও মাথা নীচু করে ফিরে চললো ওর স্টাডির দিকে।
সামনে বাংলা বইটা খুলে বসে আছে সুমনা। চোখ বইয়ের পাতার ওপর থাকলেও মন অন্য কোথাও ভেসে আছে।
নন্দিতা টিফিনের বাটি আর দুধের গ্লাস হাতে ওর পড়ার ঘরে এসে থমকে দাঁড়ালো। কী হয়েছে কি সুমির? ওর মুখে কালবোশেখীর কালো মেঘে ছেয়ে রয়েছে।
— ” কী হয়েছে রে তোর মামন? ”
চুপ করে বসে রইলো সুমি। একটা শব্দও উচ্চারণ করলো না ও।
নন্দিতা এগিয়ে এসে ওর মাথার চুলে হাত রাখলেন।
–” আমায় বলবি না মামন? ”
–” কিছু হয় নি আমার –”
কথার ভেতর দিয়ে যেন দু’চোখে বান এলো।
–” মায়ের কাছে কোনো কিছু লুকোতে নেই সোনা। তুইই না বলিস আমি তোর সবচেয়ে ভালো বন্ধু? ”
–” হ্যাঁ তো মাম্মাম। ”
–” তাহলে বল, আমায় লুকোলে মন আরও খারাপ হবে। “
–” ওরা কেন স্কুল বন্ধ করে দিলো মাম্মাম, তাহলে আমাদের রবীন্দ্রজয়ন্তীর কি হবে? এতোদিন ধরে যে রিহার্সাল দিলাম, সে সব…”
–” এই ব্যাপার? তুমি জানোনা, সারাদেশে কী হচ্ছে? ”
–” কী এমন আর হচ্ছে, যা হচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু তাই বলে… ”
— ” আমাদের কাজের দিদির বাড়ির সবার –”
–” কী হয়েছে দুর্গাদির? ”
–” সারা দেশে যা হচ্ছে, সেটাই… ”
–” কী হচ্ছে সারা দেশে মাম্মাম? ”
–” রোজ হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে প্রতিদিন। ”
–” সে তো করোনার জন্য –”
–” সে জন্যই তো স্কুলও –”
–” কটা দিন পরে বন্ধ করলে কী আর এমন ক্ষতি হতো৷ বলো ? ”
–” তোমার মুখে এটা মানায় না সোনা, চারদিকে মানুষ অসহায় ভাবে মরে পড়ে থাকছে। শ্মশানে মৃতদেহ দাহ করার জন্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না, মৃতদেহ রাস্তায়ঘাটে পড়ে থাকছে, সেসময়টাতে তোর নাচটাই বড় হলো?
নন্দিতার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে মুখ নীচু করে বসে রইলো সুমি। আর ওর দু-চোখ দিয়ে টপটপ করে চোখের জল পড়তে লাগলো বাংলা বইয়ের পাতার ওপর।
এবার সুমির গা ঘেষে এসে বসলো নন্দিতা।
ওর পিঠে হাত রাখলো। ওর গালে একটা হামি দিলো নন্দিতা।
–” স্কুলে কোন নাচটা প্রাকটিস করাচ্ছিলো তোকে? ”
মায়ের গলার চুল সরিয়ে মুখ রাখলো সুমি।
–” ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে -”
–” তাই? আরে এটা তো আমারও ফেবারিট নাচ রে! ”
উঁচুস্বরে বলে ওঠে নন্দিতা।
–” তুমি? তুমি নাচ জানো? কোথায় আমায় তো বলো নি কোনোদিন? ”
–” আমি খুবই ভালো নাচতে জানতাম রে। প্রচুর অনুষ্ঠানেও নেচেছি বহুদিন। আচ্ছা সুমি, আমরা যদি বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথকে পুজো দিই তো কেমন হবে? ”
–” ধুস, সেটা আবার হয় নাকি? গান গাইবে কে? ”
–” আমি গাইবো, তুই নাচবি আর বাবা বাজাবেন –”
–” সত্যি মাম্মাম! ”
–” একদম সত্যি রে। বসার ঘরে হবে। কাজের দিদি, ড্রাইভারের বউ মেয়ে, দেখবে। শোভনদাদা – বৌদি, মাসি মেশোন, সবাইকে বলবো আসতে। ”
আনন্দে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে সুমি।
–” মাম্মাম তুমি সত্যিই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।”
এরপরের পাঁচ’ছ দিন যে কোত্থেকে কেটে গেল সুমির। রোজ সকাল বিকেল রিহার্সাল। আর শুধুই ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে নয়। তার সাথে যোগ হলো –” হে নূতন দেখা দিক আরবার, এসো হে বৈশাখ ছাড়া আরও দু’টো গান। ”
সবাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়ে গেছে। বাবা বসার ঘরে পর্দা টাঙিয়ে স্টেজ বানাবে, মা সারাটা বসার ঘর জুড়ে আলপনা দেবে। আর সুমির ওপর দায়িত্ব রইলো তুলে মালা গেঁথে, রবিঠাকুরের গলায় ওর আর ওর মায়ের খোঁপায় পড়ানোর। ফুল বেশী হলে কাজের দিদি, ড্রাইভার কাকুর বউ, বৌদিমনি, মাসিমনি সবার জন্যই একটা করে খোঁপার মালা গাঁথবে সে।
বিকেলবেলা ছাদে উঠে ফুলেদের সাথে, পাখিদের সাথে গল্প করে নীচে এলো সুমি। আজ আর শুতে ইচ্ছে করছে না ওর। তবুও শুতে যেতেই হলো।
কিছুতেই ঘুম আসছে না সুমির। এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো।
সাজি হাতে বাগানে যেতেই চোখে যেন অন্ধকার দেখছে সুমি। ফুলগুলো ফুটে আছে ঠিকই কিন্তু, সবকটা ফুলই শুকিয়ে আছে। লাল হয়ে আছে সাদা ফুলগুলো। একি! এরকম হলো কেন? তাহলে কি কাল গাছে জল দেওয়া হয়নি? সুমি এখন কি করে? ভীষণ কান্না পেলো সুমির। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সুমি।
হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো ওর। এতোক্ষণ ধরে তাহলে স্বপ্ন দেখছিলো সে? ধড়ফড় করে উঠে ও ঠাকুরঘরের দিকে দৌড় লাগালো ও। বসার ঘরে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো সুমি। ঘরের পশ্চিম দিকের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে একটা সুন্দর বেডকভার, মেঝেতে পাতা রয়েছে একটা নীল হলুদ কাস্মীরী কার্পেট, ঘরের আনাচকানাচ জুড়ে সুন্দর আলপনা। একটা টি টেবিলে দাঁড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। আর মা একরাশ ফুল নিয়ে মেঝেতে বসে মালা গাঁথছেন।
বৌদিমনি আর দাদাভাই হাতে করে নিয়ে এসেছেন লুচি আর ছোলার ডাল, মাসিমনি কষা মাংস আর রসোগোল্লা, কি দারুণ যে কাটলো পঁচিশের সন্ধ্যাটা, নাচে আর গানে, ফুলে আর মালায়, ধুপের ধোঁয়ার মম করা গন্ধে।
শুয়ে আছে সুমি, আর ওর কানে তখনও বেজে চলেছে — ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কীবা মৃদুবায়.