• Uncategorized
  • 0

T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় আশিস চৌধুরী

রবীন্দ্রনাথ আজও আমাদের জীবনে প্রাসঙ্গিক

যখন প্রখর তপন তাপে আকাশ তৃষায় কাঁপে তখন বৈশাখের এই ভোরের হাওয়ায় যার কথা খুব বেশি মনে পড়ে তিনি রবীন্দ্রনাথ।আমাদের অনেকেরই হয়ত সারাজীবনের সঙ্গী তিনি,তবুও বৈশাখ এলে তাঁর চরণের ছন্দ অনুভব করি।আমাদের অন্তরে বোধ হয় এই প্রার্থনা ধ্বনিত হয়-তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে। ছোটবেলায় পড়া সেই ‘সহজপাঠ’আর লিনোকাটের ছবি আজও ভুলতে পারিনি অনেকেই,সে কি ভোলা যায়! তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে কেউ তা জানে না। হ্যাঁ,কবে থেকে তিনি আমাদের জীবনে ঢুকে পড়েছেন আমরা তা ঠিক করে অনেকেই বলতে পারব না।‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ পড়তে পড়তে তখন কেমন বিহ্বল হয়ে গেছি আর আজও সেই বিহ্বলতা!কাল ছিল ডাল খালি/ আজ ফুলে যায় ভরে/ বল দেখি তুই মালী/ হয় সে কেমন করে।‘সহজপাঠ’ এর লেখাগুলি পড়তে পড়তে অনেকেই সেই রাজপ্রাসাদের ভেতর ঢুকে পড়েছি আবার কেউ কেউ পাশ কাটিয়ে অন্যত্র চলে গেছি।যত বয়স বেড়েছে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে মনের মত কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করেছি এবং কেউ কেউ তা পেয়েছিও। তাঁর এক একটি গানকে নিয়ে যদি ভাবি তাহলে দেখব হীরকখণ্ডের মত দ্যুতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে।তাঁর গান কম বয়সে যখন শুনেছি তার অভিঘাত একরকম আর এখন অন্যরকম।সেই গানগুলি কিন্তু আমাদের কাছে পুরনো হয়ে যায়নি।তিনি যতই বলুন ‘পুরানো জানিয়া চেয়ো না আমারে আধেক আঁখির কোণে।‘ তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে- আমাদের এই প্রার্থনা তিনি পূরন করেন।কখনও তাঁর গান শুনে বেদনায় ভরে যাচ্ছে পেয়ালা আবার কখনও বা উদীপ্ত হচ্ছি আনন্দধারা বহিছে ভুবনে শুনে।তাঁর গান আজও আপামর বাঙালিকে নেশাগ্রস্ত করে রেখেছে বললে বোধ হয় খুব একটা ভুল বলা হবে না। তাঁর কাজকর্মের প্রতি যদি আমরা ধ্যান দিই তাহলে দেখব সেই সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি শিক্ষা,কৃষি,সমবায় ব্যাঙ্ক,কারিগরি শিক্ষা নিয়ে যেসব চিন্তাভাবনা করেছিলেন এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ করেছিলেন তা জেনে আমরা আশ্চর্যান্বিত হই।তিনি সারাজীবন নিজেকে নানারকম সৃষ্টিকর্মে যুক্ত রেখেছিলেন।শুধু শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির কথা বলছি না তাঁর বিপুল কাজকর্মের কথাও তার সঙ্গে বলতে চাইছি।তাঁর শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আমরা যতটা মুখর ঠিক ততটাই নীরব থাকি তাঁর বিশাল বৈষয়িক কাজকর্মের ব্যাপারে। অপরিমেয় জীবনীশক্তি নিয়ে জন্মগ্রহণ করা এই মানুষটি সব্যসাচীর মত সারাজীবনই বিপুল কাজকর্মের মধ্যে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন।হয়ত আমরা কিছুটা কর্মবিমুখ বলেই তাঁর সেই কাজকর্মকে অনুসরণ করার কথা ভাবিনি একবারও।সেই কারণেই হয়ত এই দিকটি আমাদের রবীন্দ্রচর্চায় আজও উপেক্ষিত। আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে যে একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে সে কথা আমরা ভুলে যাই।এই কারণেই তিনি শান্তিনিকতনে বৃক্ষরোপণ , হলকর্ষণ,বসন্তোৎসব অনুষ্ঠানের সূচনা করেছিলেন।আজ পরিবেশের ভারসাম্য ক্রমাগত নষ্ট হওয়ার ফলে মানবসমাজ ধ্বংসের মুখোমুখি।যে পরিবেশকে দু’হাত দিয়ে আগলে রাখার কথা তার পরিবর্তে শুধুমাত্র লাগামছাড়া ভোগবিলাসের স্বার্থে আমরা ধ্বংস করে চলেছি। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-ভাবনা আজও আমাদের জীবনে প্রাসঙ্গিক।আধুনিক ভারত গড়ার কাজে যারা স্বঘোষিত মোড়ল তারা রবীন্দ্রনাথের সেইসব চিন্তা-ভাবনার ব্যাপারে হয় অজ্ঞ নতুবা উপেক্ষা করছেন।তাঁর কর্মপদ্ধতি এবং জীবনদর্শন যদি আমরা অনুসরণ করতাম তাহলে এত রক্তপাত,হানাহানি,দেশ ও জাতির প্রতি নেতাদের এই বিশ্বাসঘাতকতা আমদের দেখতে হত না।চারিদিকে যেন হিংসার উৎসব চলছে। এই সমাজে নারীদেরই বা এত অসম্মান কেন?তিনি তো জীবনভর তাঁর সাহিত্যে এবং বাস্তবজীবনে নারীর প্রতি গভীর ভালোবাসা,শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের পরচয় দিয়েছেন।যে রবীন্দ্রনাথ আলোর সন্ধান দিয়ে গেছেন তাঁর দেশে জীবনানন্দ কথিত এই ‘অদ্ভুত আঁধার’ কেন?একথা আজ অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে আমাদের জাতীয় জীবন এবং ব্যক্তিগত জীবন গভীর সঙ্কটের সম্মুখীন।কিছু স্বার্থান্বেষী,অর্থলোলুপ মানুষের বিশ্বাসঘাতকতায় পুরো সমাজটায় বিশ্বাসহীনতায় ভুগছে।তাই মাঝে মাঝে মনে হয় আজ যে জীবনযাপনে আমরা অভ্যস্ত তার বেশীরভাগটাই যেন মেকি,ভেজাল আর প্রবঞ্চনাময়। তিনি সারাজীবন মিলনের জয়গান গেয়েছেন বলেই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিগত বিদ্বেষ এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ তাঁকে সর্বতোভাবে পীড়িত করেছে। তাই তাঁর কণ্ঠ এবং লেখনী সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাতের বিরুদ্ধে এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বারবার সোচ্চারিত হয়েছে।অতীতে সব মিল থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ধর্মীয় অমিলের কারণে এক প্রতিবেশী আর এক প্রতিবেশীর ওপর চড়াও হয়েছে,এই ধর্মীয় সংঘাতে অনেক প্রাণ বলি হয়েছে।সেসব আজও থামেনি বরং তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।তিনি তাঁর হিন্দু-মুসলমান নামক প্রবন্ধে লিখেছেন-‘যে দেশ প্রধানত ধর্মের মিলে মানুষকে মেলায়,অন্য কোনো বাঁধনে তাকে বাঁধতে পারে না, সে দেশ হতভাগ্য।যে দেশ স্বয়ং ধর্মকে দিয়ে যে বিভেদ সৃষ্টি করে সেইটে সকলের চেয়ে সর্বনেশে বিভেদ। মানুষ বলেই মানুষের যে মূল্য সেটিকেই সহজ প্রীতির সঙ্গে স্বীকার করাই প্রকৃত ধর্মবুদ্ধি।যে দেশে ধর্মই সে ই বুদ্ধিকে পীড়িত করে রাষ্ট্রিক স্বার্থবুদ্ধি কি সে দেশকে বাঁধতে পারে?’ আজ রাজনীতির সংকীর্ণ চিন্তা-ভাবনা আমাদের সত্যের বিপরীত অভিমুখে চালিত করছে। কিন্তু তিনি বারবার বলেছেন সংকীর্ণ ভাবনা দ্বারা যেন আমরা চালিত না হই। কে শোনে তাঁর কথা।  মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের বন্ধন ক্রমশ শিথিল হচ্ছে, সামাজিক বন্ধনও আর অটূট নেই।যা ঘটছে তাকে মোটেই জীবনের মূলস্রোত বলা যায় না।আমাদের নেতাজি,রবীন্দ্রনাথ,বিবেকানন্দ-এই ঐতিহ্যময় উত্তরাধিকার থাকা সত্ত্বেও আমরা মনেপ্রাণে এত দীন হয়ে যাচ্ছি কেন? ভারতীয় এবং বাঙালি হিসেবে এই গর্ব তো করতেই পারি যে ওইসব মানুষদের উজ্জ্বল উপস্থিতি একদিন আমাদের মধ্যেই ছিল এবং তাঁদের নশ্বর দেহ বিলীন হয়ে গেলেও তাঁদের চিন্তা-ভাবনা এবং কর্মপদ্ধতি আজও আমাদের পথ দেখাতে পারে।কাজেই যে গভীর সংকট চলছে তার থেকে মুক্তির পথ আমরা রবীন্দ্রনাথ থেকে পেতে পারি।বছরে দুটি মাত্র দিন সাড়ম্বরে তাঁকে স্মরণ করলাম আর সারাবছর নানা অপকর্মে লিপ্ত থেকে দেশ ও জাতির সর্বনাশ করে গেলাম-এভাবে চললে আমাদের সংকটমোচন হবে না।রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে এক জায়গায় বলেছেন-আমি যে তোর আলোর ছেলে।আমাদের চিন্তা-ভাবনার অভিমুখ সেই দিকেই হওয়া উচিত।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *