মোবাইলটা বেজেই চলেছে। এই নিয়ে মোট এগারোবার হল। রিংটোনটা শুনে মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ একটা গানের সুর। আবদার করে শিখাকে বিজয় বলেছিল, ‘এই গানের সুর তোমার মোবাইলে আমার জন্য রইল। এই তুমি যে আমার সুর শুনলেই বুঝবে আমি ডাকছি। তোমার বিজয় ডাকছে।’
মোবাইলটা বন্ধও রাখতে পারছে না শিখা। অনেক জরুরি ফোন আসার কথা। চারিদিকে করোনার যা অবস্থা তাতে অনেকেই ক’দিন ধরে পরামর্শ নেওয়ার জন্য ফোন করছে। বাবার কাছ থেকে যতটুকু জেনেছে সেই সামান্য জানা থেকে সবাইকে পরামর্শ দিচ্ছে।
টিভি খুললে দেখা যাচ্ছে ডাক্তারবাবুরা তাঁদের সাধ্যমতো বোঝাচ্ছেন। বাবাও কয়েকবার এসেছে টিভিতে। কতদিন থেকে বাবার কোনো অবসর নেই। সে আর মা বাড়িতে বসে খুব চিন্তা করে বাবার জন্য। কি যে হবে! মাস কয়েক বাবা বাড়ি থেকে হাসপাতালে যাতায়াত করেছিল। ওই সময় বাবা এই বিচ্ছিরি ভাইরাস থেকে রেহাই পাবার কিছু নিয়ম নিয়ে আলোচনা করত। এখন সেটা দ্বিতীয়বার যেভাবে এল তাতে বাবা আর হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আসতে পারছে না।
আবার মোবাইল বাজল। সেই সুর। মোট বারোবার হল। সহ্যের বাইরে। বাধ্য হয়ে ধরল শিখা। মনে হচ্ছে একটা কড়া ধমকের দরকার আছে। তা না হলে থামবে না।
শিখা ফোন ধরে বলল, ‘কি হয়েছে? এতবার ফোন করছ কেন?’
বিজয় বলল, ‘তুমি ফোন ধরছিলে না কেন?’
‘তোমার কি আমার সঙ্গে কথা বলা উচিত? কী বলতে চাও তাড়াতাড়ি বল। আমি ফোন বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারব না।’
‘তুমি এইভাবে কথা বলছ কেন?’
‘তোমার সঙ্গে যেভাবে কথা বলার দরকার ঠিক সেভাবেই বলছি। যা বলতে হয় তাড়াতাড়ি বল।’
‘আমি কোথায় তোমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি। তুমি তো বাড়ি থেকে বেরুতেই চাও না।কতদিন বাদে তোমার সঙ্গে কথা বলছি। এতদিন কাজ ছিল তাই বলার সময় পাইনি। তোমাকে দেখিনি কতদিন। আমার বুঝি কষ্ট হয় না?’
‘বাজে কথা শুনতে ভালো লাগছে না। আমি রাখছি।’
‘এই রেখ না। আচ্ছা শিখা তোমার কি আমাকে দেখতে ইচ্ছা হয় না?’
‘না। হয় না।’
‘ভেবেছিলাম ভোটের দিন তোমার দেখা পাব। তাও পেলাম না। তুমি ভোট দাওনি?’
‘দেব না কেন?’
দিয়েছ? তুমি গিয়েছিলে?
‘কেন? কি ভেবেছিলে? আমার ভোটটা তুমি দিয়ে দেবে?’
‘আরে শুধু তোমার ভোট কেন আরো অনেকেরটা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। হল না। বাইরে থেকে আসা দৈত্যের মতো চেহারার লোকগুলো বন্দুক কাঁধে নিয়ে এমন তাড়া করল যে পালিয়ে যেতে হল।’
‘আহা! কী বাহাদুর। অন্যের ভোট দেওয়ার দরকার কি তোমার। যার ভোট তারই তো দেওয়া দরকার।’
ফ্যাক ফ্যাক করে হাসল বিজয়। ‘তোমাকে এসব বোঝাতে পারব না। তুমি তো কিছু বুঝতেই চাও না। টিভিতে দেখেছ তো। কী প্ল্যান দেওয়া হয়েছে তোমার জন্য। একদল ঘিরে ধরবে, আরেক দল ভোট দিতে যাবে। এত সুন্দর করে বোঝানো হল তুমি তো কিছু বুঝতেই চাইলে না। তোমাকে বললাম এসব টেকনিকগুলি শিখে নাও কাজে লাগবে।’
‘না ওসব আমার কোনো কাজে লাগবে না।’ শিখা বলল।
‘ভুলে যেও না তোমার বাবা একজন সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। ঠিক মতো লাইন করতে পারলে সেই হাসপাতালে তোমাদের বাড়ির কাজের লোককেও ডাক্তার করে দেওয়া যাবে। তোমাদের বাড়ির কুকুর বেড়ালেরও ভি আই পি ট্রিটমেন্ট হবে। ওই মানুষের হাসপাতালেই।’
‘চুপ।’
‘আমাকে চুপ করালে হবে? আরও আছে। জমিয়ে লাইন করতে পারলে তোমার বাবা মুখ্য উপদেষ্টাও হতে পারে। তুমিই বল নিজের শ্বশুরকে উচ্চপদে দেখতে কার না ভালো লাগে।’
‘আমি ফোন রাখছি।‘
‘এত রেগে যাচ্ছ কেন? আমি কী এমন দোষের কথা বললাম?’
তোমার অনেক দোষ।তোমাকে আমি টিভিতে দেখেছি। তুমি ভোটের দিন একজন প্রার্থীর গাড়িতে আধলা ছুড়েছ। লাঠি দিয়ে একজনের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছ।’
‘ কি মুশকিল! এইসব তুমি দেখেছ কেন? তখন কোনো ভালো সিরিয়ার ছিল না?’
‘টিভিতে দেখিয়েছে রাস্তায় তখনও রক্ত পড়েছিল। তুমি জানো এই গরমের সময় হাসপাতালগুলিতে রক্তের অভাবে রুগির চিকিৎসা করতে অসুবিধা হচ্ছে। তোমার একটিবারও মনে হল না সবাইকে বুঝিয়ে নিয়ে রক্তদান শিবিরে যাওয়ার কথা?’
‘সত্যিই তো! তোমার কথা ভেবে দেখার মতো। আমি ভাবতেই পারছি না যে তুমি এইভাবে ভাবতে পার। এমনিতেই আমি তোমার জন্য পাগল। এই কথাটা শুনে আমি আরও পাগল হয়ে গেলাম। আমি তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করব।’
‘কেন? বাবার সঙ্গে দেখা করবে কেন?’
‘আমি তোমার বাবাকে বলব যে, আমি শিখার জন্য সত্যি পাগল হয়ে গেছি।’
‘সত্যি পাগল হয়ে থাকলে আমার বাবার কাছে গিয়ে কোনো লাভ হবে না। বাবা কোনো সুবিধাই করতে পারবে না তোমার। তুমি বরং আমার কাকার কাছে যাও।’
‘কাকার কাছে? কেন তোমার কাকার কাছে যাব কেন?’
‘আমার কাকা পাগলের ডাক্তার।