পুনর্জাত / Ressurrection গল্পে অমৃতা মুখার্জী

পুনর্জাত / Ressurrection

সে প্রায় ছ ফুট লম্বা। তার বড় মই লাগেনা। মাঝারী একটা চেয়ারে দাঁড়িয়ে সে কড়িকাঠ ছুঁতে পারে। হুক টা ছুঁয়ে সে দেখে নিল মজবুত কিনা। তারপর দড়ি গলিয়ে লুপ টা বানালো। ভালো করে টেনে টুনে পরখ করে নিল স্লিপ করছে কি না।
এই নিঝুম রাতে এই অসম্ভব পশ এলাকার ফ্ল্যাটে সে একা। এসব কাজ কি কেউ দোকা করে? তেরা দীমাগ তো চল রহা হ্যায় বাচ্চু? নিজের রসিকতায় সে নিজেই একটু হাসল। সামনের আয়নাতে বাঁ দিকের গালে টোল পড়ল। নট ব্যাড। বেশ উত্তেজক আর যাকে বলে হট। এই টোলের জন্য সারা পৃথিবীর মেয়েরা পাগল। তাকে একটু ছোঁবার জন্য তারা অবলীলায় নারীর ভুষণ ত্যাগ করতে প্রস্তুত।
তাই বলে কেউ না ভাবে সে একটি মাকাল ফল। নো স্যার! রাজহাঁসের মত পাখা দুলিয়ে বড় বড় ডিগ্রীর ঝিল সে পেরিয়ে গেছে কতবার। মেকানিকাল ইঞ্জীনীয়ার হয়ে গেছিল প্রায়। এমন সময় রুপোলী পর্দা তাকে ডেকে নিল। হু হু করে দীওয়ালির রাতের তুবড়ি হয়ে সে উড়ে গেল সর্বোচ্চতায়। খ্যাতি, অর্থ, গ্ল্যামার চমকাতে লাগল তার ডানায়।
কিন্তু তার জীবন তো তার ই। তার সব দেখা হয়ে গেছে। রাজনীতি, দলাদলি, নগ্নতা, স্বার্থপরতার চূড়ান্ত প্রকাশ। আজকাল তার গা বমি বমি করে, গা ঘুলিয়ে ওঠে। তার কোন বন্ধু নেই। কোন ভালবাসা বা প্রেম নেই। ছোট থেকেই সে অভাগা। তার মাও নেই। সে জানে সে কাজ টা ভুল করছে। কিন্তু সে আর পারছেনা। এই বুকে হাঁটা মধ্যবিত্ত কেঁচোদের দলে ভীড় বাড়িয়ে লাভ কি? সে রাজপুত, গেলে রাজার মত যাবে, জাস্ট ওয়ান বিগ ব্যাং।
ধীরেসুস্থে সে নোট টা লিখল। সেল ফোন টা বন্ধ করল। জানলার পর্দা গুলো টেনে দিল। ইশ যাবার আগে একবার সাইনা কে হ্যালো বলবে নাকি?। নাকের নীচে একটা ভীষণ কিউট তিল আছে মেয়েটার। না: একদম না। নো মেলোড্রামা।
টুল টা লাগিয়ে সে উঠে পড়ল। গলায় একবার হাত বুলিয়ে নিল। ঘাম নেই। গায়ের জামা খুলে দড়িটায় হাত দিল। গুডবাই জিন্দেগী। মাথায় পড়িয়ে নিয়েছে প্রায়, ডোরবেল টা বাজল।
না সে খুলবেনা। সে বাড়ি নেই।
বেল টা আবার বাজল। হায় রাম! কেয়া জমানা আ গ্যয়া? শান্তিতে কেউ মরতেও দেবে না? ধুত্তেরি নিকুচি করেছে বলে নেমে এসে সে কী হোলের ডিসপ্লেটা দেখল। একজন বেঁটে খাটো মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন, সাদা কোট, গলায় স্টেথো। উস্কোখুস্কো চুল। একে সে চেনে। উল্টোদিকের ফ্ল্যাটে থাকে। যখনি দেখা হয় তাড়ায় থাকেন। সদাই উদভ্রান্ত। ছুটে চলেন। প্রায়শই এলিভেটরের দরজায় আটকে যান।
খুব নিশ্চিন্ততার ব্যাপার যে ভদ্রমহিলা বলিয়ূড দেখেন না বোধয়, সে যে এতবড় হীরো, বিন্দুবিসর্গ জানেন বলে মনে হয় না।
নিজের পিছনে দরজা বন্ধ করে সে সাবধানে বেরিয়ে এল “হাউক্যান আই হেল্প?”
ভদ্র মহিলা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন। “খুব বিপদ। আমাকে এখুনি আবার হসপিটাল যেতে হবে একটা কোভিড 19 এর প্রেসেন্টেশন নিয়ে। আফ্রিকা থেকে ডেলিগেট রা এসেছেন। কাল ভোরে লাগবে। আমার ল্যাপটপ টা লকড হয়ে গেছে। কিছুতেই কিছু করা যাচ্ছেনা। ক্যান আই বরো ইউ? এত রাতে কেউ সারাতে আসবেনা। ডূ ইয়ু নো কম্পুটারস? ক্যান ইয়ু ফিক্স ইট?”
এত দু:খেও সে মনে মনে হেসে ফেলল। আরে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ই ভানে। সে জানে কি না কম্পূটার ? হায় ঈশ্বর! অভিনয় বাদে ওটাই তো তার রাজ্য ছিল। এ পাগল বলে কি?
মুখে ভদ্র হাসি হেসে সে বলল “আরে ম্যাডাম কোন ব্যাপার না ! দীখাইয়ে তো জরা!”
ঘরের ভিতরে ঢুকে সে অবাক হয়ে গেল। সারা দেওয়াল জুড়ে এক ঝাঁক পথ শিশুদের ছবি। রোগা,অভুক্ত, মাল টানছে, ছেঁড়া চপ্পল, কিন্তু এক হাজার গনগনে সুর্যমুখী ফুলের মত মন ভোলানো চোখে দুষ্টু হাসির শাহজাদা, শাহজাদীরা ঘর আলো করে রেখেছে। এরা কারা?
মহিলা ল্যাপটপ এনে কাউন্টারের উপর রাখলেন। সে খুলে নেড়ে চেড়ে দেখল। তারপর একটা হেয়ার ক্লিপ চেয়ে নিল। সরু কালো ববি পিন টাইপ। পিছনের ইমারজেন্সী রীস্টার্ট বাটনের ভিতরে ক্লিপ টা আস্তে করে ঢুকিয়ে চাপ দিতেই নীল স্ক্রীন ফিরে এল।
মহিলা হাত তালি দিয়ে লাফিয়ে উঠে, হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু ই দিয়ে দিলেন। আনন্দে চোখে জল এসে গেছে উনার। তারপর লজ্জা পেয়ে বললেন “আই য়াম সো সরি। আসলে তুমি আজ অনেক লোকের জীবন বাঁচিয়ে দিলে। ধারাভির কাছে একটা বস্তিতে রোগ টা ভীষন ছড়িয়ে গেছে। অনেক অনাথ, পথের শিশুরা মারা যাচ্ছে। আফ্রিকা থেকে ইনফেকশাস ডিসিসের একটা সিরাম আনা হয়েছে। আমাদের হসপিটালে। এই প্রেসেন্টেশন যদি আপ্রুভ হয়, আমরা ভ্যাক্সিন দিতে পারব। ও মাই গড! তুমি একজন দেবদূত।”
সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। দেওয়ালের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল ” এহি বচ্চে লোগ?”
মহিলা চোখে জল নিয়েও রামধণুর মত হাসলেন। বললেন “হ্যাঁ আমি ওদের বস্তিতে ভলান্টিয়ারিং করি। ভাবতে পারবেন না ওরা এত গরীব। আপনার এই জামাটার আর জিনস টার যা দাম তাতে ওদের ছ মাসের খাবার হয়। ও হ্যাঁ! আরেক টা ব্যাপারে আপনাকে আরেকটু বিরক্ত করব। আপনি কি আমায় একটু হসপিটালে ড্রপ করে দেবেন? আমি খুব বাজে ড্রাইভ করি। স্পীড করার জন্য অলরেডি দুটো ফাইন খেয়েছি। এবার খেলে লাইসেন্স চলে যাবে।”
সে হা হা করে মন খুলে হাসল।”একমাত্র এক শর্তে এ কাজ টা আমি করতে পারি। যদি বাচ্ছাদের নিয়ে এই প্রজেক্ট টায় আপনি আমায় শামিল করেন।”
মহিলা লাফিয়ে ঊঠলেন। “দারুন আইডীয়া। ইন ফ্যাক্ট আপনার হাসি টা খুব সুন্দর। আপনাকে নিয়ে একটা ডকু করলে খুব প্রচার হবে। আমরা গ্রান্ট ও পেতে পারি। আপ কোই ফিল্ম স্টার তো নেহী ? লাগতি হ্যায় কহি দেখা হায় আপকো!”
সে হেসে বলল ” পাগল নাকি? ওনলি এলিভেটরে দেখেছেন। দাঁড়ান, আমি রেডী হয়ে আসছি।”
ঘরে এসে চট করে সে গাড়ির চাবি নিয়ে রেডী হল। পার্স নিল। অনেক দিন পর তার উত্তেজনায় রক্ত টগবগ করে ফুটছে। বেরোবার আগে কড়িকাঠে র হুক টার দিকে মুচকি হেসে সে
বলল
“দফা হো যা কমবখত! মুঝে জীনে কা বজা মিল গ্যয়া”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।